logo
news image

মারাক্কেশ শাফি আমিজমিজ ও আমাদের ভয়

—প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
মরক্কোর দক্ষিণ—পশ্চিমের সমুদ্র সীমান্তে পর্যটন শহর মারাক্কেশ, শাফি, তালাত নিয়াকুব, আমিজমিজে প্রচন্ড ভূমিকম্পের পর থেকে রব উঠেছে রক্ত নাই রক্ত চাই। গত ৮ সেপ্টেম্বর রাত ১১.১১মি: সেখানকার অধিবাসীরা ঘুমুতে যাবার পূর্ব মুহুর্তে হঠাৎ বুঝতে পারেন বিছানা দুলছে, ঘরও দুলছে। চোখের পলকে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে তাদের বসতিগুলো। মরক্কোবাসীর দু:স্বপ্নের রাত দিয়ে শুরু হয় অবর্ণনীয় কষ্টের। 
প্রাচীন বাড়িঘর ছাড়াও নতুন বহুতল ভবনের ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পরে এক করুণ দৃশ্য তৈরী হয়ে যায়। ভূমিকম্পের আঘাতে মাত্র ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ডের কাঁপুনিতে পাহাড়ি এলাকায় মাটির ঘরের পুরো গ্রামগুলো সমতলে পরিণত হয়ে গেছে। হঠাৎ এই রুপান্তর দেখে কেউ কেউ নিজের ভিটেমাটি ও আশপাশের কিছইু চিনতে পারছেন না। ভূমিকম্পের পাঁচদিন পর পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। 
মাত্র ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে এতবড় ধ্বংসযজ্ঞ সাধিত হবে তা কেউ কল্পনাও করেননি। ইতিহাস থেকে জানা যায় মরক্কোর আগাদির অঞ্চলে ১৯৬০ সালে ১২ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল এবং ২০০৪ সালে উত্তর—পূর্বের আল হোসেইমা অঞ্চলে ৬২৮ জন মানুষ মারা গিয়েছিল। কিন্তু  দক্ষিণ—পশ্চিমের সমুদ্র সীমান্তের এসব এলাকা ভূমিকম্পের আঘাতে কখনও ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। বড় কোন ভূমিকম্পের আঘাত হতে পারে সেটা কারো মাথায় আসেনি। তাই সেখানে পাহাড়ের ঢালের মধ্যে অতি সাধারণভাবে বসতবাড়ি গড়ে উঠেছে। তাই বর্তমান সময়েও সেখানে বাড়িঘর খুব হাল্কাভাবে বানানো হয়ে থাকে। বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন ইন্যূভার্সিটি কলেজ, লন্ডনের প্রফেসর ইমেরিটাস বিল ম্যকগ্রেথার। প্রাকৃতিকভাবে অত্যন্ত সুন্দর আবহাওয়া, স্বস্থ্যকর পরিবেশ, সহজলভ্য খাদ্য ও ফুল—ফলের সমাহার থাকায় সেখানে পর্যটন ব্যবস্থার প্রসার ঘটেছে। এসবকিছুর সাথে ঐতিহাসিক নিদর্শণের প্রাচুর্য থাকায় বিদেশী পর্যটকগণ এই এলাকায় বেশ ভীড় করতেন। একসময় ইবনে বতুতাও এসব এলাকা পরিদর্শণ করেছেন বলে জানা যায়। 
আটকে পরা মানুষের প্রাণ বাঁচাতে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার কমতি নেই মরক্কোয়। কিন্তু সরকারীভাবে বিদেশী সাহায্যলাভের অনুমতি না দেয়ায় সেখানে সেগুলো অপ্রতুল মনে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে অসংখ্য আহত মানুষের প্রাণ বাঁচাতে একসংগে বিপুল পরিমাণ রক্তের ব্যবস্থা না থাকা। স্থানীয় হাসপাতালগুলো এ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ব নেতারা সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করার কথা বলেছেন। আলজেরিয়া তাদের এয়ারস্পেস ব্যবহার করতে দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে। কিন্তু মরক্কো সরকার ঘটনার তিনদিন পরও বহির্বিশ্বের সাহায্য গ্রহণের জন্য অনুমতি না দেয়ায় বিপত্তি ঘটছে। এজন্য সেখানকার সাহায্যসংস্থাগুলো বেশ হতাশা প্রকাশ করেছে। তবে ঘটনার চারদিন পর অনুমতি পেয়ে স্পেন, কাতার ও নরওয়ের উদ্ধারকারী দল মরক্কোর উদ্ধার তৎপরতার সাথে অংশ নিয়েছেন। বৃটেন ৬০ জনের টিম ও প্রশিক্ষিত কুকুর পাঠিয়েছে।
বিষাদে মোড়ানো সারি সারি প্রাচীন দালানের ধ্বংসস্তুুপ এখন মাইলের পর মাইল মানব সভ্যতাকে পরিহাস করছে। মানুষ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কাছে কতটা অসহায় সেটা আবারো জানান দিচ্ছে এই ধ্বংসলীলা। এ অঞ্চলে এমন দুর্গম পাহাড়ি এলাকা রয়েছে যেখানে দ্রুত পৌঁছানো কষ্টসাধ্য।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পের ইতিহাস (রিখ্টার স্কেল ৯.৫, চিলি  মে, ১৯৬০) থেকে অদ্যাবধি যেসব ভূমিকম্প হয়েছে তা শুধু ধ্বংসের সাক্ষী দেয়। ভুমিকম্প এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যার সঠিক পূর্বাভাস দেয়ার ব্যবস্থা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তাই হঠাৎ এসে হাজির হওয়া এই দুর্যোগ যে কোন সময় মৃত্যুর মুখোমুখি হবার একটি চরম বার্তা। তবে ভূমিকম্পের ঝুঁকি আছে এমন ভৌগলিক এলাকায় বসবাসকারীগণ অনেকটা সাবধানতা অবলম্বন করার মাধ্যমে এর ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কমাতে পেরেছেন বলে মনে হয়। 
আজকাল কোথাও কোন বড় ভূমিকম্পের সংবাদ শুনলেই আমরা আঁৎকে উঠি। কয়েকদিন ধরে দুশ্চিন্তা করি। সেমিনার হয়, আলোচনা, পযার্লোচনা শেষে ভয়ংকর সব ভবিষ্যতবাণী দেন অনেক বিশ্লেষক। এর প্রেক্ষিতে ঢাকাসহ দেশের পুরাতন ভবন ভেঙ্গে ফেলা নিয়ে কথা উঠে। ইট পাথরের দালানের বস্তিকে সমালোচনা করতে কুন্ঠিত হই না কেউই। 
আবার অনেকে বাড়িঘর বাদ দিয়ে কংক্রীটের দ্বিতল রাস্তা, রেললাইন, এলিভেটেড সড়ক ইত্যাদি না বানানোর পক্ষে মতাতম দিই। কারণ জাপানের কোবে শহরে একটি দ্বিতল রাস্তা উল্টে পড়ে গেলে সেটার কংক্রীট সরানো নিয়ে কালক্ষেপণ ও যে কঠিন ভোগান্তি হয়েছে সেটা বিশ্ববাসী জানে। একটি উন্নত দেশে অত্যাধুনিক ক্রেণ ও রেসকিউ সরঞ্জাম থাকার পরও হেলে পড়া দ্বিতল রাস্তার কংক্রীটের চাক কেটে কেটে ডেব্রিজ সরানোর কাজে যে বিপর্যয় তৈরী হয়েছিল তা এখন একটি করুণ ইতিহাস। সেগুলো এখনও নানা সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়। আমরা ভয়ে ভয়ে শুনি, এক অপরকে দোষারোপ করি। একসময় দোয়া পড়ি ও সান্তনা খুঁজি। ক’দিন বাদে সবকিছু ভুলে যাই। আবার আগের মতো চলতে থাকি। 
সারা পৃথিবীতে নির্মাণ কাজের মহাযজ্ঞ চলছে। তেল—গ্যাস উত্তোলন, বহুতল ভবন, ব্রীজ, বাঁধ—ড্যাম, ওভারব্রীজ, দ্বিতল, ত্রিতল রাস্তা, পানি—গ্যাস ও বিদ্দুতের লাইন ইত্যাদি নির্মাণে ভূমির অতি ব্যবহার শুরু হয়েছে। এত নানা জায়গায় ভূতলের স্তরে ভাঙ্গন সূচিত হয়ে ভূত্বকে ভয়াবহ ভূমিধ্বসের শিকার হচ্ছে। মাটির নিচে সুড়ঙ্গ তৈরী করে বৃহৎ ক্যাটারপিলার দিয়ে মহা কম্পন তরঙ্গ সৃষ্টি করা হচ্ছে। স¤প্রতি ভারতের বিহার রাজ্যের যোশীমঠ শহরে শত শত ভবন, ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় উপাসনাগার, অফিস, শিক্ষাঙ্গন সহ মাটি ও পাহাড়ে বড় বড় ফাটল দেখা দেয়ায় সেখানে মানুষকে বসতি থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়া হয়েছে এবং জরুরী সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে (জিনিউজ ০৫.০১.২০২৩)। ধারণা করা হয়, যোশীমঠ শহর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে একটি বৃহৎ টানেল তৈরীর কম্পন থেকে এক সপ্তাহে ৫৬১টি বাড়িতে ফাটল দেখা দেয়। শহরের রাস্তা ও পাহাড়গুলোতে ফাটল তৈরী হয়। 
সারা পৃথিবী যখন ভূমিকম্পের ভয়ে ছোট ছোট ঘরবাড়ি তৈরী করে ঘিঞ্জি নগরায়ণ প্রক্রিয়া থেকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধমে প্রকৃতির সান্নিধ্যে গিয়ে বসতি তৈরীকে প্রাধান্য দিচ্ছে তখন আমরা নতুন করে পাহাড় কাটছি, দেশের বড় শহরগুলোকে সুউচ্চ দালানের বস্তি এবং দ্বিতল—তৃত্বল রাস্তা, রেললাইন, এলিভেটেড সড়ক ইত্যাদি দিয়ে কংক্রীটের ফাঁদ তৈরীর মহোৎসব শুরু করেছি। এসব প্রতিযোগিতা কতটুকু ক্ষতিকর সেসম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেও অজ্ঞানতার মধ্যে দিনাতিপাত করতে চেষ্টা করছি। 
মানুষ বেপরোয়ভাবে প্রকৃতির উপর হস্তক্ষেপ না করলে প্রকৃতি বার বার প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে না বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী করোনার ক্ষতিকর প্রভাব এখনও কাটেনি। এর মধ্যে ডেঙ্গু মহামারী, রাজনৈতিক একগুঁয়েমীপনা ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণহুংকারের দামামা বেজেই চলছে। এর সাথে হঠাৎ প্রলয়ংঙ্কারী ভূমিকম্পের মতো মৃত্যুর আহব্বান মেনে নেয়া খুব কষ্টকর। তাই সময় থাকতে সাবধান না হলে পরে আফসোস করার উপায় থাকবে না। 
তাই আমাদের দেশে ভেবেচিন্তে মহাপ্রকল্পগুলো হাতে নেয়া উচিত। এজন্য যথেষ্ট সময় নিয়ে যথার্থ (ইআইএ ও এসআইএ) মূল্যায়ণ সাপেক্ষে কাজে হাত দেয়া উচিত। কারণ শুধু পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ণই নয়— সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ণ না করলে পর্যটন শহর মারাক্কেশ—শাফি, আমিজমিজের মতো বসতি, স্থিত কৃষ্টি ও সভ্যতার বিনাশ সাধন হওয়াটা মুহূর্তের ব্যাপার হতে পারে। 

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top