আমার স্বজন ফিরোজ মাহমুদ খাঁন
মাসউদুল হক।।
পথিক নবীর যেমন 'একটা নদী ছিল' আমার তেমন একটা নিজস্ব আকাশ আছে। সেই আমার নিজস্ব আকাশের তাঁরাদের মধ্যে একজন ছিলেন ফিরোজ মাহমুদ খাঁন। বিশাল পৃথিবীর আকাশ থেকে 'কোথায় কখন যে কোন তাঁরা ঝরে পড়ে আকাশ হয়তো তা মনে রাখে না' কিন্তু যেহেতু আমার আকাশটা আমার একান্ত নিজের, তাঁরা সংখ্যাও নিতান্ত কম তাই আমাকে হিসেব রাখতে হয়। আমি হিসেব রাখতে পারি। হয়তো জীবনের দুরন্ত ঘূর্নীপথে কোন তাঁরা দূরে সরে গেছে। কোন তাঁরা কাছে এসেছে। কিন্তু ফিরোজ ভাইকে আমি আমার নিজস্ব আকাশের ধ্রুবতারা হিসেবেই বিবেচনা করি।
কবি যেমন বলতেন 'আসমানীরে দেখতে যদি চাও' তাহলে রসুলপুর যাও। তেমনি ভেক ধরা দুনিয়াতে আপনি যদি অথেনটিক মানুষ খুঁজতে চান তবে সপ্তাহখানেক আগে হলেও বলতাম ফিরোজ মাহমুদ খাঁনের বাড়ি যাও। এখন আর সে কথা বলতে পারব না। কারন সে পরলোকের পথে যাত্রা শুরু করেছে। যে ইহকাল তাকে নিরন্তর বেদনা দিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে সেই ইহলোকের সাথে অভিমানিক যাত্রা সে শেষ করেছে।
ফিরোজ মাহমুদ খান ছিলেন একজন অথেনটিক মানুষ। টাকা পয়সা, গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবী দখলের দৌড়ে তিনি ছিলেন না। সিভিল সার্ভিসের বেশিরভাগ মানুষ যখন 'দেশ সেবার সুযোগ'কে 'ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের সম্ভাবনা'য় রূপান্তরিত করায় ব্যস্ত তখন তিনি ব্যস্ত থাকতেন তার চিরকাল ধরে নির্মাণাধীন থাকা দ্বিতল বাড়ির ছাদের চিলেকোঠায়, নতুন কোন সাহিত্য-পত্রিকা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায়। একটা ইংরেজি লিটল ম্যাগাজিন বা সংকলনও বের হয়েছিল তার হাত ধরে। তার বাসার সাহিত্য আড্ডার নাম ছিল 'সুচিন্তা সাহিত্য আড্ডা'।
আমি তখন লেখক হবার স্বপ্নটা বাদ দিয়ে খুব বৈষয়িক হবার চেষ্টায় ব্রত । ফিরোজ ভাই কি কারনে যেন খুব ডাকতেন আমাকে তার বাসার সাহিত্য আড্ডায়। যাব-না, যাব-না করেও এক সময় গেলাম। এবং তারপর একটা লম্বা সময় ধরে আমি ঐ আড্ডায় নিয়মিতই হয়ে যাই। এবং জানতে পারলাম, "মানুষ এখনও স্বপ্ন দেখে, এখনও গায় গান"।
নতুন করে আবার লেখালেখি শুরু করবো কি-না, আমার ভাবনাগুলো মৌলিক কি-না তা নিয়ে আমার ভেতর একটা সন্দেহ ছিল।আমি ফিরোজ ভাইয়ের সাথে আমার ভাবনাগুলো শেয়ার করতাম। তিনি কখনও মুগ্ধ হতেন, কখনও বিরক্ত। কিন্তু এখনও কান পাতলে শুনি ফিরোজ ভাই বলছেন, ' মাসুদ, তুমি লেখো। লেখাটা ছাইড়ো না।'
অনেকদিন শুয়ে-বসে কাটানো মানুষের হঠাৎ করে হাঁটতে গেলে যেমন সংকোচ থাকে আমারও তা হয়েছিল নতুন করে লিখতে গিয়ে। গল্পের খসড়াগুলো পাঠাতাম। খসড়া গল্পগুলো তিনি পড়তেন, সাথে তার বিদূষী মা ফজিলাতুন্নেসা আন্টিও। ফিরোজ ভাই আর আন্টি দু'জনই খসড়া গল্পগুলোর ওপর মতামত দিতেন। তাদের দু'জনের অনুপ্রেরণায় আমি হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়ে নতুন করে লিখতে শুরু করি।
সে-ই আমার লেখালেখির জগতে দ্বিতীয় যাত্রার শুরু।
আমার কখনও কখনও মনে হয়, আমি যদি ফিরোজ ভাইয়ের বাসায় না যেতাম। ফিরোজ ভাইয়ের সান্নিধ্য না-পেতাম আমার হয়তো সাহিত্য জগতের দ্বিতীয় যাত্রাটি চিরকালের জন্য স্থগিত হয়ে থাকতো।
এখনও মনে পড়ে যে বছর আমি এইচএসবিসি কালি ও কলম তরুন সাহিত্যিক পুরস্কার পেয়েছিলাম সেই অনুষ্ঠানে ফিরোজ ভাই গিয়েছিলেন, সাথে হাঁটুতে ব্যথা নিয়ে ফজিলাতুন্নেসা আন্টিও। আমার মনে হয়েছিল আমার পরিবার, বন্ধুদের পাশাপাশি কিছু স্বজনেরও থাকা উচিত। কারন দীর্ঘদিন তাদের বাসায় আড্ডা দেয়া আর গল্পের খসড়া আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে তারা আক্ষরিক এবং প্রয়োগের দুই অর্থেই আমার স্বজন হয়ে উঠেছিলেন।
ফিরোজ ভাই বা আন্টি যে স্নেহের দ্বার শুধু আমার জন্য উন্মুক্ত করেছিলেন তা নয়। যারাই সাহিত্য, শিল্প নিয়ে আগ্রহী ছিল তাদের জন্যই উন্মুক্ত ছিল তাদের বাড়ির দরজা। অর্থ, সামাজিক অবস্থান কিংবা পদ-পদবী দিয়ে অতিথি নির্ধারণের এই যুগে ফিরোজ ভাইদের দেড় তলা বাড়িটি ছিল ব্যতিক্রম।
ফিরোজ ভাই বড় বা আলোচিত কোন প্রকাশনা ছাড়াই জীবন থেকে প্রস্থান ঘটালেন বটে কিন্তু আমার মত অনেক নগন্য লেখককে 'সুচিন্তিতা 'র আড্ডার মধ্য দিয়ে যে ভাবে সমৃদ্ধ করে রেখে গেছেন, যে ভাবে উজ্জীবিত করে গেছেন -তা এই যুগে বিরল।
আমি সব সময় চাইতাম এই পাথর-যুগের কোমল মাটির মানুষটা যেন নিজের যত্ন নেয়। অন্তত নিজের জন্য না হোক আমাদের মতো ভূত-গ্রস্থ মানুষদের জন্য হলেও।
যেই দুটি বৈশিষ্ট্য মানুষকে শিল্পী করে তোলে। সেই দুটি বৈশিষ্ট্যই তার মধ্যে ছিল। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা এবং খুব মোলায়েম রকমের সেল্ফ ডেস্ট্রাকটিভ। এই দুটি প্রবনতা শিল্পীর জন্য 'আপনা মাসে হরিণা বৈরি'র মতো। এই দুই বৈশিষ্ট্য শিল্পীর শিল্পের ধার বাড়ায় আবার এই দুটি বৈশিষ্ট্য শিল্পীকে সমাজের শত্রুতে পরিনত করে।
সমাজ আর ব্যক্তির ভেতরে চলমান এ লড়াই ব্যক্তি'র অনেক ক্ষয় করে। ফিরোজ ভাইয়ের ক্ষয় কতটা হয়েছিল জানি না। কিন্তু এইটুকু জানি , হি ওয়াজ এ পিওর সোল এন্ড ফাইটার।
সাম্প্রতিক মন্তব্য