হালদায় ডিমপাড়া লগ্ন যায়- কি করা?
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
এবছর আমপাড়ার ক্যালেন্ডারে ঘোষিত প্রথম নির্দিষ্ট তারিখ পার হলেও আমের আঁটি ভালভাবে চাপেনি। ঘোষিত লগ্ন পার হলো, কিন্তু বিপত্তি থেকেই গেল। তাই চাঁপাই নবাবগঞ্জের আমচাষীরা কেউ সেদিন আম পাড়তে উৎসাহী হননি। এমৌসুমে বিব্রতকর পরিস্থিতি নিয়ে সে সময়টা পার হয়েছে।
এর দুই সপ্তাহ না পেরুতেই আবার আরেকটি প্রাকৃতিক ঘটনা সংবাদের শিরোনাম হয়ে এলো। তা হলো- হালদা নদীতে শত শত জেলে নৌকা ও মশারী জাল নিয়ে মাছের ডিম ধরার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। তারা ঘূর্ণিঝড় মোখাকে লক্ষ্য করে অতিবৃষ্টির আশা করেছিলেন। সেই অতিবৃষ্টি শুরু হলে রুই-কাতলা ও অন্যান্য কার্প জাতীয় মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে হালদা নদীতে প্রবেশ করবে। মা মাছেরা হালদার বাঁকে বাঁকে স্রোতের মধ্যে ডিম ছাড়তে শুরু করলেই বাজিমাত। সেখানে পাতানো পাতলা কাপড়ের জাল ছেঁকে ডিম আহরণ করা হবে। মাছের ডিম ধরে হ্যাঁচারীতে পোনা তৈরী করে সেই পোনা নার্সারী পুকুরে বড় করে বিক্রি করে অনেক টাকা আয় হবে। এজন্য সারা বছর ধরে এই দিনেটির আশায় নদীপাড়ের জেলেরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন।
কিন্তু মোখা চলে গেল। যৎসামান্য বৃষ্টি হয়েছে মোখার প্রভাবে। দেশের আশিভাগ জেলার মানুষ মোখা নামক ঘূর্ণিঝড়ের কোন প্রভাবই বুঝতে পারেনি। দেশের উত্তরাঞ্চলে সেসময় বৃষ্টিই হয়নি। বরং মোখার প্রভাবে প্রচন্ড গরম অনুভূত হয়েছে।
মোখা চলে যাবার পর গরমের প্রভাবে হিমালয়ের পাদদেশে এবং আসামের পাহাড়ি এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাত হবার কথা। সীমান্তের ওপাড়ে ভারী বৃষ্টি হলে বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রাম এলাকার নদী ও হাওড়ে ঢল নামে। এবছর উজানে বৃষ্টি হলেও আমাদের পাহাড়ি নদীগুলোতে এখনও ঢল নামেনি। রুই-কাতলারা আসার সুযোগ পায়নি। মে মাস শেষ হতে চললো তবুও হালদা পাড়ের জেলেদের অপেক্ষার পালা ফুরায়নি। তারা বেকার হয়ে বসে আছে।
এই দুটো অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বলা যায়, প্রকৃতির আচরণে বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। সেমিনার-কনফারেন্সে প্রকৃতির পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আশঙ্কা করে যেসব বিবৃতি দেয়া হয় তা অনেকে গ্রাহ্য করেন না। এমনকি মনুষ্যসৃষ্ট ক্ষতির আশঙ্কা এড়াতে আরোপিত কার্বণ ট্যাক্স দিতে গড়িমসি করতে দেখা যায় অনেক সভ্য দেশে নীতিনির্ধারকদেরকে।
প্রকৃতিকে বশ করে মানুষ বাচঁতে চায়। বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রকৃতির ক্ষতি সাধন করার পর সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেবার জন্য পুনরায় আরো জটিল বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার তাগিদ ও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। সারা পৃথিবীতে উন্নয়নের নামে প্রকৃতি বিনাশ করার আয়োজন থেকে নই। করোনাকালে আমাদের নজরে এসেছিল বিমান, জাহাজ, কলকারখানা বন্ধ রাখার ফলে শব্দ দষণের মাত্র কতটা নিচে নেমে গিয়েছিল। পৃথিবীতে কম্পনের মাত্রাও অনেক কমে গিয়েছিল। গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ থাকার ফলে শব্দ ও আলোর ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবার ফলে বনের প্রাণীরা নির্ভয়ে লোকালয়ে এসে ভীড় জমাচ্ছিল। করোনা ছড়িয়ে দিয়ে প্রকৃতি নিজে একটু জিরিয়ে শান্তির নি:শ্বাস নিতে চেয়েছিল মনে হয়।
কিন্তু মানুষ নাছোড়বান্দা। দীর্ঘ প্রচেষ্টা চালিয়ে মরণব্যাধি করোন বিকাশ রুখে দিয়েছে। ডাব্লিউএইচও ইতোমধ্যে সারা পৃথিবী থেকে করোনার বিদায়ঘন্টার কথা ঘোষণা করে দিয়ে ভয় দূর করার বার্তা দিয়েছে।
কিন্তু মানুষের প্রকৃতি ধ্বংস কারার কর্মসূচি থেমে যায়নি। আমরা বিজ্ঞান ও নিত্যনতুন প্রযুক্তির জয়গান গাই প্রতিদিন। সাথে সমুদ্রে বিষাক্ত বর্জ্য নিক্ষেপের মাধ্যমে মারাত্মক দূষণ ছড়ানো, পাহাড় কাটা, নদীতে বাঁধ নির্মাণ, নদীদখল, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, নদী-খাল ভরাট, ব্রীজ নির্মাণ, অটোমোবাইল তৈরী, বন উজাড়, এমনকি রাস্তার পাশের ছায়াদানকারী গাছগুলো কেটে বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধি করে চলছি। যেগুলো প্রকৃতির অঙ্গচ্ছেদনের নামান্তর। আমরা একদিকে প্রকৃতি বিনাশ
করছি আবার অন্যদিকে প্রকৃতির দয়ার উপর ভরসা করে আমপাড়া, মাছের ডিমধরা ইত্যাদির জন্য ক্যালেন্ডার বানিয়ে অগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। আমাদের মধ্যে এমন বৈপরিত্য কেন?
তার প্রধান কারণ মানুষের চরম সীমাবদ্ধতা। মানুষ এখনও প্রকৃতির প্রতি অসহায়। এখনও মানুষ প্রকৃতির বহুদিক সম্পর্কে অজ্ঞ। এই অজ্ঞতার বহর অস্বীকার করে অনেক মানুষ নিজ জ্ঞানের বড়াই করে। মানুষ যখন তার নিজের বড় ছায়া দেখে নিজেকে অনেক বড় মনে করে তখন সে অনেক বড় ভুল করে। কারণ, সূর্য যখন হেলে পড়ে তখন সেই সূর্যের আলোতে মানুষের নিজের ছায়াকে বড় দেখা যায়। তাই মানুষ যখন নিজের জ্ঞানকে অনেক বড় ভেবে বড়াই করে, তখন বুঝে নিতে হয় যে তার জ্ঞান অস্তাচলের দিকে ধাবমান।
তাইতো, একজন রোগী সম্পর্কে অশিক্ষিত কবিরাজ বা হাতুড়ে ডাক্তার প্রথমেই যা বলেন সেটা একজন নামকরা, পাশকরা ডাক্তার রোগীকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা চরিত্র করার পর একবারে ঠেকে গেলে সেই একই কথা বলেন। আর তা হলো- আমার চেষ্টার আমি কোন ত্রুটি করিনি, এখন সৃষ্টিকর্তাকে ডাকুন!
এটাই প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। এটাকে কোনভাবে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবৃও কিছু মানুষ জ্ঞানপাপী হবার চেষ্টা করে। তারা প্রকৃতির উপর খবরদারী করতে গিয়ে সীমা লঙ্ঘণ করে বসে। এটা করতে গিয়ে তারা কোন কূল রক্ষা করতে না পেরে হতাশ হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়।
এজন্য আমাদেরকে ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে। মানুষ সারাবছর সবকিছুর স্বাদ আস্বাদন করতে আগ্রহী। তাই সবকিছুতে সবার মনে ‘বারোমাসী’প্রাপ্তির ধারণা উথলে উঠেছে।
সারাবছরব্যাপী সবকিছু পেতে চাই, খেতে চাই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এটা আমাদেরকে শিক্ষাদান করছে। গ্রাফটিং করে একই গাছে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা ফলাচ্ছি। একই সব্জির গাছে ডালে বেগুন, টমেটো, মাটির নিচে আলু ফলাতে চেষ্টা করছি।
বহুদিন আগে রেডিওতে একটি গান শুনেছিলাম, ‘শুনেন ভাই নতুন সমাচার, ইন্জেকশন দিয়া মাছের বাচ্চা ফুটায় চমৎকার!’
ইন্জেকশন দিয়ে কৃত্রিমভাবে মা-বাবা মাছের পেটের ডিম ও স্পার্ম পাড়িয়ে একত্রে মিশিয়ে পোনা তৈরী করে মাছের অভাব পূরণ করে চলেছি। সবই তো সম্ভব করা হচ্ছে! তাহলে হালদা নদীর পাড়ে মা রুই-কাতলাদের আগমন ও ডিম পাড়ার দিনক্ষণ নিয়ে এত হতাশা দিয়ে সময় ক্ষেপণ করছি কেন?
তার কারণ হলো কিছু মানুষ সবসময় প্রকৃতি বিনাশ করবে। আর কিছু মানুষ সেটাকে রক্ষা করার জন্য জীবনভর কান্নাকাটি করবে, সংগ্রাম করবে, গবেষণা করবে। এটাই হলো ডেরিল মেসারের কথা- ‘বায়োএথিকস্- দ্য লাভ অব লাইফ’। প্রকৃত বা আসলের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শণ করা- এক শ্রেণির মানুষের প্রাকৃতিক বা জন্মগত বৈশিষ্ট্য।
আরেক শ্রেণির মানুষ রযেছে তারা প্লাস-মাইনাস থিওরিতে বিশ্বাস করে। সকালে পাপ করে, বিকেলে পাপ খন্ডনের জন্য পরিতাপ করে। তারা চোরকে চুরি করতে বলে আবার গিরিকে সাবধান হতে বলে। পৃথিবীতে এদের সংখ্যা অনেক বেশি। এজন্য হয়তো পৃথিবীটা প্লেটোর কল্পনার স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেনা। এজন্য দ্বিবিধ ভূমিকা বা মানব মনের অস্থিরতাকে দোষারোপ করা যেতে পারে।
তবে এ কেমন অস্থিরতা বা বৈপরিত্য আমাদের মেজাজে মননে? আসলে বৈপরিত্যটা হলো আমাদের জিহ্বায়, আমাদের রুচিতে। প্রকৃতি বা আসল বা দেশীটা পরিবর্তন করে দিয়েছি নিজের প্রয়োজনের তাগিদে। দেশীটা ধ্বংস হয়ে গেছে। সবকিছু এখন কৃত্রিম। তবুও বাজারে গিয়ে খুঁজি দেশী মুরগি, দেশী খাসী, দেশী কৈ, নদীর পাবদা। আর বলি, আগের সেই স্বাদ কোথায় হারিয়ে গেল? অপরের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়ে খাবার টেবিলে ব্রয়লার, হাইব্রিড দেখলে নাক সিটকাই!
প্রকৃতির উপর মানুষের ক্রমাগত সীমাবদ্ধতার জন্য সব জায়গায় দ্বন্দ্ব নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে যেতে হচ্ছে। তাই উপযুক্ত গবেষণা না করে শুধু ক্ষুদ্র পর্যবেক্ষণ দিয়ে আম পাড়ার দিনক্ষণ দিয়ে ক্যালেন্ডার বানানো হচ্ছে ও মাছের ডিম ছাড়ার জন্য হালদা তীরে অপেক্ষা করার কথা বলা হচ্ছে। এসব ভবিষ্যতবাণীতে আমরা বিফল হয়ে যাচ্ছি। তাই শুধুমাত্র পরিবর্তিত প্রকৃতির উপর ভরসা করে বানানো লগ্নসূচির উপর নির্ভর না করে আরো গভীর গবেষণা নির্ভর তথ্য পাবার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালানোর বিকল্প নেই।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd
সাম্প্রতিক মন্তব্য