logo
news image

এক্সপ্রেস ও হাইওয়েতে সেকেলে প্রযুক্তির যান

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
ফিবছর ঈদের আগে অতিপুরাতন গাড়ি-লঞ্চের দেহে রং মেখে রাস্তায় নামানোর হিড়িক পড়ে যায়। এবছর এই প্রবণতা আরো বেশী লক্ষ্যণীয় হয়ে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। আধুনিকায়নের মাধ্যমে দেশের জাতীয় রাস্তাগুলো সচল করা হচ্ছে। কিন্তু সেসব রাস্তায় রং লাগানো গাড়ি ছাড়াও চলছে নতুন গাড়ির আবরণে অতি সেকেলে প্রযুক্তির দ্রুতযান। তাই প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। কোন কোন দুর্ঘটনা নিষ্ঠুর বার্তা নিয়ে হাজির হয়, বাড়ে মৃত্যুর মিছিল। তখন সবার টনক নড়লেও দুদিন বাদে কর্তৃপক্ষ সেসব নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চায় না।
গতমাসে পদ্মা সেতুর পশ্চিমে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে সকাল ৮ টায় এক মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। খুলনা থেকে ঢাকাগামী একটি বাস কতুবপুরের নিকট রাস্তা থেকে ডিগবাজি খেয়ে দেড়শ’ফুট নিচে পড়ে যায় এবং আন্ডারপাস সেতুর সংগে ধাক্কায় দুমড়ে যায়। এতে ১৯ জন যাত্রী মারা যান। এই বাসটি ফিটনেসবিহীন এবং সেকেলে প্রযুক্তির। এছাড়া সারা দেশের নতুন আধুনিক রাস্তায় চলাচল করছে প্রতিবেশী দেশের সেকেলে প্রযুক্তির তিনচাকার ভুটভুটি, ট্রাক, বাস, জীপ (চাঁন্দের গাড়ি) ইত্যাদি। এক্সপ্রেসওয়েতে অতি দ্রুতগতিতে চলতে গিয়ে এসব গাড়ি প্রায়শ:ই বিকল হয়ে যাত্রীদের কষ্ট বাড়ায়। সড়কে প্রতিদিনের খারাপ খবরের সাথে এসব মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কারণ নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে।
একটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে শুরুতেই তার কারণ হিসেবে নানা কথা শোনা যায়। দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। অনেক সময় তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না। যে সব তদন্ত রিপোর্ট বের হয় সেসব রিপোর্টে কি ফলাফল বের হয়ে আসে অনেকসময় জনগণ সেটা জানতে পারে না। 
তবে কতগুলো সাধারণ কারণ যেমন- চাকা ফুটে গেছে, স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেলে অন্য গাড়ি পিছন থেকে ধাক্কা দিয়েছে, ব্রেক ফেল করেছে, ড্রাইভার মাতাল ছিল বা ঘুমিয়ে পড়েছিল, অতিরিক্ত যাত্রী, ইঞ্জিনে আগুন, রাস্তা খারাপ, গাড়ি থামিয়ে জোর করে ঘুস বা চাঁদা আদায় বা কাউকে ‘খুশি’করতে হবে এই ভয়ে পিকআপ বাড়িয়ে পালানো ইত্যাদি প্রায়শ:ই শোনা যায়। তবে আজকাল লংরুটে বিরতিহীন ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও ড্রাইভারদের ক্লান্তি ও ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে গাড়ি চালানো একটি বড় কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। 
আগেকার দিনে উত্তরবঙ্গ বা দক্ষিণবঙ্গের লংরুটের চালকরা ফেরীতে উঠে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে বা বিশ্রাম করে নিত। এখন ব্রীজ হবার ফলে চালকরা বেশী আয়ের আশায় ওভারটাইম চালিয়ে বার বার ট্রিপ মারে। বিশ্রাম নেবার সময় পায় না বা নিতে চায় না। কয়েকমাস আগে একটি এ্যাম্বুলেন্স দুর্ঘটনায় রোগীসহ একই পরিবারের ৬ জন মারা গিয়েছিলেন। সেই ড্রাইভার গত ৪৮ ঘন্টা কোন বিশ্রাম নেবার ফুরসৎ পাননি। শিবচরের বাস দুর্ঘটনায় বাসের চালক একটানা ৩০ ঘন্টা বাস চালিয়ে ক্লান্ত ও ঘুম চোখে গাড়ি চালাচ্ছিলেন।
আজকাল দিন বদলের হাওয়া পরিবহন ব্যবস্থাকে ব্যস্ত করে তুলেছে। আর মানুষকে করে তুলেছে মহাব্যস্ত, বিচলিত ও অসহিষ্ণু। ফলে দৈহিক অসুস্থতার পাশাপাশি মানসিক যাতনা বেড়ে গেছে। সেসব মানসিক অস্থিরতা নিয়ে বহু চালক গাড়ি চালিয়ে মোবাইল ফোনের যথেচ্ছ ব্যবহার করতে করতে ব্যবসায়িক, পারিবারিক কথা, রাগ, উষ্মা, ঝগড়াসহ কানে ফোন চালু রেখে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দ্রুতবেগে চলতে থাকে, ঘটায় মারাত্মক দুর্ঘটনা। তাই চলন্ত গাড়িতে বা গণপরিবহনে চালকের জন্য মোবাইল ফোনে কথা বলা নিষিদ্ধ করতে হবে। তাছাড়া অনেক যাত্রী গণপরিবহণে চলাচলের সময় অতি উচ্চস্বরে মোবাইল ফোনে কথা বলতে থাকেন। যা পাশের জনকে কষ্ট দেয়, সবাইকে বিরক্ত করে। এজন্য গণপরিবহনে চলাচলের সময় যাত্রীসাধারণকে সবার কথা মনে রেখে কথা বলার সময় হেডফোন ব্যবহার করা উচিত। জনকল্যাণে এই নির্দেশনা প্রতিটি বাসের ও ট্রেনের টিকিটের মধ্যে লিখিত থাকা উচিত। কন্ডাকটরের মাধ্যমে গণপরিবহনে একথা এনাউন্স করে সব যাত্রীকে সজাগ করে দিতে হবে।
বিরতিহীনভাবে ক্লান্ত দেহমন নিয়ে ঘুম চোখে গাড়ি চালানো বড় অনৈতিক ও মারাত্মক ঝুঁকির ব্যাপার। ড্রাইভারের উপর মানসিক চাপ থাকলেও তারা রাস্তার রাজা। পেটে ক্ষুধা থাকলেও অনেক চালক খাদ্য না খেয়ে স্পিড, তাড়ি চোলাইমদ এমনকি কঠিন নেশাদ্রব্য গ্রহণ করে দ্রত গাড়ি চালাতে পছন্দ করে। তারা যাত্রীভর্তি গাড়ি নিয়ে রাস্তায় ফুটবল খেলার মতো উন্মত্ত আচরণ শুরু করে দেন। এদেশে দূরপাল্লার চালকদের দেহে মাদকাসক্তির উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য হাইওয়েতে অদ্যাবধি ডিটেক্টর মেশিন ব্যবহৃত হয় না।
একই গাড়ি অনবরত ব্যবহার করার ফলে গাড়ি চেকআপ ও রক্ষণাবেক্ষণ সুযোগ থাকে না। আমাদের দেশে পুরনো যানবাহনের অবসর নেয়ার কোন সিস্টেম নেই। কোন গাড়ির বয়স কত তা বোঝা মুষ্কিল। অনেক পুরনো গাড়িতে চেসিসের আসল নম্বর ঘষে মেজে তুলে নতুন করে খোদাই করে বসানো হয়। সব সময় গাড়ি অতি পুরাতন হলেও রং মেখে জোড়াতালি দিয়ে চালু করে রাস্তায় নামানো হয়। প্রতিবছর ঈদের সময় ঘনিয়ে এলে পুরাতন বাস, লঞ্চ, মাইক্রোবাস, চান্দের গাড়ি ইত্যাদিতে মেকআপ পরিয়ে রাস্তায় নামানো হেয়ে থাকে।
উন্নত বিশ্বে গাড়ির ফিটনেস কম্পিউটারাইজড্ সিস্টেমে ইস্যু করা হয়ে থাকে। কোন গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ শেষ হলে তা স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে স্ক্যানিং করে ফিটনেসের শর্ত পূরণ করলেই সেই গাড়িকে ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। কোন গাড়ি ফিটনেস পেতে যোগ্যতা হারালে সেটাকে ভাগাড়ে ডাম্পিং করা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর থাকে না। ডাম্পিং করার জন্য নির্দিষ্ট ফি পরিশোধ করে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে আসতে হয়।
অথচ, আমাদের দেশে এসবের বালাই নেই। আমরা মুখে বলি স্মার্ট সিস্টেম, কিন্তু কার্যত: গাড়ি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অতি প্রাচীন পদ্ধতি ব্যবহার করে কোন রকমে দায় সারছি। আমাদের রাস্তায় বহু গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই। এর পিছনে মারাত্মক অনিয়ম রয়েছে। যেসব অনিয়মের কারণ আমাদের দেশের সড়ক অব্যবস্থাপনা ও বিআরটিএ এবং সংশ্লিষ্ট অনেকের দুর্নীতি।
আরেকটি বিষয় হলো- আমাদের দেশে জাতীয় পর্যায়ের অনেক রাস্তাকে মোটাতাজা করে লেন বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু গতিনিয়ন্ত্রণ কেউ মানে না। ফলে উচ্চগতির ঝুঁকি শুরু হয়েছে। বিশেষ করে পুরাতন গাড়ি বা দুর্বল প্রযুক্তির তৈরী নতুন গাড়িগুলো ঝুঁকি নিয়ে গতিসীমা বাড়িয়ে চলতে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো সেকেলে প্রযুক্তির নতুন গাড়ি তৈরী করে কম দামে বিক্রি করে। সেসব গাড়ি দেখতে চকচকে ও নতুন মডেলের বলা হলেও সেগুলোর স্থায়ীত্ব ও নিরাপত্তা কম। কিছু কোম্পানি ২০ বছরের আগেকার পুরাতন প্রযুক্তি দিয়ে নতুন ইঞ্জিন তৈরী করছে। 
অথচ উন্নত কোন দেশের পুরাতন গাড়িতে আধুনিক প্রযুক্তি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকায় উন্নত দেশ থেকে আমদানীকৃত পুরাতন গাড়িগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার হার কম। শিবচরের দুর্ঘটনা কবলিত বাসটির কোম্পানি যারা সাধারণত: ভারী ট্রাক তৈরী করে। এসব গাড়িকে বাস হিসেবে উচ্চগতিতে চালানোর ক্ষেত্রে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কারণ, একই সংগে রাস্তায় ইউরোপীয়, জাপান বা কোরীয় গাড়ির সংগে পাল্লা দিয়ে রাস্তা পাড়ি দেবার সময় সেসব দুর্বল প্রযুক্তির গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত হবার ঝুঁকি বেশী হতে পারে।  
তাই হাইওয়েতে অতি পুরাতন গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে এবং পাশাপাশি দুর্বল প্রযুক্তি সম্পন্ন অখ্যাত গাড়ি আমদানী নিষিদ্ধ করতে হবে। তা-না হলে দুর্ঘটনা বাড়ার পাশাপাশি স্বল্পদিন পরেই সেসব দুর্বল গাড়ির অকেজো অবয়ব ডাম্পিং করার ক্ষেত্রে জটিলতা ও আমাদের পরিবেশগত মহাসমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
এসব কোম্পানির কিছু বাসকে হাইওয়ে ছাড়াও রাজধানীতেই দড়ি বাঁধা বাম্পার নিয়ে চলাচল করতে দেখা যায়, কেউ বিকট শব্দ করে, কেউ ভকভক করে অনবরত কালো ধোঁয়া নির্গত করে দৌড়ায় যা খুবই দৃষ্টিকটু। 
আমরা আধুনিক চার লেনের রাস্তায় কম্পিউটার প্রযুক্তি সম্বলিত উন্নত গণপরিবহণ দেখতে চাই। আমাদের দেশে প্রচলিত সড়ক ব্যবস্থাপনায় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ বা কমানো খুব কঠিন। দুর্ঘটনা ঘটলে সব দোষ ড্রাইভার ও হেল্পারের উপর চাপিয়ে দেবার কৃষ্টিও বন্ধ করতে হবে। 
আমাদের প্রতিটি গাড়ির জন্য স্বয়ংক্রিয় ফিটনেস প্রদানের সিস্টেম চালু করলে বিআরটিএ-তে যেমন ঘুস দিতে হবেনা তেমনি হাইওয়ে পুলিশকে খুশি করার অবৈধ নিয়ম বন্ধ হবে। এছাড়া সড়কে শৃংখলা ফেরাতে বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগ, পরিবহন মালিক, শ্রমিক, যাত্রী সকলের মধ্যে একটি কার্যকরী ইকো-সিস্টেম বা সহনীয় ব্যবস্থার নীতি গ্রহণ করতে হবে। আধুনিক প্রশস্থ রাস্তায় সেকেলে প্রযুক্তির যানবাহন, ঢুলুঢুলু চোখের ক্লান্ত চালক ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার অনৈতিক বলয় চালু থাকলে সড়ক দুর্ঘটনা কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। 

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top