logo
news image

অক্সফোর্ডের গবেষক লালপুরের মোস্তফা কামাল সরকার

অক্সফোর্ডের গবেষক লালপুরের মোস্তফা কামাল সরকার
নিজস্ব প্রতিবেদক।
নাটোরের লালপুর উপজেলার কুজিপুকুর গ্রামের মোস্তফা কামাল সরকার । অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে এসে সফলতার ছোঁয়া পেয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) এই শিক্ষার্থী। বর্তমানে তিনি বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যলয়ে সিনিয়র সহযোগী গবেষক হিসেবে কর্মরত। পাশাপাশি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন বায়োমেডিক্যালে। যা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) দিয়ে ক্যান্সার ও অন্যান্য জটিল রোগ নির্ণয় করে আর্লি ডায়াগনসিসে দ্রুত চিকিৎসা নিয়ে নিরাময় সম্ভব।
নাটোরের লালপুর উপজেলার কুজিপুকুর গ্রামে ১৯৮৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন মোস্তফা কামাল সরকার। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আবদুল আজিজ সরকার, দুয়ারিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও মা রিজিয়া বেগম। তিনি ৯ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট। পরিবারের একজন ডাক্তার, দুইজন সরকারী কর্মকর্তা, আর তিনজন পিএইচডি সম্পন্ন করে দেশের বাইরে কর্মরত। ভাইদের মধ্যে প্রথমজন ডা. মো.  আব্দুল মতিন সরকার (এমবিবিএস, পিজিডি মেডিসিন ও হার্ট স্পেশালিস্ট), দ্বিতীয়জন মো. আব্দুল আলীম সরকার (ট্রাফিক পুলিশ ইন্সপেক্টর, রাজশাহী), তৃতীয়জন ড. মো. আব্দুল লতিফ সরকার (রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্স প্রফেসর, কিউংপুক ন্যাশনাল  ইউনিভার্সিটি, সাউথ কোরিয়া), চতুর্থজন মো. মোস্তফা জামান সরকার (সহকারী কৃষি কর্মকর্তা, নাটোর), পঞ্চমজন ড. মো. ওমর ফারুক সরকার (সফটওয়্যার  ডেভেলপমেন্ট কনসালটেন্ট, আমাজন, লন্ডন, যুক্তরাজ্য) এবং ষষ্ঠজন ড. মো. মোস্তফা কামাল সরকার (সিনিয়র রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য) কর্মরত আছেন।
সরকার মোস্তফা কামাল শাবিপ্রবির ২০০২-২০০৩ সেশনে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সবচেয়ে বেশি সময় কেটেছে সড়ক আল্পনা, গান-বাজনা, কনসার্ট ও ব্যাকস্টেজ ম্যানেজমেন্টের কাজে। পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতিতে (ছাত্রলীগ) সক্রিয় ছিলেন। তাতে একাডেমিক ক্যারিয়ারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে স্বল্প সিজিপিএ নিয়ে ২০০৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েছেন। তাই পরবর্তীতে মাস্টার্স করা সম্ভব হয়নি।
উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ব্রত থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একগাদা হতাশা নিয়ে পাস করে বের হন। পরে টেকনিক্যাল অফিসার হিসেবে রেডিও ফুর্তিতে যোগ দেন। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ২০১১ সালে কোরিয়ার চোনবুক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সে কম্পিউটার ভিশন ও মেশিন লার্নিং বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পান। তখন থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সেখানে মাস্টার্স শেষে স্পেনের ইউনিভার্সিটি অব রোভিরি আই ভার্জিলিতে পিএইচডি সম্পন্ন (বেস্ট পিএইচডি অ্যাওয়ার্ডসহ) করেন।
পরে স্পেনের ইউনিভার্সিটি অব বার্সেলোনা থেকে পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রি শেষ করেন। সেখান থেকে লন্ডনের কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজের সুযোগ পান। এরই মধ্যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে ডাক পান।
মোস্তফা কামাল সরকার বলেন, অক্সফোর্ডে রিসার্চ ফেলো হওয়ার আগে এ সফলতার কথা কখনো চিন্তা করেননি। আগে দুইটা ইন্টারভিউতে রিজেক্টেড হয়েছেন। তবে সরাসরি সিনিয়র পজিশনে চান্স পাওয়ার অনুভূতিটা অন্যরকম, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ছোটবেলায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বইয়ে পড়েছেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হওয়া অনেক আনন্দের। এখানে অনেক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে। কেউ এখানে আসতে চাইলে তাদের গবেষণার কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, অক্সফোর্ডে রিসার্চ ফেলোশিপের জন্য প্রতি বছর তাদের ওয়েবসাইটে সার্কুলার হয়। সেখানে প্রার্থীরা যোগ্যতা অনুযায়ী অনলাইনে আবেদন করেন। আবেদনপত্র যাচাই শেষে ভাইভার জন্য ডাকা হয়। ভাইভা বোর্ডে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এবং এইচআর-রা থাকেন। সেখানে রিসার্চ সম্পর্কে দশ মিনিট উপস্থাপনা করতে হয়। এরপর বিশ মিনিটের মতো প্রশ্ন-উত্তর করা হয়। সবকিছু শেষ হলে চূড়ান্তভাবে একজনকে নির্বাচিত করা হয়। তিনিও এই নিয়মের মধ্যদিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তবে এই জার্নিটা মোটেও সহজ ছিলো না। এখানে আসতে পরিশ্রম আর গবেষণার কোনো বিকল্প নেই।
বর্তমান গবেষণা সম্পর্কে তিনি বলেন, বর্তমানে তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেল দিয়ে ইকোকার্ডিওগ্রাফিতে নবজাতকের জন্মগত হার্টের ত্রুটি শনাক্তকরণের ওপর গবেষণা করছেন। যার মাধ্যমে অনেক মানুষের জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করছেন। এর আগে ব্রেস্ট ক্যান্সার, স্কিন ক্যান্সার, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কোলন ক্যান্সার নির্ণয়, আন্ডার ওয়াটার রোবটিক্স অ্যান্ড কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করার কথা জানান তিনি। সে গবেষণাপত্র বিশ্বখ্যাত আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়।
তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আগামীর সময়টা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) কিংবা গণিত-পরিসংখ্যানের যুগ। যারা এসব আয়ত্ত করবে, তারাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গভীরে প্রবেশ করতে পারবে। তখন শুধু অক্সফোর্ড না, এমআইটি, হাভার্ডের মতো জায়গাতেও গবেষণা করার সুযোগ পাওয়া যাবে।
উত্তরসূরীদের পরামর্শ দিয়ে তরুণ এই গবেষক বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী হতাশায় ভোগেন। তারা যদি নিজের সাবজেক্টের বাইরে গিয়ে নিজেদের আনন্দ খুঁজে নেয়, তখন ভালো কিছু করার সুযোগ আসবে। হয়তো সিজিপিএ কমে যাবে, তবে এ অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে তাকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। ফলে আর হতাশাও কাজ করবে না। তিনি পড়েছেন ফিজিক্স (পদার্থ বিজ্ঞান) নিয়ে, তবে ভালো লাগতো কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, যা তাঁকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স শিখতে সহায়তা করে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে মোস্তফা কামাল বলেন, তিনি যেহেতু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ক্যান্সার এবং অন্যান্য জটিল রোগ আর্লি ডায়াগনসিসে রিসার্চ করছেন, তাই পরবর্তী পরিকল্পনা এ গবেষণা যেন আমাদের দেশের কাজে লাগে। সুযোগ পেলেই তা বাস্তবায়ন করবেন। আমাদের হেলথ সিস্টেমকে গতিশীল করতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বিকল্প নেই। সারা পৃথিবীতে এটার বিপ্লব চলছে, তাই সত্যিকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য এ পথেই হাঁটতে হবে।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top