logo
news image

৯ মাসে সড়কে ঝরেছে ১৮ প্রাণ

আনোয়ারা খাতুন শেফালী।।
নাটোরের লালপুরে একের পর এক সড়কে ঝরছে প্রাণ। গত বছর ৭ জুন থেকে চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৯ মাসে ২১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ জন নিহত এবং ৩০জন আহত হয়েছে। এতে রাস্তায় চলাচলে চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। বাড়ি থেকে বের হয়ে আবার বাড়ি ফিরে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।
বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) সরেজমিন উপজেলা বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার প্রধান সড়কগুলে সম্প্রতি সংস্কার করা হয়েছে। এতে সড়কে যানবাহনের গতি বেড়েছে। আর উপজেলা জুড়ে পাওয়ারট্রলি, বালু, মাটি ও ইট পরিবহন ট্রলি এবং ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা, চার্জার ভ্যান, ইজিবাইক নামক অবৈধ যানবাহনের অবাধ চলাচল রয়েছে। যেখানে-সেখানে পার্কিং করায় যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। আর কৃষকদের কৃষিজমির মাটি ইটভাটায় সরবরাহ, বিভিন্ন এলাকা থেকে গাছের খড়ি (জ্বালানি) ইট ভাটায় পরিবহনে বেপরোয়া গতি পথচারীদের ঝুঁকি ও রাস্তারও ক্ষতি করছে। এসব অবৈধ যানবহনের চালকদের বেশির ভাগই অদক্ষ, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও কিশোর বয়সী হওয়ায় সড়ক দুর্ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য, হাসপাল, থানা ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ট্রাক্টর দুর্ঘটনা ৩টিতে নিহত ৪ জন ও আহত ২ জন। ট্রাক্টর-অটোরিক্সা ১টি সংঘর্ষে ২ জন নিহত ও ৪ জন আহত হন। পাওয়ার ট্রলি-সিএনজির ২টি সংঘর্ষে ২ জন নিহত ও ৪ জন আহত হন। অটোরিক্সা-মোটরসাইকেল ৫টি সংঘর্ষে নিহত ১ জন ও আহত ১০ জন। মোটরসাইকেলের ৪টি দুর্ঘটনায় নিহত ১ ও আহত  ৭ জন। বাস ও মোটরসাইকেল সংঘর্ষে ১টি দুর্ঘটনায় ৩ জন নিহত হন। বালুবাহী ট্রাকের চাপায় ৫ জন নিহত ও আহত ৩ জন।
তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ একদিনে চারটি দুর্ঘটনায় ৩ জন নিহত আর ৩ আহত হন। উপজেলার আজিমনগর রেলস্টেশন (গোপালপুর), মোহরকয়া, বাশবাড়িয়া ও লক্ষ্মীপুর এলাকায় দুর্ঘটনায় উপজেলার মহিষাখোলা গ্রামের মৃত সোবহানের স্ত্রী রাবেয়া বেগম (৯০), মোহরকয়া গ্রামের আজিত মোল্লার ছেলে ট্রাক্টরের সহকারী চালক (হেলপার) ফরহাদ আলী (১৫) ও হাসবাড়ীয়া গ্রামের গ্রামের বাবলু হোসেনের স্ত্রী সম্মাতুল বেগম (৪০)। আহত হন, মাধবপুরের ফারুকের স্ত্রী বিউটি (৩০), তার মেয়ে দৃষ্টি (৫) ও কুষ্টিয়া সদরের আলাউদ্দিনের ছেলে আজিম (৫০)।
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ রাতে লালপুর কলেজ মোড়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২জন আহত হন। তারা হলেন, চালক উত্তর লালপুর গ্রামের মো. জুয়েলের ছেলে মো. আপন (১৫) ও চকজোতদৈবকি গ্রামের মৃত ফকির প্রাংয়ের ছেলে জামাত আলী (৬৫)।
২৭ জানুয়ারি ২০২৩ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ওয়ালিয়ায় ২ জন আহত হন।
২৪ জানুয়ারি ২০২৩ সড়ক চকনাজিরপুর বটতলায় ট্রাক্টর চাপায় ১ জন নিহত। নিহত রাহি (৬) ওই গ্রামের সবজি বিক্রেতা মো. শরিফুল ইসলামের একমাত্র ছেলে।
২৩ জানুয়ারি ২০২৩ সাঁইপাড়ায় অটো ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৪ জন আহত।
২২ জানুয়ারি ২০২৩ লালপুর-ওয়ালিয়া সড়কের গোপালপুর গরুহাটা এলাকায় ইটবোঝাই ইঞ্জিন চালিত কুত্তাগাড়ির সঙ্গে যাত্রীবাহি সিএনজির মুখোমুখি সংঘর্ষে ১ জন নিহত ও ৪ জন আহত হন। নিহত আমিরুল সরকার (৩৫) বড়াইগ্রাম উপজেলার আঠুয়া হারুয়া গ্রামের মৃত আবেদ সরকারের ছেলে।
৩ জানুয়ারি ২০২৩ রাতে উপজেলার লালপুর-ঈশ্বরদী সড়কের নুরুল্লাপুর জামে মসজিদের সামনে আখ বোঝাই ট্রাক্টর (লরি) ও অটোরিক্সার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে ১ জন নিহত ও ৪ জন আহত হন। নিহত হন পাবনার ঈশ্বরদীর পূর্ব নূর মহল্লা বস্তিপাড়ার মো. কাদের আলীর ছেলে শরিফ (২২)। আহত হন, উপজেলার মনিহারপুর গ্রামের মৃত শাহবাজ আলীর স্ত্রী তহমিনা বেগম (৪০), বাগাতিপাড়ার দয়ারামপুরের শ্রী দীপেনের ছেলে শ্রী দেবাশীষ (৫২), ঈশ্বরদীর শৈলপাড়ার আজম আলীর স্ত্রী বেদনা বেগম (৫০) ও আজম আলীর মেয়ে আফরোজা খাতুন (৩০)।
৩১ ডিসেম্বর ২০২২ উপজেলার সালামপুর-কচুয়া রাস্তায় ২ জন আহত হন।
৩০ নভেম্বর ২০২২ উপজেলার লালপুর-গোপালপুর সড়কের নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস হাইস্কুলের সামনে দুই মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে ৩ জন আহত হন। তারা হলেন, উপজেলা আইসিটি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামসহ (৩৫), রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আলাইপুর গ্রামের আহাদ আলীর ছেলে সান্টু (৫০) ও তাঁর ৫ বছর বয়সী নাতি।
২৭ ডিসেম্বর ২০২২ উপজেলার প্রাণিসম্পদ হাসপাতালের সামনে পাট বোঝায় ট্রাক উল্টে ২ জন আহত হন।
২১ নভেম্বর ২০২২ উপজেলার ভূইয়াপাড়া নামক স্থানে ১ জন নিহত।
২০ নভেম্বর ২০২২ উপজেলার বাকনাই নামক স্থানে ২ জন আহত।
১৮ নভেম্বর ২০২২ উপজেলার ডেবরপাড়া নামক স্থানে বাস ও মোটরসাইকেল সংঘর্ষে ৩ জন নিহত হন। তারা হলেন, উপজেলার বিরোপাড়া গ্রামের নুর মোহাম্মদের ছেলে মো. শহিদুল ইসলাম (৫০), তাঁর ছেলে মো. সোহাগ (২৭) ও নাতি ইভান (৪)।
২০ অক্টোবর ২০২২ ডেবরপাড়া পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের নিকট বালুবাহী ট্রাকের চাপায় ১ জন নিহত হয়। সে উপজেলার উত্তর লালপুর গ্রামের মো. শামসুল আরেফিনের ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র সালমান সাদিক রাফি (১৪)।
৯ জুলাই ২০২২ মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ট্রাকের চাপায় ২ জন নিহত হন। নিহতরা হলেন আড়বাব ইউনিয়নের কেশভবাড়িয়া গ্রামের হায়দার আলীর ছেলে হাফিজুর রহমান ও সেকেন্দার আলীর ছেলে আরিফুল ইসলাম।
৭ জুলাই ২০২২ গৌরীপুর নামক স্থানে অটোচার্জারের ধাক্কায় পালিদেহা হিন্দুপাড়া গ্রামের মনি হালদারের স্ত্রী প্রবি রানী (৬০) নিহত হন।
৩ জুলাই ২০২২ চংধুপইল ইউনিয়নের চাঁনপুর কামার দোহা এলাকায় মাটি বোঝাই ট্রাক্টর উল্টে ১ জন নিহত ও ২ জন আহত হন। নিহত হন রামানন্দপুর গ্রামের ফজলুর রহমানের ছেলে হেলপার মো. আওলাদ হোসেন (১৮)। আহত হন রামানন্দপুর গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে হারুন (১৮)। অপরজন বালিতিতা ইসলামপুর গ্রামের রঞ্জিতের ছেলে মো. রয়েল (৩৫)।
৭ জুন ২০২২ কদিমচিলান ইউনিয়নের ক্লিকমোড় নামক স্থানে বাস ও পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২জন নিহত হন। নিহতরা হলেন পিকআপের চালক টাঙ্গাইল সদরের বিল গারিন্দা গ্রামের মো. রমজান আলীর ছেলে আপন মিয়া (২০) ও হেলপার বাশাইল পশ্চিমপাড়া গ্রামের হাজি মঞ্জুর ছেলে মোয়াজ্জেম হোসেন (৩০)।
এ বিষয়ে পৌরসভার বিরোপাড়া মহল্লার গৃহিনী মদিনা খাতুন বলেন, গত বছর ১৮ নভেম্বর ডেবরপাড়া নামক স্থানে বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী পরিবারের তিনজনের মৃত্যু হয়। একমাত্র শিশু সন্তান ইভান (৪), স্বামী ট্রাক্টরের মিস্ত্রি মো. সোহাগ আলী (২৭) ও শ্বশুর শহিদুল ইসলাম (৫০) মারা যান। সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর একমাত্র সন্তান বুক খালি করে চলে গেছে। বেপরো যানবাহন চালকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।
নিরাপদ সড়ক চাই লালপুর উপজেলা শাখার সভাপতি এ এম রায়হান বলেন, একদিকে চালকরা সড়কে গতি মানছেন না। অন্যদিকে সড়কে অবৈধ যানবাহনের দৌরাত্ম দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফিটনেস বিহীন যানবাহন,  অপ্রাপ্তবয়স্ক ও লাইসেন্স বিহীন চালক, চালকদের অদক্ষতা, রাস্তায় খড়ি-আখের ছোবড়া শোকানো, ত্রুটিপূর্ণ রাস্তা ও সড়ক আইন না মানা আর জনসাধারণের অসচেতনতার কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনা রোধে সরকার, চালক, যাত্রী ও পথচারী সবাইকে সতর্ক ও সচেতন হয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
লালপুর ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মো. এমদাদুল হক ইন্তাজ বলেন, উপজেলার সড়কগুলো মেরামত-সংস্কার করায় বিভিন্ন যানবাহন অনিয়ন্ত্রিত চলাচল করছে। আইন মেনে চালকরা গাড়ি চালান না।  যার ফলে দুর্ঘটনার সাথে সাথে সড়কে মৃত্যু ও আহতের হার বেড়ে গেছে।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক শফিউল আলম মিশন বলেন, রাস্তা দুই ধারে জঙ্গলের কারণে পার্শ্ব রাস্তা থেকে প্রধান সড়কগুলোতে উঠতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ক্ষেত্রে পথচারী ও যানবাহনের চালকদের সতর্ক হতে হবে।
লালপুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনমাস্টার সাব্বির আহমেদ বলেন, উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে গেছে। এ ব্যাপারে পথচারী ও যানবাহন চালকদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহা. মোনোয়ারুজ্জামান বলেন, রাস্তার দুই ধারে সড়ক ও জনপথের বড় বড় গাছ চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। গাছের ডালপালা সড়কের ওপর চলে আসায় দুর্ঘটনা এড়াতে একে বেঁকে চলতে হয়। যার ফলে অনেক ক্ষেত্রে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে।
লালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামীমা সুলতানা বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সচেতনতা ও সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা জরুরি। অপ্রাপ্তবয়স্ক ও লাইসেন্স বিহীন চালক, গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ ও সড়ক আইন নিশ্চিত করতে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।
৫৮ নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বকুল বলেন,  লালপুর উপজেলায় বানেশ্বর-সারদা-চারঘাট-নাটোরের লালপুর-পাবনার ঈশ্বরদী পর্যন্ত (জেড-৬০০৬) সড়কটি জেলা মহাসড়ক হতে আঞ্চলিক মহাসড়কের মানে ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণের মাধ্যমে ৪ লেনের আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণ ছাড়াও ৮০ কিলো মিটার পাকা সড়ক, ৯০ কিলোমিটার পাকা সড়ক সংস্কার, ৪০ কিলোমিটার এইচবিবি সড়ক ও ২৫টি কালভার্ট/ব্রিজ নিমাণ কাজ হয়েছে। বাগাতিপাড়ায় ৮০ কিলো মিটার পাকা সড়ক, ৫০ কিলোমিটার পাকা সড়ক সংস্কার, ৫০ কিলোমিটার এইচবিবি সড়ক ও বড়াল নদীর ওপর নতুন ব্রিজ নির্মাণসহ ১০টি কালভার্ট/ব্রিজ নিমাণ কাজ হয়েছে। রাস্তা ভাল হওয়ায় দুর্ঘটনা রাড়ছে। নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তায় চালক ও পথচারীদের সচেতন হতে হবে।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top