logo
news image

চাকুরীর বাজারে অচল শিক্ষা

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
অবাধ তথ্য প্রবাহ ও মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে আমাদের দেশের শতকরা ৭১ ভাগ শিক্ষার্থীর পড়াশুনার খরচের যোগান দেন তাদের অভিাবকরা। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে এই হার অনেক অভিাবককে অসহায় করে তোলে। কারণ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেলে শতকরা ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী বাড়ি ছেড়ে হোষ্টেলে গিয়ে প্রতিমাসে অভিভাবকের পাঠানো টাকার জন্যে হা করে চেয়ে থাকে। অভিভাবকের উপর নির্ভরশীল এসব শিক্ষার্থীরা অনেকেই বর্তমান চাকুরীর বাজারে অচল উচ্চশিক্ষা গ্রহণে রত। অথচ আমাদের দেশীয় চাকুরীর বাজারে হাজার হাজার টেকনিক্যাল পদ দখল করে আছে ভারত, চীনসহ নানা দেশের নাগরিকরা। সেকথা আমাদের শিক্ষার্থী বা অভিভাবকগণ অনেকেই ভালভাবে জানেন না।
নির্ভরশীল এসব শিক্ষার্থীরা পাশ করার পর প্রায় সবাই শহরে থাকতে পছন্দ করে। বড় চাকুরী পেতে চায়। অনেকে গ্রামে ফেরত যেতে অনীহ। এমনকি অনেকেই ভাল চাকুরী পেলেও রাজধানী ঢাকা অথবা বিভাগীয় শহরের বাইরে সে চাকুরী করতে যেতে চায় না। কেউ কেউ একবার শহরে এসে আর গ্রামের বাড়ির দিকে ফিরে তাকাতে চায় না। কারণ, আমাদের দেশে গ্রাম ও শহরের নাগরিক সুবিধাদির মধ্যে বিস্তর ফাঁরাক বিদ্যমান। এই ফাঁরাক দিন দিন আরো বেশী ঘণীভূত হচ্ছে। এখনও উচ্চশিক্ষা হোক বা বড় কোন রোগের চিকিৎসার প্রয়োজন হোক বা কোন চাকুরীর ইন্টারভিউ হোক, ঢাকা শহরে না গেলে তার উপায় বা বিকল্প কোনটাই নেই। একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে, বিয়ের শাাড়ি-গহনা কিনতে বা হাইকোর্টে মামলার হাজিরা দিতেও ঢাকায় আসতে হয়। মার্কেটের ছাদে গড়ে উঠেছে প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয় ও সেগুলোর আবাসিক হল। এভাবে ঢাকা হয়েছে জনবহুল, গাড়িবহুল, শব্দবহুল, দূষণবহুল, মশকবহুল, জলজট-যানজটে নাকাল বিশে^র ১নং বসবাসের অনুপোযুগী শহর।
এ থেকে পরিত্রাণের চেষ্টার কমতি নেই। খরচেরও কমতি নেই। আর তাতে এটি হয়ে উঠছে দালান ও  উড়াল সড়কের কংক্রীটের এক ভয়াবহ বস্তি। একটি দালান কাত হয়ে গেলে বা বহুতলে আগুন লাগলে একটি রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তার উপর আরো ভারী স্থাপনা নির্মাণের মহাপরিকল্পনা আমাদেরকে কোন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে সেদিকে কর্র্তৃপক্ষের নজরদারী আছে বলে মনে হয় না। ক’ছর আগে জাকার্তা অথবা জাপানের কোবে  শহরের ভুমিকম্পে একটি কংক্রীটের উড়াল রাস্তা উল্টে বিপর্যয়ের কথা কারো কি মনে পড়ে না?
সেগুলো মানবতার বিপর্যয়ের জন্য কিছু উদাহরণের শিক্ষা বই বেশী কিছু নয়। তাই বিলিয়ন টাকা খরচ করে ঢাকাকে আর বেশী ভারাক্রান্ত না করে জাপানের মতো পরিবহন ব্যবস্থা করে সকল জেলা শহরের সাথে দ্রুতগামী শিঙ্কানসেন বা বুলেট ট্রেনের মাধ্যমে আমাদের জেলাগুলোর সংগে কানেকটিভিটি বাড়ানোর জন্য মেগা প্রকল্প দ্রুত হাতে নেয়া দরকার। তাহলে সময় বেঁচে যাবে, দেশের উন্নয়নে ভারসাম্য আসবে এবং সবকুল রক্ষা হবে।
এজন্য আমাদের জ্ঞানের লেভেল কোথায় থাকা উচিত এবং সেটা কিভাবে অর্জিত হবে তা নিয়ে চিন্তা করা উচিত। তা-না করে আমাদের রাজনীতিবিদগণ একদল ছাত্রদের দিয়ে অপর ছাত্রদলের মারাকাটা অবস্থা তৈরী করে ক্লাস-পড়াশুনা থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছেন। রাস্তার কোণায় তাদেরকে পরস্পরের সহিংস কাজের পাহারায় বসিয়ে রেখে মারামারি করার পরিবেশ তৈরী করে দিচ্ছেন। তাদের মারমুখী অবস্থাসৃষ্ট পরিস্থিতি পাহারা দেবার জন্য দিনরাত আইনশৃংখলা বাহিনীকে ব্যবহার করছেন। এত ঘন ঘন লক্ষ মানুষের এতবেশী জনসভা পাহারা দেয়া-পুলিশের এটাই কি মূল কাজ? তাহলে একটি গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশ সাধারণ জনগণের সেবা দিবে কখন?
আমাদের উচ্চশিক্ষায় এসে এক শ্রেণির তরুণরা চরম হতাশ। তাদেরকে অচল শিক্ষায় দীক্ষা গ্রহণের সুযোগ দিয়ে মূলত: ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টকে অপব্যবহার করা হচ্ছে। এসব তরুণরা সবাই নেতা হতে চায়। ক’দিন আগে এক জনসভামঞ্চ উল্টে গিয়ে সেখানকার প্রধান অতিথি আক্ষেপ করে বলেছিলেন কিছু আবেগভরা কথা। যেখানে বেশী সংখ্যক নেতার নেতাগিরি করার ইচ্ছার দৈন্যতাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
মনে পড়ে, প্রায় ত্রিশ বছর আগে জাপানের এক ল্যাবে বসে সেদিনের জাতীয় নির্বাচনে সেখানকার শিক্ষার্থী বন্ধুদেরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আজ তোমাদের ভোট হচ্ছে -তোমরা ভোট দিতে যাবে না? তারা আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে অনেকটা অনীহ ছিল। একজন উত্তরে বলেছিল, আমাদের দেশে নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এত আগ্রহ নেই। সাড়ে পাঁচ বছর সময়ে সেখানে আমি দেখিনি কোন মাইকিং, কোন জটলা বা কোন বৃহৎ জনসভা। শিক্ষার্থীরা কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য কি-না সেটা তাদের কথা বা আচরণে বুঝার উপায় নেই। রাজনীতির কারণে তারা নিজেদের পড়াশুনা ও ক্লাস ফাঁকি দিতে পারে না।
শুধু একদিন এজন প্রার্থী তাঁর একজন সংগীকে সাথে নিয়ে বাসার দরজায় এসে ডাকবাক্সে একটি ছোট্ট লিফলেট দিয়ে গেছেন। সেটাও নি:শব্দে! আরেকদিন একজন প্রার্থী গেটের সামনে হ্যান্ডশেক করেছিলেন। তাঁর হাতে সাদা গ্লাভস্ পরা ছিল। তারা আমাদের মতো চেহারার বিদেশীদের স্বকীয় কালচার বুঝেন। সেজন্য হ্যান্ডশেক করেন। কিন্তু সেই প্রার্থী যেহেতেু সেদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন সেহেতু তার হাত থেকে কোন সংক্রমণ যেন ভোটারদের শরীরে না ছোঁয়-সেজন্য প্যাকেট থেকে নতুন ওয়ানটাইম গ্লাভস পরে নিয়েছিলেন! সেটা করোনার বহু আগের কথা। যারা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন না তাদের জন্য ডাকযোগে আগেই ভোট দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। আমাদের দেশের মত ভোট নিয়ে ওদের প্রার্থী বা ভোটার কারো মধ্যে এত মাতামাতি বা উত্তেজনা ছিল না।
পিএইচডির আগে পরিবেশ বিজ্ঞানে মাস্টার্সের ছাত্র থাকাকালীণ লক্ষ্য করতাম আমার কিছু ক্লাসমেট অনেকটা অগোছালোভাবে দ্রুতগতিতে ক্লাসে ঢুকতো। লেকচার শুনতে শুনতে কেউ কেউ ঘুমিয়ে যেত। কিন্তু শিক্ষক তাদেরকে কিছুই বলতেন না। একদিন লাঞ্চের সময় ক্লাশে ঘুমানো এক বন্ধুকে বললাম, তুম মাঝে মাঝে ক্লাশে ঘুমাও, রাতে ঘুম হয়না নাকি?
সে উত্তরে বলেছিল, বন্ধু তুমি তো স্কলারশীপ পাও সেজন্য বিষয়টা বুঝবে না। আমার জমানো টাকা দিয়ে সেমিষ্টার ফি দিয়েছি। আগামী সেমিষ্টার ফি দিতে হবে তাই আমাকে রাতে কাজ করতে হয়। আমার বাবা-মা অথবা অবিভাবকরা কোন টাকা দেয় না। ওদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা পরিবার থেকে টাকা নিতে লজ্জাবোধ করে। তারা সাধারণত: নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে। বেশীরভাগ শিক্ষার্থী আন্ডারগ্রাজুয়েট শেষ করে চাকুরী করে টাকা জমায়। তারপর অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দুই বছরের মাস্টার্স পড়ে। ওদের দেশে সবাই মাস্টার্স পড়তে যায় না। শুধু যাদের চাকুরীক্ষেত্রে প্রয়োজন অথবা একান্ত ইচ্ছে তারাই বড় ডিগ্রী করে।
অথচ আমাদের দেশে উল্টো। এখানে আন্ডারগ্রাজুয়েট শেষ করে চাকুরী নেই। তাই বসে না থেকে বেশীরভাগ শিক্ষার্থী মাস্টার্স পড়ে। মেয়েদেরকে ঘরে বসে না রেখে পড়ানো হয়। সেটা প্রয়োজন হোক বা না হোক। ছেলেদের ক্ষেত্রে সমাজে এখনও এমএ পাশ জামাইয়ের ব্যাপক কদর।
আরেকটি বিষয় হলো- এখানে একবছরের গবেষণাবিহীন টট্ কোর্সের মাস্টার্স ডিগ্রীর প্রচলন থাকা। গবেষণাসহ কমপক্ষে দুই বছরের মাস্টার্স ডিগ্রী কোর্স প্রচলিত নয় আমাদের দেশের বেশীরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। আমাদের কলেজগুলোতে অবস্থা আরো খারাপ। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য সেখানে সিনিয়র ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের বড় অভাব।
এভাবে চাকুরীর বাজারে অচল ও অসম্পূর্ণ শিক্ষায় দীক্ষা দিচ্ছি আমরা। কিছু কিছু বিষয়ে পড়ানা হয় যেগুলোর জ্ঞান চাকুরীর বাজারে কাজে লাগে না। অধিকাংশ সরকারী কলেজে সেইসব বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশী। তাদেরকে গবেষণার জন্য ল্যাবে আসতে হয়না। এমনকি পরীক্ষা প্রদানের শর্তের জন্য ক্লাশে উপস্থিতির দরকারও হয় না।
একজন চাকুরীদাতা সেদিন বড় আক্ষেপ করে বলেছেন, ধরুন আমি আমার আর্থিক প্রতিষ্ঠানে একটি বড় পদের জন্য দরখাস্ত আহব্বান করেছি। দেখা গেছে সেখানকার আবেদনকারীদের ৮০ ভাগ এই জবের জন্য একাডেমিক ফিট করে না।
তিনি আরো বললেন, ধরুন মাগরিবের নামাজের জন্য চারজন উপস্থিত হয়েছেন। একজনকে ইমামাতি করতে দায়িত্ব দিতে হবে। সেখানে যদি একজন অংকের, একজন বাংলার, একজন আরবীর ও একজন রসায়নের ডিগ্রীধারী হন তাহলে ইমামতির ভার কাকে দিলে যৌক্তিক হবে বলে মনে করেন? নিশ্চয়ই আরবীতে ডিগ্রী থাকা ব্যক্তির জন্য ইমমিতি করতে দেয়াটা সঠিক হবে।
তিনি বলতে লাগলেন, ‘তেমনি আজকাল চাকুরীর ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে এমন বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছি আমরা। আরেকটি বিষয় হলো- কোন কোন ক্ষেত্রে এমন প্রার্থী চাকুরীতে যোগদান করতে আসেন যিনি কোথাও কোন লিখিত বা মৌখিক কোন পরীক্ষাই দেননি। অথচ তার হাতে নিয়োগপত্র। এরা স্বজন বা মহারথীদের সুপারিশে নিয়োগপত্র পাওয়া প্রার্থী। তারা একাডেমিক অযোগ্যতা নিয়েও যোগদান করেন এবং অফিস ও প্রতিষ্ঠানের অনেক ক্ষতি সাধন করেন। এক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এসব আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এতকিছু দেখে বলা যেতে পারে আমাদের দেশে চাকুরীর বাজারে অচল শিক্ষা ও দীক্ষার ব্যাপক প্রচলণ দেশের সুস্থ ভবিষ্যৎকে গহীন অন্ধকারে তলিয়ে দিচ্ছে। ওপেন সিক্রেট এসব বিষয় কাউকে বলার উপায় নেই- আপনাকে শুধু বললাম।’
এত জটিল বক্তব্য শুনে মনে মনে ভাবলাম- আমরা কি পড়াই আর ওরা কি পড়ে। আমরা কি বলি আর ওরা কি অনুশীলন করতে বাধ্য হয়। আমরা শ্রেণিকক্ষে শুধু তত্ত্বীয় জ্ঞান দিই। আর চারদিকে প্রচলিত নিষ্ঠুর বাস্তবতায় এই জটিল পরিবেশ ওদেরকে চাকুরী পাবার ভাবনা অস্থির করে তোলে। বিসিএসে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ররা পুলিশ হবার জন্য ১ নম্বর পছন্দ দেয় কেন- সেটাও গভীর চিন্তার বিষয়। কারণ, ফাইন্যান্স ও ব্যাংকিং পাশ করে কেউ তো ডাক্তার হতে ১ নম্বর বা শেষ পছন্দক্রমও দিতে পারে না! ভাবলাম চাকুরীর বাজারে অচল শিক্ষা ও রুটি-রুজি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এই দৃশ্যমান অচলায়তন ভাঙ্গবে কবে, কিভাবে?

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top