প্রাথমিকে এক শিফটে পাঠদানের এপিঠ ওপিঠ
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
আমাদের দেশে ৬৫ হাজারেরও বেশী প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। যেগুলোর অল্পসংখ্যকে এক শিফট এবং বাকী সিংহভাগে দুই শিফটে পাঠদান করা হয়ে থাকে। গত ৪ জানুয়ারী প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পলিসি এন্ড অপারেশনস্ এর এক চিঠিতে দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক শিফটে পাঠদান করার নতুন নিয়ম চালু করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- যেসব বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ আছে সেগুলোতে এক শিফটে পাঠদান সম্পন্ন করতে হবে।
জানা গেছে, ‘এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা হলো সর্বচ্চো এক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত দুটি স্কুলে দুইভাগ করে একটি শিফ্টে পাঠদান করা। এক্ষেত্রে প্রাক্-প্রাথমিক ও ২য় শ্রেণিকে একভাগ করে একটি বিদ্যালয়ে এবং অন্যটিতে তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।’ বেশীরভাগ স্কুলে দুই শিফট চালু থাকায় এক শিফটের স্কুলে শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভ চলে আসছিল। তারা এক শিফট চালুর দাবী করে আসছিলেন।
বিষয়টি ২০২২ সালের অক্টোবর মাস থেকে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়ে আসছিল। তখন ভাবা হয়েছিল যে জানুয়ারী ০২, ২০২৩ সাল থেকে সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এক শিফটে পাঠদান চালু করা হবে। কিন্তু তা হয়ে উঠেনি। জানুয়ারী ০৪ তারিখে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের জারি করা নির্দেশ সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়গুলোতে পৌঁছানো হয়েছে। নতুন বছরের দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও দুই শিফট চালু থাকা বিদ্যালয়গুলোতে এখনও এক শিফট চালু করা সম্ভব হয়ে উঠেনি।
এক শিফট চালু করার বিষয়ে অনেকদিন ধরে মত বিনিময়ের মাধ্যমে নানা সুবিধা-অসুবিধার দিকগুলো খতিয়ে দেখার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। এক শিফট চালু করার পেছনে যে দিকটি বড় তা হলো পাঠদানের সময় বাড়ানো এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য সময় বাঁচানো। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জানিয়েছিলেন, ক্লাসে পড়ানোর সময় বাড়াতে এ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা আশা করছি, আগামী জানুয়ারি থেকে এটা করতে পারব। পুরোটা না করলেও অনেকটাই করতে পারব। তিনি আরো মত দেন, “ডাবল শিফট হওয়ায় সময়টা কম থাকে। সেজন্যই এক শিফটে যাচ্ছি। তাতে ৩ ঘণ্টার জায়গায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পড়ানো যাবে ক্লাসে।”
এছাড়া বর্তমানে ক্লাসরুম সংকট একটি মারাত্মক সমস্যা। অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে যেগুলোতে প্রয়োজনীয় শ্রেণিকক্ষ নেই। অবকাঠামোগত সুবিধার অভাবে অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা গাছতলায় বসে পড়াশুনা করে। আবার অনেক বিদ্যালয় আছে যেগুলোতে শ্রেণিকক্ষ পর্যাপ্ত কিন্তু শিক্ষার্থী সংখ্যা কম। কোথাও কোথাও এক কিলোমিটারের মধ্যে দুইটি অথবা তিনটি বিদ্যালয় রয়েছে কিন্তু সবগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ না থাকায় বৈষম্য তৈরী হয়ে রয়েছে। একই এলাকায় সরকারী বিদ্যালয়ের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সুযোগ সুবিধা থাকা উচিত নয়। এতে পাঠদানে বিশৃংখলা তৈরী হয় ও প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট হয়ে যায়।
এক তথ্যে জানা যায়, ‘‘দেশে বর্তমানে ১৪ হাজার ৮৮৪টি সরকারি স্কুলে ৭টি বা তার বেশি শ্রেণি কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে ১০ হাজার ৯১৫টি বিদ্যালয়ে ডাবল শিফট চালু রয়েছে। ডাবল শিফট চলছে, কিন্তু শিক্ষার্থী সংখ্যা কম এমন বিদ্যালয় রয়েছে ১৩ হাজার ৮০৯টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৪৮টি বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ রয়েছে ৭টি বা তার বেশি। তিন থেকে ৬টি শ্রেণিকক্ষ রয়েছে এমন বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯ হাজার ৯৯৫টি। আর ৬৩৩টি বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ রয়েছে দুই বা তারও কম।” এসব তথ্য একদিকে এলাকা ও বিদ্যালয় ভেদে সুবিধার কথা বলে আবার অন্যদিকে চরম শিক্ষাবঞ্চনার চিত্র নির্দেশ করে।
কারণ যেসব বিদ্যালয়ে মাত্র ১টি বা দুটি শ্রেণিকক্ষ এবং একজন বা দু’জন শিক্ষক রয়েছেন সেখানে একসংগে ৫টি শ্রেণিকে মানসম্মত পাঠদান শুধু শিক্ষাবঞ্চনাই নয় বরং এই ডিজিটাল তথ্যপ্রবাহের যুগে খুবই হাস্যকর এবং অবহেলাকে নির্দেশ করে। তাইতো এটা বর্তমানে আলোচিত স্মার্ট কথাবার্তার মধ্যে একটি আনস্মার্ট বিষয়ে রূপ নিয়েছে। এ বিষয়টি অনেক আগেই মতামতে উঠে এসেছিল। বলা হয়েছে, ‘২ রুমে তো ক্লাস চালানো কোনোভাবে সম্ভব না। রাতারাতি ভবনও নির্মাণ করতে পারব না। সেজন্য ছাত্র, শিক্ষক সংখ্যা বিবেচনা করে দেশের সব স্কুলকে এক শিফটে আনার পরিকল্পনা করেছি। প্রায় ৯০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।’
আরো ভাবা হয়েছিল, ‘কোনো স্কুলই বন্ধ হচ্ছে না, শিক্ষক চাকরি হারাচ্ছে না- সবই ঠিক থাকছে। কিন্তু আমরা কাজটাকে ভাগ করছি। দুই কক্ষ আছে, সেখানে প্রাক- প্রাথমিক, প্রাথমিক থাকবে- ক্লাস ওয়ান। আবার খুবই নিকটে অন্য কোন স্কুল আছে, সেখানে আমরা করব। যেখানে ভবনের সুযোগ আছে, ভবন করব।’ আলেচনায় আরো উঠে এসেছিল- “পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে- গ্রাম, শহর, যাতায়াতের বিষয় আছে। সুবিধা-অসুবিধা দেখা হচ্ছে। তবে সারাদেশে একই সময়ে স্কুল চালু ও শেষ করতে পারলে আমার মনে হয় ভালো হয়। আমরা দেখছি।” তবে একটি শিফটের পক্ষে এসব মতামত বেশ ভাল বিষয়।
বিশেষ করে একটি বিদ্যালয়ে শিশু ও ২য় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যদি তাদের ৩,৪,৫ শ্রেণির সিনিয়র ভাই-বোনদের সাক্ষাৎ না পায়, ভাবের আদান-প্রদান না হয় তাহলে আন্তরিকতা, আন্ত:পারিবেশিক ও পারস্পরিক যাগাযোগ, বড়দের পরামর্শলাভ, ছোটদের প্রতি স্নেহ-মমতা ইত্যাদি শিখবে বা গড়ে উঠবে কিভাবে? এছাড়া বাচ্চাদের মধ্যে কুশল, খেলাধূলা, ডিবেট, সাংস্কৃতিক দক্ষতাবিনিময়, সাহস ও পরিচিতি গড়ে উঠবে কিভাবে?
অনেক পরিবার আছে যাদের বড় ছেলে ক্লাসফাইভে পড়ে আর ছোট বোনটি ক্লাস ওয়ানে পড়ে কিন্তু শিফট আলাদা হওয়ায় একসংগে স্কুলে যাতায়ত করতে পারে না। এত অভিভাবকের সময় নষ্ট হয় ও খরচ বেড়ে যায়। এক শিফট চালু হলে এসব পরিবারের অনেক উপকার হতে পারে।
এসব নানা চিন্তাভাবনা থেকে সারা দেশে সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক শিফটে পাঠদানের বিষয়টি বাস্তবে রূপদানের জন্য নির্দেশনা হিসেবে ইতোমধ্যে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে চলে গেছে।
তবে আরো কিছু বিষয় ভাবনার মধ্যে আনা দরকার ছিল বলে বিশ্লেষকগণ মনে করছেন। এক শিফটে পড়ানোর জন্য অনেক বেশী শিক্ষক একসাথে প্রয়োজন। যদিও নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ৩০ হাজার শিক্ষককে নির্বাচন করা হয়েছে কিন্তু তারা এখনও নিয়োগপত্র হাতে পাননি। তারা নিয়োগপত্র হাতে পেয়ে কাজে যোগদান এবং তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ব্যাতিরেকে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান শুরু করা যথাযথ হবে না। অথচ জানুয়ারী ২০২৩ থেকে এক শিফট চালু করার কথা চাউর হয়ে তার নির্দেশনা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে। এতদিন অনেক স্কুলে শিক্ষকের অভাবে দপ্তরি, আয়া, নাটগার্ডকে ক্লাস নেয়ার কথা শোনা গেছে।
জানুয়ারী ১২, ২০২৩ তারিখে হবিগঞ্জের পিটিআই ভবন সংলগ্ন পিটিআই পরীক্ষণ বিদ্যালয়ে অবিভাবক অলিকা দাশের ছবিসহ তানজিনা আক্তার ও আরো পাঁচজন ভবিভাবকের ক্লাস নেবার সংবাদ একটি দৈনিকের প্রথম পাতায় ছাপানো হয়েছে। জেলা শহরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র যদি এমন হয় তাহলে রিমোট পল্লী এলাকার বিদ্যালয়গুলোর সার্বিক চিত্র কেমন হতে পারে তা বলাই বাহুল্য। কারণ সব জায়গার এসব তথ্য গণমাধ্যমে আসার সুযোগ নেই।
কিন্তু মাঠপর্যায়ে সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিস ও প্রধান শিক্ষকগণ এখনও অন্ধকারে রয়েছেন। তারা মনে করছেন, ‘টপ-টু-বটম পলিসি’ নির্দেশনা বিষয়টি খুব দ্রুত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু অনেক বিদ্যালয় ও তাদের কর্মপরিবেশ এখনও প্রস্তুত হয়নি। অনেকে ক্ষোভের সাথে বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ে না এসে বাস্তবতা নিরীক্ষা না করে ঢাকা থেকে নির্দেশনা দেয়া অতি সহজ কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে।’ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ভিন্ন ক্ষেত্র থেকে হঠাৎ লিয়েনে আসা বড় কর্তাগণ অনেক সময় নিচের খবর সম্পর্কে অজ্ঞ থাকেন। অনেক বাস্তবতায় মাঠপর্যায়ে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগহীনতা বিদ্যমান। তাই বাস্তব পরিস্থিতি ওয়াকেবহাল না থাকায় এ নিয়ে এলাকা ভেদে নানা অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে।
তাছাড়া কেউ কেউ ভাবছেন, এক শিফটে গিয়ে শিক্ষকগণ বেশী সময় হাতে পলে পেলে আবারো কোচিং ও প্রাইভেট প্রাক্টিস শুরু করে দিতে পারেন। যেটা তাদেরকে শ্রেণিকক্ষ থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে পারে। আশঙ্কা করা হচ্ছে কোন বিদ্যালয়ে রুম না থাকলে এবং শিক্ষক উপস্থিত থাকলেও সে সময় ক্লাস অনুষ্ঠিত না হবার ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেদেরে মধ্যে চেঁচামেচি ও মারামারি করে সময় নষ্ট করতে পারে।
একটি শিফটের পাঠদানে ১ম ও ২য় শ্রেণির বাচ্চাদের একটানা চারঘন্টা ক্লাস অনুষ্ঠিত হবে। নতুন রুটিনে তাদের টিফিন বিরতি নেই। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সকাল ৯.০০-৯.৩০টায় দৈনিক সমাবেশ শেষ করে ৯.৩০ থেকে ১২.৫০মি: পর্যন্ত প্রতিটি ৫০মিনিট করে চারটি ক্লাসে মোট ২৩০মিনিট বিরতিহীনভাবে দৈনিক সমাবেশ ও এতগুলো ক্লাস করবে কিভাবে?
যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একসংগে এত ক্লাস করতে চায় না বা পারে না সেখানে বাচ্চাদের উপর এটা চাপানো ঠিক নয়। এছাড়া নানা সুবিধা, দূরত্ব, প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে দুটি স্কুলের মধ্যে শ্রেণিবিভাজনের ক্ষেত্রে প্রাক্-প্রাথমিকের ক্লাস একটি স্কুলে এবং ৩য় ও ৫ম শ্রেণির ক্লাস আরেকটি স্কুলে নেবার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। যা সুষ্ঠু নিরুপণ করা সরেজমিনে বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই শুরু না হতেই এর বাস্তবতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এক শিফট চালু করার প্রক্রিয়াটি।
তাইতো বিভিন্ন শিক্ষাগবেষকগণ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানালেও প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষক ও অভিাবকগণ এটা ‘বাস্তবসম্মত নয়’বলে অভিমত জানিয়েছেন (বিবিসি নিউজ বাংলা ১২.০১.২০২৩)।
যেহেতু মাঠপর্যায়ে এর কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি সেহেতু এভাবেই আপাতত:এক শিফটে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানের নির্দেশনার এপিঠ ও ওপিঠ পর্যালোচনা করা যেতে পারে। তবে চালু করার নির্দেশনা দেবার আগে এটা নিয়ে মাঠপর্যায়ে গভীর জরিপ করে আরো বেশী ঘনশ্রম দেবার প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয়।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd
সাম্প্রতিক মন্তব্য