সাগরডুবি ছাড়িয়ে করোতোয়ার অশ্রুধারা
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
নানা কৌশলে বিদেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে প্রতিবছর বেশ কয়েকবার সাগরডুবিতে আমাদের সম্ভাবনাময় তরুণদের সলিল সমাধি ঘটে। জাভা সমুদ্র ও ভূমধ্যসাগর দিয়ে বিদেশ যেতে অবৈধ অভিবাসীপ্রত্যাসীরা কাঠের বা রাবারের বোটে ভাসতে ভাসতে নিজেদের স্বপ্নসাধকে সাগরের নীল পানিতে বিসর্জন দেন। এসব সংবাদ প্রায়শই: আমরা টিভিতে দেখে আফসোস করি। আর ওদের দালাল ও অভিভাবকদেরকে দোষারোপ করে নিজেদের ক্ষোভ মিটাই।
আমাদের দেশে পূর্বের হাওড় এলাকা ও দক্ষিণ বঙ্গের নদীপথে নৌ-দুর্ঘটনা নৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু উত্তরাঞ্চলের মরা-সরু নদী করোতোয়ায় হঠাৎ ছোট্ট একটি নৌকাডুবিতে এতগুলো প্রাণ নিভে যাবে সেটা হয়তো কারো কল্পনার মধ্যেই আসেনি। এমনকি করোতোয়াপাড়ের ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোও কখনো ভাবেনি এমন মর্মন্তুদ ঘটনা এই নদী পার হতে গিয়ে ঘটতে পারে। তাইতো ছোট্ট একটি শ্যালো ইঞ্জিনচালিত কাঠের নৌকায় নিদ্বিধায় উঠে পড়েছিল ধারণ ক্ষমতার তিনগুনেরও বেশী মানুষ। তারা আউলিয়াঘাট থেকে বদেশ^রী মন্দিরে মহালয়া অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। কাত হয়ে ডুবে যাওয়া নৌকা দুর্ঘটনায় ঘটনার পঞ্চমদিন পর্যন্ত উদ্ধারকর্মীরা মোট ৬৯ জনের লাশ খুঁজে পেয়েছেন।
প্রাণে বেঁচে যাওয়া সেই নৌকার একজন যাত্রীর বাড়ি মাড়েয়াহাট ইউনিয়নের বামনহাট এলাকায়। তিনি তার পাঁচ বন্ধু মিলে নৌকায় উঠেছিলেন। নৌকায় চড়ার পরপরই পানি উঠতে থাকে। তারা যে পাশের্^ যাচ্ছিলেন সে পার্শে^ই পানি উঠছিল। নৌকাটি ডুবে গেলে তারা পাঁচ বন্ধুই সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও সাঁতার না জানা যাত্রীরা পানিতে ডুবে যায়। নৌকাটিতে মহিলা ও শিশুর সংখ্যা বেশী ছিল। তারা এক অন্যকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
এখানকার করোতোয়া নদীতে বছরের আটমাস তেমন পানি থাকে না। গ্রীষ্মে কোথাও কোথাও হেঁটে পার হওয়া যায়। দুই তীরের জমিতে বোরোধান, কাউন, মিষ্টিআলু, তামাক, চিনাবাদামের চাষ হয়। খরা মৌসুমে বালু উত্তোলন চলে কোন কোন জায়গায়। উজনের ঢল এলে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পানির গভীরতা ও স্্েরাত থাকে। দুর্ঘটনার কিছুদিন আগে সীমান্তের ওপাড়ে উজানে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় স্রোতের কিছুটা তীব্রতা ছিল। কিন্তু সেটাতেই এমন মর্মান্তিক নৌডুবিতে এতগুলো প্রাণহানি ঘটবে তা ছিল খুবই অনাকাঙ্খিত।
এ ঘটনার কারণ উদ্ব্ঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তদন্তের মেয়াদ আরো তিনদিন বাড়ানো হয়েছে। তাঁরা দ্রুত ঘটনার আসল কারণ খুঁজে বের করবেন। তবে কিছু কথা বলার থেকে যায়।
দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে উত্তরবঙ্গের সীমান্ত জেলাগুলো যোগাযোগ অবকাঠামোর দিক দিয়ে খুবই অবহেলিত। শুধু যোগাযোগ নয়- উন্নয়ন অবকাঠামোর দিক দিয়ে এসব জেলা এখনো নানাভাবে আঞ্চলিক বৈষম্যের শিকার। যেখানে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্দুৎ থাকে না, কার্পেট উঠে যাওয়া ভাঙ্গাচোরা সরু রাস্তা, উন্নত চিকিৎসার সুযোগ নেই। দক্ষিণের জেলাগুলোতে নদীর উপর কিছুদূর পর পর ব্রীজ নির্মিত হলেও উত্তরের নদীগুলোতে তেমন ব্রীজ নির্মিত হয়নি। বিশেষ করে আউলিয়াঘটে একটি সংযোগ সেতু নির্মাণের দাবী বহুদিনের হলেও সেটাকে আমলে নেয়নি কেউই। এই ঘাটে সেতু না থাকায় মানুষ নিরুপায় হয়ে অতি পুরাতন শ্যালো ইঞ্জিনের লক্কর-ঝক্কর মার্কা ডিঙ্গি নৌকায় পারাপার হয়ে থাকে। বিশেষ করে বর্ষাকালে খুব ঝুঁকির মধ্যে মহিলা ও শিশুরা ধরলা, করোতোয়া, দুধকুমার, টাঙ্গন, আত্রাই, কাঁটাখালী প্রভৃতি নদী পাড়ি দেয়। তাই আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণে এসব নদীতে প্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ করা জরুরী।
যারা এসব নৌপথে নৌযান পরিচালনা করেন তারা ফিটনেসবিহীন সেচকার্যে ব্যবহৃত শ্যালো মেশিন, পাওয়ার ট্রিলার প্রভৃতির পুরাতন ইঞ্জিনকে নৌকা অথবা ভুটভুটিমার্কা গাড়িতে লাগিয়ে গণপরিবহণ বানিয়ে ব্যবসা করেন। এসব যানবাহন মহাসড়কে দূরপাল্লার গাড়ির সাথে চলতে গিয়ে মারাত্মক দূর্ঘটনা ঘটায়। আবার নদীপথে গতি বাড়িয়ে চলতে গিয়ে হঠাৎ দ্রুত ফেটে ডুবে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটায়। এসব যানবাহনে যারা চলাচল করে তাদেরকে নিরাপত্তা সামগ্রী সরবরাহ বা ব্যবহারের জন্য কোন নির্দেশনা দেয়া হয় না।
স্থানীয় সরকারী প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো জনসেবার এই জরুরী দিকগুলোকে সবসময় অবহেলার চোখে দেখে থাকেন। তাদরে চরম উদাসীনতা ও উপরি কামাই করার প্রচেষ্টা ফিটনেসবিহীন ও মানহীন, অবৈধ যানবাহন রাস্তা বা নদীতে চলাচলের জন্য অনুমতি পায়।
অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যেতে বা দালালের খপ্পরে পড়ে ট্যুরিষ্ট ভিসায় বেড়াতে লিবিয়া, তিউনিশিয়া, ইথিওপিয়া গিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাবার সময় অবৈধ ছোট্ট নৌযানে চড়ে সাগরডুবিতে প্রায়শই: মারা যাচ্ছে শত শত বাংলাদেশী তরুণ। দেশের সোনার ধানক্ষেতে কাজ না করে গ্রীস, ইটালেিত গিয়ে ভেড়া, ঘোড়ার পাল চরানো, পাসপোর্ট জমা দিয়ে ভাসমান শরণার্থী সেজে নামমাত্র মজুরীতে অর্ধাহারে, অনাহারে থেকে তাঁবুতে ঠান্ডার মধ্যে রাত্রিযাপন করতে গিয়ে অনেকে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। দেশে যাদের খবরও পৌঁছায় না, লাশও আনা যায় না।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলো পুলিশি নির্যাতন ও ঘুষ দেবার আতঙ্কে সেকথা কাউকে প্রকাশ করতে গিয়ে ভয় পায়। আর গোপনে ডুকরে ডুকরে কেঁদে-কেটে জীবন কাটায়। এরা অবৈধ শ্রমিক হলেও আমাদের ওয়েজ আর্ণারের একটি বড় অংশ। কিন্তু তাদের পরিবারগুলোর কান্নার রোল বেদনার বার্তা হয়ে আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়ালেও কোন সুরাহা করার পথ খুঁজে না পেয়ে বিধাতাকে স্বাক্ষী রেখে সান্তনার পথ খুঁজে একসময় নীরব ও বিলীণ হয়ে যায়। এটাই হাজার হাজার অবৈধ শ্রমিক ও তাদের দেশে ফেলে যাওয়া পরিবারগুলোর নিয়তি।
ইঞ্জিনচালিত নৌকায় দেশের গোটা নৌপথ ছেয়ে গেছে। অপরদিকে নদীপথে ঘন ঘন দুর্ঘটনার জন্য আহাজারিও বেড়ে গেছে। শৃংখলা নেই কোথাও। কেউ বলেছেন আমাদের অর্থনৈতিক অসম ট্রানজিশন এজন্য দায়ী। কারণ, এর সাথে নেতিবাচক সামাজিক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে মানুষ চরম সামাজির অস্থিরতা ও অসহিষ্ণুতার মধ্যে দিন গুজরান করে চলেছে। তাইতো কেউ কাউকে নিজের অভিপ্রায় শেয়ার করতে চায় না। করোতায়া পাড়ের দুর্ঘটনার পর এক শিক্ষিতা মেয়ে তারা বৃদ্ধ বাবার জন্য ডুঁকরে কেদে কেঁদে বলছিল- ‘বাবা তুমি যদি একবার আমাকে জানাতে যে ঐ ভরা নদী নৌকায় পাড়ি দিয়ে তুমি যাবে তাহলে আমি তোমাকে যেতে দিতাম না।’ বাবার যাত্রাপথের অনিরাপত্তার কথা ভেবে মেয়েটি হয়তো তার মনের আশঙ্কা প্রকাশ করছিল।
সারা বিশে^ নৌপথকে বলা হয় সস্তা ও নিরাপদ। কিন্তু বাংলাদেশে নৌপথই সবচেয়ে বেশী অনিরাপদ। মানুষ অস্থির ও অপরিণামদর্শীতার মধ্যে নিপতিত। তা-না হলে কি করে ২৫-৩০ জনের উপযোগী একটি পুরাতন ইঞ্জিনচালিত কাঠের নৌকায় শতাধিক মানুষ একসংগে উঠে পড়েছিল? যেখানে লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থা ছিল না। যেখানে কয়েক হাজার মানুষের পাশে তিনজন পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। ইউপি চেয়্যারম্যান ও অনেক অভিজ্ঞ মানুষ তীরে দাঁড়িয়ে নৌকাটিতে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করা অবলোকন করেছেন। তাদের নিশেধ অমান্য করে অথবা যাত্রীদের অনুরোধে ফলে মাঝি নৌকায় অতিরিক্ত যাত্রী তুলেছিল বলে কথা শোনা গেছে।
তবে একথা অনস্বীকার্য যে, আউলিয়াঘাটের করতোয়ায় নৌকাডুবি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে- বাংলাদেশের আঞ্চলিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য কতটুকু, মানুষ নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কতটুকু অসচেতন ও অপরিণামদর্শী, স্থানীয় জনসেবা ব্যবস্থাপনা কতটুকু হেঁয়ালীপূর্ণ, অদক্ষ ও অপ্রস্তুত এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা কতটুকু অনগ্রসর ইত্যাদি। এখন আমাদের সামনে এসব বিষয়ের আশু সমাধান করাটা কার কার দায়িত্বে বর্তায় বলে মনে হয়?
এসব ব্যাপারে যাদের আসল দায়িত্ব আছে বলে বর্তায় তারা সবাই এগিয়ে আসুন এবং দ্রুতলয়ে। তা-না হলে ভূমধ্যসাগরের সাগরডুবির শোক ছাড়িয়ে করোতোয়ার করুণ অশ্রুধারা অন্যান্য সাগর-নদী তীরে পূণর্বার বইতে থাকা বিচিত্র কিছু নয়।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd
সাম্প্রতিক মন্তব্য