logo
news image

মরণঘাতী মাদকের দৌড় আর কতদূর

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
‘কুশ’নামক নতুন মাদক বহুদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে এলেও এটি হঠাৎ করে খবরের শিরোনাম হয়েছে। এ ব্যাপারে সরব হয়ে উঠছে আমাদের গণমাধ্যমগুলো। বিদেশে পড়ুশুনা শেষ করে দেশে মাদক চাষ বা উৎপাদন ও ব্যবসার মাধ্যমে কারো আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করার প্রয়াস বা অপপ্রয়াস যাই বলি না কেন বিষয়টি বেশ কৌতুহলোদ্দীপক। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা শেষে একজন তরুণের মাদক উৎপাদন বিষয়ে ‘বিজ্ঞানী’ হবার খেতাব লাভ করাটাও অনেক বড় ব্যাপার।
অপরদিকে দেশের কূটনীতিকের বিদেশের চাকুরীস্থলের আবাসনে মাদক নিয়ে হেনস্থা হবার খবরটি খুব সুখকর নয়। বিদেশের মাটিতে বা কর্মস্থলে মাদক নিয়ে অভিযোগ উচ্চপদস্থ সরকারী দয়িত্বপালনকারীর জন্য তো শুধু নয়- দেশের মর্যাদার উপর কতখানি নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে তা গুরুত্ব দিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে।
আমাদের দেশের অভ্যন্তর জীবন বিনাশকারী মাদকেদ্রব্যের সহজলভ্য স্থান ও এটা একটি বৃহৎ বাজারে পরিণত হয়ে পড়েছে। দেল এখন মাদকের বিশ^বাজার বললেও অত্যুক্তি হবে না। কারণ, ঘরে মাদক, অলি-গলিতে একটু তাকালেই মাদকের পশরা নিয়ে ছুটে আসে নানা বয়সের নানা বেশের মাদকজীবি ও বিক্রেতারা। একটু ইশারা পেলেই তারা তৎপর হয়ে উঠে ভয়ংকর মাদকের বিকিকিনি করতে।
জানা গেছে মারিজুয়ানার উন্নত সংস্করণ কুশ। মারিজুয়ানা শ্রেণির সবচেয়ে নতুন প্রজাতি এই মাদক। ওনায়েসী সাঈদ নামক এক উচ্চশিক্ষিত যুবক তার রাজধানীর ভাড়া বাড়িতে কুশের আবাদ করে সফল হয়েছেন। মার্কিন মুল্লুকে পড়াশুনা করে এবং পরবর্তীতে মালয়েশিয়ায় এমবিএ শেষ করে ঢাকায় ফিরে তিনি ভাড়া বাসায় গ্রীণ হাউস তৈরী করে পরীক্ষামূলকভাবে কুশের চাষ শুরু করেন। চারটি ভিন্ন তাপমাত্রার গ্রীণহাউসে কুশ জন্মানো হয়। এর দাম খুব বেশী। প্রতি ১০০ গ্রাম কুশের দাম তিন লাখ টাকা। নিজের প্লান্টে তিনি ৩০০ গ্রাম কুশ উৎপাদন করেছেন। কুশ চাষে সফল হলে তিনি এর ব্যবসা শুরু করেন এবং নিজের তৈরী করা প্লান্ট বিক্রিও করে দেন।
এর ফাঁকে তিনি বিদেশ থেকে মাদক-কেনা বেচার কাজ করতে থাকেন। পার্শ্বেলের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য আমদানী কররেও তার ঘন ঘন বিদেশ সফরের লাগেজের মাধ্যমে তিনি দেশে আধুনিক, ভয়ংকর ও সবচেয়ে দামী মাদকগুলোকে টার্গেট করেছিলেন। ইতোমধ্যে তিনি বিশটি চালান দেশে  এনেছিলেন। কিন্তু দেশের বিমানবন্দরে তাকে কেউ সন্দেহ করেনি এবং আটকায়নি। বিদেশের এয়ারপোর্টে একবার আটকানো হয়েছিল। এতে তার অভিজ্ঞতা বেড়ে যায় ও বেশী করে অবৈধ আয়ের পথ প্রশস্থ হয়।
বিদেশ ভ্রমণের সময় প্রাণঘাতি ভয়ংকর মাদক এক্সটেসি, মলি, এডারল, হেম্প, ফেন্টানিল ইত্যাদি আমদানী করতেন তিনি। এগুলো তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় ও স্মার্ট মাদক হিসেবে পরিচিত। এগুলো দেখতে চকোলেট ও ক্যাপসুলের মতো। এসবের মূল উপাদান এমফিটামিন। এই মাদক বহন, সরবরাহ, ক্রয়, সেবন সবকিছুই অপেক্ষাকৃত সহজ।
তরুণরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে দালালদের নিকট থেকে এসব কেনার প্রলোভন পায়। প্রথমে সস্তাদাম পরে ক্রেতারা অনুরক্ত ও আসক্ত হয়ে পড়লে বিক্রেতারা মূল্য বাড়িয়ে দেন। অতি গোপনে নিজের লাগেজের মধ্যে লুকিয়ে এসব মাদক দেশে আনার পাশাপাশি পাশের্^ল দিয়ে আরো বেশী মাদক আমদানী করতেন। তবে মাদক আমদানির এই বিষয়টি এই তরুণ বিজ্ঞানী কাউকে জানাননি।
অপর আরেকটি বড় ঘটনা হলো- দেশের কূটনীতিকের বিদেশের চাকুরীস্থলের আবাসনে মাদক উদ্দার করা নিয়ে তোলপাড়। জাকার্তায় আমাদের একজন মহিলা কুটনীতিক তাঁর ভাড়া বাসা শেয়ার করতেন একজন ইন্দোনেশিয়ান নাগরিকের সাথে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চাকুরী করাকালীন পরিচয়ের সুবাদে তার সাথে বন্ধুত্ব তৈরী হয়। পরে জাকার্তায় বদলী হয়ে আসার পর সেই নাইজেরীয় নাগরিক জাকার্তায় ব্যবসা করার সুবিধা পান। সংবাদে জানা গেছে, তিনি সেখান থেকে সিঙ্গাপুর, লাওস, হ্যানয়, ব্যাংকক, কুয়ালালামপুর প্রভৃতি জায়গায় ব্যবসার জন্য যাতায়ত করতেন। তার সেই ব্যবসার আড়ালে আর্ন্তজাতিক মাদক ব্যবসায়ী চক্রের যোগসাজশ রয়েছে কি-না তা জানার জন্য সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। কেউ বলেছেন একজন কূটনীতিকের কিসের অভাব পড়েছে যে তাঁকে প্রটোকল ভেঙ্গে একজন ভিনদেশীর সাথে নিজের ভাড়া বাসা শেয়ার করতে হবে? তার বাসায় মাদকদ্রব্য রাখা –না রাখা নিয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে কেনই বা এতা শোরগোল শুনতে হবে?
একজন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাদক সম্পর্কিত এসব শোনা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য খুবই লজ্জাস্কর ও উদ্বেগজনক। পদ, পেশী এবং মেধাকে কাজে লাগিয়ে মাদক ব্যবসা ও ব্যবহারের দৌরাত্ম্য এতদূর গড়িয়েছে যে দেশের মাটি ছেড়ে এখন বিদেশের মাটিতে আমাদের দুর্ণাম কুড়াতে হচ্ছে।
মাদকদ্রব্যের এত ধরণ, এত রুপ এত বৈচিত্র্যময় এর ব্যবসায়িক কারবার তা সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিতে অনুমান করা সত্যিই কঠিন ব্যাপার। তাইতো মাদকের জন্য চরম মূল্য দিতে হচ্ছে মানব সভ্যতাকে।
মূল্যবান জ্ঞানকে কল্যাণকর কাজে লাগানো হচ্ছে না। ভাল জ্ঞান চলে যাচ্ছে লোভের শিকলে বন্দী হয়ে অন্ধকারের ঘুঁপচি গলির মধ্যে। আবার ক্ষমতা ও পদমর্যাদাকে সঠিক পথে পরিচালিত না করার ফলে সুপরিচিত ব্যক্তিদের পদমর্যাদা, মেধা, মননশীলতাকে জলাজলি দিতে হচ্ছে মাদকের মায়জালের ফ্রেমে। একজন উঠতি বিজ্ঞানী আর কোন কাজ পেল না আত্মকর্মসংস্থানের জন্য? একজন কূটনীতিকের নিজস্ব কর্মপরিবেশ ও পারিপাশি^কতা সম্পর্কে সজাগ থাকার ক্ষমতা কি লোপ পেয়ে গেল?
চারদিকে শুধু নৈতিকতার ধ্বস, শুধু অবক্ষয় কেন শুনতে হচ্ছে বার বার? তাদের মধ্যে এত অকল্যাণ করার ভাবনা কেন? সমাজের দামী মানুষগুলো অস্থির হয়ে উঠলে চলবে কি করে? সবার স্মৃতিভ্রমের মতো ঘটনার পিছনে মতিভ্রম ঘটতে থাকলে নিজের ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী কেউই কি দায়িত্ব পালন করতে পারবে না?
ক’দিন আগে মিথ্যা ঘোষণায় মদ আমদানী করার বিরাট চালান ধরা পড়েছে। এই ধরনের াবৈধ চালান নতুন কোন ঘটনা নয় বলে বলা হচ্ছে। যারা এর সাথে জড়িত তারা আমাদের সমাজের নামকরা ব্যবসায়ী। তাদের উঠা-বসা, চলন-ফিরন আরো বড় বড় লোকদের সাথে। যারা বড় বড় কাজের নীতিনির্ধারকের ভূমিকা পালন করে তাকে। কিন্তু কিসের আড়ালে এসব ঘৃণ্য ব্যবসায় দের অপকর্ম আড়ালে চলে যায়? সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
মাদকের সংস্পর্শে থাকা কথিত মাদকবিজ্ঞানী বা কূটনীতিক যেই হোন না কেন- সব ঘটনাই চরম ঘৃণার সংবাদ। এসব কিছুর সমাহারে প্রিয় বাংলাদেশ মাদকের বৃহৎ বাজারে পরিণত হয়েছে। এখানে দ্রুত টাকা বানানোর জন্য মাদকের ব্যবসা একটি অতি সহজ উপায় হয়ে পড়েছে। হয়তো সেজন্য সমাজের সকল স্তরের মানুষ নিজেরে অবস্থা, ব্যক্তিত্ব, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদার তোয়াক্কা না করে জড়িয়ে যাচ্ছে এই মাদক ব্যবসায়। মাদকের নিয়ন্ত্রণকারীরা একটু ঢিলেমি করলেই খুব সহজে লাভবান হতে পারে। তাই নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে ভয়ংকর মাদকের ব্যবসা ও এর অবাধ ব্যবহার। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণকারী, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা সবার নৈতিকতাকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন কর্মসূচি গ্রহণ না করলে এর সার্বিক প্রসার কমানো খুব দূরুহ।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top