অহংকার উপহাস ও কটুক্তি শুধুই ক্ষতিকর
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
প্রায় তিন যুগ আগের কথা। তখন সারা দেশের গ্রামে-গঞ্জে একটি জনপ্রিয় বচন ছড়িয়ে পড়েছিল। তা হলো, ‘মুই কি হনুরে, মোর বাড়িত কেনবা প্রত্যেক দিন মটর সাইকল আইসে’। এর অর্থ ছিল আমি হোমরা-চোমড়া কিছু একটা হয়ে গিয়েছি। তাই আমার বাড়িতে প্রতিদিন কোন ধনীলোক বাইক নিয়ে বেড়াতে আসে। হ্যাঁ, ৩০-৩৫ বছর পূর্বে হোন্ডার মালিকদের বেশ বিত্তশালী মনে করা হতো। সেসময় রাস্তায় মোটর বাইকের সংখ্যা খুব কম ছিল। সেসব বাইকের শব্দ বেশী হতো। শব্দ শুনলেই মানুষ তাকাতো। বিশেষ করে গ্রামের ছোট ছেলে-মেয়েরা চলন্ত মোটর বাইকের পিছে দৌঁড়াতো। কারো বাড়িতে বাইকে চড়ে কোন আগন্তুক এলে সেখানে তারা ভীড় করতো। বাইক চালক বাচ্চাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে অতি সন্তর্পণে বাইক চালাতো। তখনকার দিনে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। তাই কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতো না। আজকাল মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে মোটর ব্ইাক ও ইজিবাইক চালায়। রাস্তায় গিজ গিজ করা বাইকের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না।
মানুষের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে বহুগুণ। কারো দিকে অন্য কারো ফিরে তাকানোর সময় ও সুযোগ হারিয়ে যাচ্ছে। সবাই নিজের ধান্ধা নিজেরাই করছে। কেউ কারো ভাল পরামর্শ গ্রহণ করছে না। এমন কি কারো পরামর্শ নেবার প্রয়োজন মনে হলে তার আগে মোবাইল ফোনের বাটন টিপে ইন্টারনেটের দ্বারস্থ হচ্ছে। একই বলে যুগের হাওয়া। এটাই সামাজিক পরিবর্তন। কিন্তু এই পরিবর্তনের গতি-প্রকৃতি খুব নেতিবাচক। এরূপ নেতিবাচক সামাজিক পরিবর্তনের সাথে ক্রমাগত চলতে গিয়ে মানুষ হয়ে পড়ছে চরম অসহিষ্ণু। এর ফলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ উবে গিয়ে আত্ম-অহংকার, আস্ফালন, দম্ভ, অহমিকার ছড়াছড়ি তৈরী হচ্ছে।
এই অবস্থা দিন দিন এতটাই ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে যে, এতদিন মানুষের শ্রদ্ধার আসনে থাকা অনেক সিনিয়র সিটিজেনরা নিজেদের মর্যাদার আসন ও অবস্থান হারিয়ে এই ভঙ্গুর সামাজিক অবস্থাকে আরো অতল সমুদ্রের দিকে দ্রুত ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বড় বড় পদে থাকা অনেকের বক্তব্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নৈতিকতা বিবর্জিত কাজ করতে উৎসাহী করে তুলছে।
তবে কথা হলো ভাল পরামর্শ বা নীতিকথা কেউ সহজেই শুনতে চ্ায় না। তাই ভাল মন্দের তফাৎ কেউ শুনতে না চাইলেও তাকে বার বার বলতে হবে, শোনাতে হবে। শিশুদেরকে ভাল কথাগুলো অবশ্যই বার বার শোনাতে হবে। ভালভাবে বুঝাতে হবে। কিন্তু বাবা মায়ের সেই সময় কই? শিক্ষকদের সেই ধৈর্য্য কই? সেই শিক্ষা কই? স্কুলের শিশুরা শিক্ষকদের নিকট থেকে কি শিখছে? তাদেরকে কেন শিক্ষকদের অন্যায় ও দুর্নীতির কথা শুনতে হবে? তারা কেন নীতিহীন শিক্ষকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে পথে নামবে? তারা কেন মিডিয়ায় সামনে মারমুখী? এমন অবস্থা কেন হলো দেশে?
দেশের দায়িত্বরত বড়দের মধ্যে সমালোচনা সহ্য করার গুন কই? সমালোচনা না থাকলে ভুল শুধরানোর উপায় বন্ধ হয়ে যাবে। সেটাই তো স্বৈরতন্ত্র। আর স্বৈরতন্ত্র সৃষ্টি হওয়ার অর্থ হলো মানুষের বঞ্চনা। স্বৈরতন্ত্র মানেই অচিরেই করুণ পরিণতির অপেক্ষা। সে যতবড় ক্ষমতাধর বা হিটলার হোক না বঞ্চিতরা তাকে টেনে নিচে নামাবেই। সেটা তার জীবদ্দশায় না হয়ে মৃত্যুর পরে বোবা পাথরের মুর্তি হলেও। অন্তত: ইতিহাস তাই বলে।
বিশ্ব থেকে এখনও বর্বর যুগের অবসান হয়নি। একটি দেশের প্রধান কেন প্রতিবেশী দেশের শিশুদের হাসপাতালগুলোকে বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দিতে হবে? বাবা মাকে মেরে যুদ্ধাহত শিশুদেরকে কেন নিজের দেশে ধরে নিয়ে যেতে হবে? সভ্য পৃথিবীতে এটা কোন ধরণের বর্বরতা?
অথবা কোন সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজের দায়িত্বশীল ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যার হুমকি শুনতে হবে? এজন্য রেগে, ক্ষেপে গিয়ে কেন তাদেরকে বেআইনী ও জনক্ষতিকর বক্তব্য দিতে হবে? তাদের সমস্যার রুট কোথায়? তারা কেন একে অপরকে পানিতে চুবাতে চাইবেন? কেন আরেকজনকে টুপ করে পাহাড় চূড়া থেকে নিচে গিরিখাদে ফেলে দিতে চাইবেন? একজন উচ্চশিক্ষিত সাংসদ আরেকজন উচ্চশিক্ষিত সাংসদকে ‘অশিক্ষিত’ বলে সংবাদের শিরোনাম কেন হচ্ছেন? এমন আক্রমণাত্মক ও বেআইনী কথা বললে সেটা যে নিজের ব্যক্তিত্বহানি করে ও বুমেরাং হয়ে যায়। এমনকি দেশের অন্য কেউও জনসমক্ষে সেসব বেআইনী কথা বলার অধিকার রাখে না। চুনোপুঁটি কেউ এসব বললে শাস্তি হয়। কিন্তু ‘বিগবস’-দের শাস্তি হয়না কেন? এর কারণে মাফিয়া, ডন, বড়ভাই, মাদকসম্রাট সবাই লাই পেয়ে সবার মাথারউপরে বসে ছড়ি ঘুরায় আর অট্টহাসি করে। সেটাও আস্ফালন, অহংকার, দম্ভ, অহমিকা সবকিছুরই নামান্তর। তাদের হুংকারে সমাজের মাথারা নতজানু হয়, দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে নানা লাভের আশায়। বলা হয়- মাছের মাথায় সর্বাগ্রে পচন ধরে। মাথা পচলে দেহ দ্রুত পচে পোকা ধরে যায়।
আমাদের সমাজে রাজনৈতিক অঙ্গনের এসব কটুক্তি, উপহাস আজকাল সামাজিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে ভয়ানক সামাজিক ব্যাধি সৃষ্টি করে চলেছে। তাইতো মানুষ সত্য-মিথ্যা, পাপ-পূণ্যের পার্থক্য ভুলে গিয়ে হঠাৎ যে কোন অপরাধ করতে দ্বিধাবোধ করছে না। দিন দিন এর ব্যাপকতার ফলে আইনের কার্যকারীতা অসাড় প্রমাণিত হচ্ছে। জাতির দুর্ভাগ্যক্রমে তা যদি আরো ব্যাপক হয় তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কার মুখের ভাল কথা শুনে নৈতিকতাবোধে জাগ্রত হবে? একটি সমাজে ভয়ংকর অপরাধী ও কিশোর গ্যাং কি এমনিতেই সৃষ্টি হয়? আসলে তারা কোন না কোনভাবে তাদের মাফিয়া বসদের ছত্রছায়ায় আস্কারা পেয়ে এসব ক্ষতিকর বুলি দ্বারা উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হয়ে সন্ত্রাসী হয়ে উঠে।
মহান ব্যক্তিগণের নামে কটুক্তি, অপবাদ ও ধর্মীয় অবমাননা আরেকটি ঘৃণার হাতিয়ার। সম্প্রতি ভারতে নবী (সা:) ও হযরত বিবি আয়েশা (রা:) নিয়ে কটুক্তি করা হয়েছে ভারতের কিছু পথভ্রষ্ট রাজনীতিকদের মুখ থেকে। যার প্রতিবাদে সারা মুসলিম বিশ্ব সোচ্চার হয়ে হয়ে উঠেছে। এ ধরণের চরিত্র হণনকারী বক্তব্য ও হিংসাত্মক ধর্মীয় উস্কানীমূল মন্তব্য বিশ্বশান্তির পথে অন্তরায়। তারা জানে না যে আরবের সেই অন্ধকার যুগেও মহানবী (সা:)-এর পায়ে চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রেখে যে দুষ্ট বুড়ি দুরে দাঁড়িয়ে খিল খিল করে হাসতো তার ভাঙ্গা বাড়িটি আজও তার ঘৃণ্য কর্মকান্ডের সাক্ষ্য হিসেবে পর্যটকদের মাধ্যমে বুড়িকে ্অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করে। আবু জেহেলের বসতভিটা হাজীদের জন্য টয়লেট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে বেঈমান অত্যাচারীরকে ঘৃণা জানায়। তবুও ইতিহাস থেকে তারা কোন শিক্ষা না নিয়ে পুনরায় ঐতিহাসিক ভুল করে। আর তাইতো যুগে যুগে এসব জ্ঞানপাপীদের এসব কটুক্তি ও উপহাস বুমেরাং হয়ে নিজেদের নিকট ফিরে ফিরে আসে।
আমাদের দেশেও কারণে-অকারণে উপহাস করার জন্য কিছু দলকানা ভাঁড় তো আশেপাশেই আছেন। তাদের মুখে হাসি না বেরুলেও তারা সময় অসময়ে ভাল-মন্দ সব কিছুর প্রেক্ষিতে উপহাসের হাসি দিতে পারঙ্গম। তারা একেকজন বড় আস্ফালনকারীও বটে। জনগন এসব উপহাস ও তামাশার প্রতিবাদও করে। নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মাঝে সব কিছুতে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ‘মুই কি হনুরে’কিসিমের ভাবভঙ্গি নিয়ে মিডিয়ায় নিজেদের চেহারা প্রকাশ করে থাকেন। তারা মোটেও বুঝতে চেষ্টা করেন না যে এত তাদের ব্যক্তিত্বের মাঝে কি অরুচিকর অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়। সাধারণ মানুষ কতটুকু উস্মা ও ঘৃণা প্রকাশ করে তা তারা বুঝতেও চেষ্টা করেননা। তাই তাদের নিকট হতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি ‘উপহাস শিক্ষা’ছাড়া আর কি ভাল কিছু শিখবে?
দেশী-বিদেশী মিডিয়ায় এনব মানুষের হাম্বরা কথা প্রতিদিন শুনতে হচ্ছে। নানা বালখিল্য কথাও নিয়ত কানে আসে। এদর থেকে শিক্ষণীয় কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। ফলে মিডিয়া আজকাল যা দেখায় তা দেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে অপরাধবোধ জাগ্রত হওয়ার সকল উপাদান বিদ্যমান। এভাবে চলতে থাকলে সামাজিক বন্ধন উবে গিয়ে বিশৃখলা ও ভাঙ্গন অনিবার্য।
এছাড়া কোন কিছুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার স্বভাব শুনতে শুনতে মানুষের মন তিতো হয়ে যাচ্ছে। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা হলে আজকাল কিছু মানুষ তো সেটা বুঝে ফেলে। তার প্রতিবাদ ও হয়। সবকিছুর প্রতিবাদ করতে হবে কেন? কারো সব কথাই কি খারাপ? তা যাচাই না করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে অনেক ভাল জিনিসকে অবহেলা করা হয়। যার ফলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যকারীদের দ্রুত জনপ্রিয়তা কমে যায়। জনতা তাদের প্রতি ‘মবের’আকার নিয়ে ফুঁসে উঠে। লঙ্কাদ্বীপে ফুঁসে উঠা মবের আকার এতটাই ভয়াবহ হয়েছে যে সাগরেদসহ রাজাপক্ষ পলায়ন করেও কোনকিছু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ওদের আন্দোলন কোনভা্বেই থামছে না। দেউলিযা হয়েছে দেশ, কষ্ট পাচ্ছে সেখানকার মানুষ।
তবুও দিন দিন আমরা সবাই যেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি। কারো কথা কেউ সহ্য করতে পারছি না। নিজের অপারগতাকে রাগ, ক্ষোভ ও উপহাস দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করছি। অথচ যে কোন মানুষের অহংকার, আস্ফালন, উপহাস ও কটুক্তি শুধুই ক্ষতিকর এবং দ্রুত পতন ডেকে আনার জন্য যথেষ্ট। তাই ইতিহাস থেকে শুধু নয়- আশেপাশের বর্তমান থেকে শিক্ষা নিয়ে সংযত হয়ে এই ক্ষতিকর উপাদানগুলোর দ্রুত অবসান হওয়া প্রয়োজন।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd
সাম্প্রতিক মন্তব্য