logo
news image

বৈশাখে বন্যা হাওরে চাষীর কান্না

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
এখন কার্তিকে বন্যা হয়, চৈত্র-বৈশাখ মাসেও মুষধারে বৃষ্টিপাত হয়, পাহাড়ী ঢল নামে, অকাল বন্যা হয়। সারা পৃথিবীতে কৃষি উৎপাদনের জন্য প্রকৃতির সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে। এই লড়াইয়ের জন্য আধুনিক ও টেকসই কৃষি নীতিতে আগাম পরিকল্পনার মাধ্যমে কর্মসূচি নিধারণ করা হচ্ছে। আমাদেরও এসব পরিকল্পনা গ্রহণ করা আছে। কিন্তু সময়মত কাজ শুরু ও বাস্তবায়নে অহহেলার জন্য প্রতিবছর হাওরে এবং সীমান্তবর্তী নদীগুলোর নিচু জমিতে উঠতি ফসল ডুবে প্রান্তিক ও বর্গাচাষীদের সর্বসান্ত হবার ঘটনা ঘটে চলেছে।
এবছর চৈত্র মাসে প্রায় সারা দেশে বৃষ্টিপাত হয়েছে, হাওর এলাকায় পাহাড়ি ঢলের কারণে বন্যাও হয়েছে। বৈশাখের শুরু থেকে দেশের বাইরে উজানের দেশে পাহাড়ী এলাকায় অতি ব্যাপক বৃষ্টির কারণে অতিরিক্ত পানির ঢল নেমে কাঁচা বোরা ধান কোমর পানিতে ডুবে পচে গেছে। কাঁচা, পঁচা ধানগাছ কেটে নৌকায় ভরে ঘরে আনছে কৃষক। গবাদি পশুকে খাওয়ানোর আশায়। সুনামগঞ্জের হাজার হাজার একর বোরা ধান থৈ থৈ পানির নিচে। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় এক সপ্তাহে ঢলের পানির তোড়ে চার উপজেলার নয়টি বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। বোরো ধানের মওশুম শুরু হবার আগে কাঁচা ধানের ক্ষেত পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে।
সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ছাড়াও সীমান্তের জেলা লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামেও প্রতিবছর ঘটে একই ঘটনা। তিস্তা ও ধরলা নদীর চরাঞ্চলে হঠাৎ বন্যার প্রকোপ দেখা দেয়। উজানে প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটলে তার আগাম তথ্য বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদগণের সংগ্রহে থাকে না। থাকলেও কৃষকদের নিকট সেসব তথ্যের সতর্কবাণী পৌঁছানোর কোন ব্যবস্থা নেই। তিস্তার চরে পিঁয়াজ, রশুন, মিষ্টিকুমড়া, চিনাবাদাম, মিষ্টি আলু সবকিছুই হঠাৎ ‘ফ্লাশফ্লাডে’-র তোড়ে তলিয়ে গেছে। কারণ সীমান্তের ওপাড়ের বাঁধগুলোর সব গেইট একসংগে খুলে দেয়া হয়েছে। সেই পানির উচ্চ চাপ সামলাতে না পেরে আমাদের ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারেজের সব গেইট খুল দেয়ায় ৩০০ কি.মি. এলাকার গোটা চরাঞ্চল পানিতে ডুবে গেছে। অপুষ্ট পিঁয়াজ, রশুন ও সব্জী পচে গছে। কেউ কেউ পানিতে নেমে ডুবন্ত ফসল তোলার প্রানান্ত চেষ্টা করছেন।
আর ১-২ সপ্তাহ পার হলে কাঁচা ধান পেকে যেত। আর কিছুদিন পর তিস্তাচরের বড় বড় বিখ্যাত মিষ্টিকুড়া, মিষ্টি আলু, চিনাবাদাম ঘরে তুলতে পারতো প্রান্তিক কৃষকরা। কিন্তু এবারের চৈত্রে হঠাৎ বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে তাদের স্বপ্ন। সবকিছু হারিয়ে তারা অনেকেই নির্বাক হয়ে গেছে। অনেকের বুকফাটা আর্তনাদ ও কান্নায় হাওরের বাতাস ভারী হলেত তারা সবাই মিলে বাঁধ রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেও ভাঙ্গন ঠেকাতে না পেরে অসহায়ের মতো চেয়ে দেখছে বাঁভাঙ্গা স্রোতের তান্ডব।
প্রান্তিক ও বর্গাচাষীরা অনেকেই মহাজনের নিকট থেকে চড়া সুদে দাদন ও কৃষিঋণ নিয়েছেন। তারা হতাশায় ভুগছেন-কিভাবে ঋণের টাকা শোধ দিবেন সেই আশঙ্কায়। একদিকে ঋণ শোধের চিন্তা অন্যদিকে সামনের দিনগুলাতে কি খেয়ে দিনাতিপাত করবেন ও পরিবারের চাহিদা মেটাবেন- সেটা এখন তাদের বড় দুশ্চিন্তার কারণ।
হাওর বাঁচাতে সরকারের উদ্যোগ আছে কিন্তু কঠোর উদ্যোগ নেই। প্রতিবছর বাঁ মেরামত বা সংস্কার ও নতুন বাঁধ নির্মাণের জন্য বড় টাকার অঙ্ক বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে। গত বছর ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।  কিন্তু ফসল রক্ষা হয়নি। কারণ, সময়মত কাজ শেষ হয়নি। কাজের সুষ্ঠু মনিটরিং হয়নি। যেটুকু কাজ হয়েছিল তা সাময়িক ও দুর্বল। ফলে প্রচন্ড পানির তোড়ে শেষ রক্ষা সম্ভব হয়নি।
প্রতিবছর ঢল শুরু হলে বিপদের আশঙ্কায় অসহায় মানুষ বাঁশ গড়ে, কাদামাটির ডালি নিয়ে অসহায়ের মতো বাঁধ রক্ষার্থে ছুটাছটি শুরু করে। কৃষাণীরা দল বেধে তাদেরকে সহায়তা করতে এসে কিছু না পেরে আর্তনাদ করতে থাকে। এদৃশ্য কি আমরা প্রতিবছর বোরো মৌসুমে টিভিতে করুণভাবে প্রত্যক্ষ করে যেতেই থাকব?
এজন্য স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের কথা উঠেছে। কংক্রীটের ঢালাই দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবী স্থানীয়দের ।
হাওড়ের সোনার ফসল যেহেতু আমাদের খাদ্যের বিরাট অংশের যোগান দেয় সেহেতু এই সোনার ফসল রক্ষার জন্য স্থায়ী ও টেকসই পরিকল্পনা নিয়ে নেমে পড়া প্রয়োজন। একটি সুদূর প্রসারী মজবুত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে পারলে হাওরের মানুষের ফিবছর পুন: পুন: কান্না থামানো যেতে পারে।
উপমহাদেশের ভাটিতে অবস্থান করায় উজানের পানির তোড় সামাল দেয়া আমাদের নিয়তি। বন্যা, অকাল বন্যা, ‘ফ্লাশফ্লাড’ইত্যাদি প্রতিরোধের জন্য আমাদেরকে আগাম সতর্কবার্তা নিয়ে কৃষিপরিকল্পনা ঢেলে সাজাতে হবে। বিশেষ করে দেশের উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত নদীগুলোর ব্যাপারে ডেল্টা প্লানে অতিজরুরী ভিত্তিতে খরা মৌসুমে সেচ ও হঠাৎ পাহাড়ী ঢলের নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ ধারা ও সতর্কতা সংযুক্ত করতে হবে। ডেল্টা প্লানে ‘তিস্তা রেষ্টোরেশন প্রকল্প’এবং হাওর বাঁচাও প্রকল্পের কাজ সঠিকভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে কি-না তা দ্রুত খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ ভাবতে হবে কৃষির উন্নয়নই আমাদের প্রকৃত উন্নয়ন।
প্রতিবছর কোন ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পর আমাদের কর্তৃপক্ষের তোড়জোর শুরু হয়। কিন্তু আমরা সময় থাকতে সেসব ব্যবস্থা নিতে ঢিলেমী করি কেন? সরকারী সম্পদের অপচয় রোধ করতে সময়ের কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমাপ্ত করার মানসিকতা তৈরী করতে হবে। সেটা করতে না পারায় দেশের অন্যান্য প্রকল্পের মতো দুর্নীতির বেড়াজালে বন্দী হয়ে থাকবে হাওরের সর্বশান্ত প্রান্তিক চাষীদের ফিবছরের বোবা কান্না। এ অবস্থার দ্রুত নিরসণ হওয়া প্রয়োজন।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top