logo
news image

একজন জীবন সংগ্রামী ছাফিয়া খানমের গল্প

ইমাম হাসান মুক্তি, লালপুর (নাটোর)
দেশের একমাত্র নারী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ছাফিয়া খানম। তার জন্ম নাটোরের লালপুর উপজেলার দুরদুরিয়া ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গ্রামে। বাবা প্রয়াত আজহার আলী সরকার ও মা প্রয়াত গোমেদা বেগম। ছাফিয়া খানমের একমাত্র মেয়ে হোসনে আরা মাহমুদা কোলে থাকা অবস্থায় স্বামী হাবিবুর রহমান মারা যান।
ছাফিয়া খানম রংপুর নগরের কামাল কাছনা এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি রংপুর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ছাফিয়া খানমের জীবনযুদ্ধের গল্প বলেন, বয়স যখন ১০-১২, নানা প্রতিকূতার মধ্যেও মনের অজান্তে বঙ্গবন্ধুর আর্দশ, মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমে মুগ্ধ হন। এ সময় তাকে বঙ্গবন্ধু পাগল বলেও ডাকতেন পরিবারে সদস্যরা। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা থেকে দুর্বলতা চলে আসে আওয়ামী লীগের ওপরও। এরপর রাজনৈতিক জীবনে নানা চড়াই-উতরাই পার করতে হয়।
দলের প্রতি ত্যাগ ও নিবেদিত আওয়ামী লীগ কর্মী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন ছাফিয়া খানম দলীয় মনোনয়ন নিয়ে রেকর্ড গড়ে নির্বাচিত হয়ে যান দেশের প্রথম নারী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান।
ব্যক্তিগত জীবনেও পাহাড় সমান সংগ্রাম করতে হয়েছে ছাফিয়া খানমকে। চার বছর বয়সেই বাবাকে হারান। অভিভাবকহীন সংসারে বিপাকে পড়েন মা। দুঃসম্পর্কের চাচার সহযোগিতায় লেখপড়া শুরু করেন ছাফিয়া। এরইমধ্যে পদ্মার ভাঙনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে গেলে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় তার। দুই বছর বাড়িতে বসে থাকার পর মা ও চাচার চাপে বাল্য বয়সেই বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়। ঘর-সংসার বুঝে ওঠার আগেই কন্যা সন্তানের মা হন। এরপর সন্তানের বয়স নয় মাস হতেই মারা যান ছাফিয়ার স্বামী।
১৬ বছরেই স্বামী হারা, শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। আবার তিনি মায়ের কাছে ফিরে আসেন। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। চোখে অন্ধকার। বেঁচে থাকার পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে তার। মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে থাকেন। এ সময় তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন বান্ধবী খালেদা খানম। বান্ধবী ছাফিয়াকে ষষ্ঠ শ্রেণির বই-পুস্তক দিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দেয় এবং লেখাপড়ার খরচ ও উৎসাহ জোগায়। কিন্তু বাধ সাধেন চাচাসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনরা। তারা সাফ জানিয়ে দেন বিধবা মেয়ের লেখাপড়া হবে না। তিনি জেদ ধরেন লেখাপড়া করবেন। এতে স্বজনদের কাছ থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
শুরু হয় তার নতুন জীবনযুদ্ধ। সীমাহীন বাধা-বিপত্তি, দুঃখ-কষ্ট, আর্থিক অনটনের পরও ১৯৭৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেন ছাফিয়া। চাকরি জোগাড় করে সন্তানের খরচসহ নিজের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন। এইচএসসি পাস করার পর ১৮ মাসের কোর্স করে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শকের প্রশিক্ষণ নিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন এবং বিএ ভর্তি হন।
এরইমধ্যে মেয়ে বড় হয়ে গেলে তিনি ভাইয়ের স্মরণাপন্ন হয়ে রংপুরে চলে আসেন। রংপুরে আসার পর বিএ, এমএ এবং এলএলবি পাস করে আইনজীবী পেশায় যুক্ত হন। এরপর একটি এনজিওতে চাকরি নেন। চাকরির পাশাপাশি পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। দলের প্রতি ছাফিয়ার ভালোবাসা দেখে রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ইলিয়াস আহমেদ, আবুল হোসেন, আশিকুর রহমান এমপি ও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি তাকে জেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক করেন। ১৯৭৬ সালে রাজনীতিতে হাতেখড়ি নেন নাটোর-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সাংসদ শহীদ মমতাজ উদ্দিনের কাছে।
এ পদ পেয়ে তার মাথায় আসে মহিলা আওয়ামী লীগ গঠনের চিন্তা। নব্বই দশকে নারীদের এক করে গড়ে তোলেন মহিলা আওয়ামী লীগ। ১৯৯৩ সালে কাউন্সিলের মাধ্যমে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ পদে টানা দুই যুগ পার করে রংপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে মনোনয়ন চান। রংপুরের একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশীর মধ্য থেকে প্রধানমন্ত্রী ছাফিয়া খানমকে বেছে নেন। তিনি তুমুলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top