মা বঞ্চিত খোকনের কাছে-খোকন বঞ্চিত মায়ের কাছে
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
পরিবারে বৃদ্ধ বাবা—মায়ের প্রতি অনাদর ও বঞ্চনার বিষয়টি আজকাল সবার মনে ভীষণ দাগকাটে। মানুষের আর্থ—সামাজিক পরিবর্তনের সাথে আয় ও ব্যস্ততা উভয়ই বেড়েছে। সংগে বেড়েছে পরিবারের অতি ছোট ও বয়স্কদের কষ্ট ও যাতনার মাত্রা। বেড়েছে সীমাহীন অবহেলা ও দূরত্ব।
পরিবারের খুকীরা বড় হয়ে বাপের বাড়িতে আর থাকতে পারে না। চলে যায় স্বামীর পরিবারে। তারা ফেলে যায় বাবা—মায়ের সাথে মিলেমিশে থাকা আদরের দিনগুলোর সাথে আরো অনেক কিছু। মাঝে মাঝে খোঁজ—খবর নেয়া বা কিছু উপঢৌকন পাঠানো ছাড়া তাদের ভূমিকা বেশী কিছু থাকে না। তাই বৃদ্ধ বয়সে নির্ভরশীল বাবা—মা থেকে খুকীরা একরকম দূরেই চলে যায়। যদিও খুকীরা শিশুকালে তার ভাইদের মত বাবা—মায়ের সাথে থেকে বড় হয়, আধুনিক জীবনের নানা চড়াই উৎরাই তাদেরকেও সহ্য করতে হয়— যদি বাবা—মা কর্মজীবি হন। তবে খুকীর চেয়ে খোকনদের উপর সিংহভাগ নির্ভরশীল বৃদ্ধ বাবা—মায়ের কথাই আলোচনায় ফিরে ফিরে আসে বার বার।
এর কারণ, খোকন বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করার সাথে সাথে ভিন্ন পরিবারের আরেজনকে নিয়ে নিজের জীবন সাজাতে শুরু করে। সেই ভিন্ন পরিবারের মেয়েটির সংগে অনেক বৃদ্ধ বাবা—মায়ের মনের মিল হয় না । আধিকাংশ সময়ে সেখান থেকে বিপত্তি শুরু হয়ে যায়।
বিশেষ করে খোকনের বিয়ের পর সংসারের কতৃর্ত্ত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব বেধে যায়। এরপর সংসারে সন্তানের সংখ্যা বেশী থাকলে এবং তারা এককজন ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় জীবন—জীবিকার তাগিদে বসবাস শুরু করলে বৃদ্ধ বাবা—মা কোন সন্তানের সংগে বসবাস করবেন, কি খাবেন, কে নিয়মিত ওষুধ খাওয়াবেন তা নিয়ে সমস্যা তৈরী হয়। এছাড়া এক বাবা—মায়ের সব বাচ্চা বা সব খোকনের আর্থিক অবস্থা সমান হয় না বিধায় তা নিয়ে পছন্দের সমস্যা তৈরী হতে দেখা যায়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৃদ্ধ বাবা—মায়ের সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে সন্তানদের মধ্যে বিরোধ তৈরী হয়। এগুলো হরদম ঘটছে। এই বিরোধ মানসিক সমস্যা ও অভিমান তৈরী করলে সমস্যা জটিল আকার ধারণ করে। তাঁদেরকে বৃদ্ধ নিবাসে পাঠানোর প্রশ্ন এখান থেকে বেশী শোনা যায়।
গ্রামের কোন পরিবারে কেউ উচ্চশিক্ষিত হয়ে চাকুরী লাভ করলেই গ্রামছাড়া হতে শুরু করে। বদলীর চাকুরী হলে তো কোন কথাই নেই। এক সময় বাবা—মা গ্রামবাসী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তারা। বিয়ের পর শুধু স্ত্রী—সস্তান নিয়ে শহরেবাসী হয়ে পড়েন। সেই পরিবারে যদি স্বামী—স্ত্রী দু’জনই কর্মজীবি হন তাহলে তারা প্রাথমিকভাবে বাবা—মাকেও সাথে নিয়ে শহরে চলে যান। যাদের বাবা—মা নেই তারা শ^শুর—শ^াশুরীর দ্বারস্থ হয়ে থাকেন। তার প্রধান কারণ, নিজেদের ছোট বাচ্চাদের দেখাশুনা করা। স্বামী—স্ত্রী দু’জনই কাজে চলে গেলে নিজের বাচ্চাকে তো আর কাজের বুয়ার তত্ত্বাবধানে রেখে যাওয়া যায় না। তবুও আজকাল সবার বাবা—মা বা নিকটাত্মীয়রা এই ধরনের সেবা দিতে পারেন না। তাই কাজের বুয়ার সাহায্য নিতে হয়। তবে বর্তমানে বিশ^স্ত কাজের বুয়ার সংকট থাকায় দুজন চাকুরী করা পরিবারে সন্তান প্রতিপালনে বেগ পেতে হচ্ছে।
আমাদের দেশে ডে—কেয়ার সেন্টারগুলোতে উন্নত দেশের মত সেবা ব্যবস্থা না তাকায় এই সংকট সামনে আরো বেশী ভয়াবহ আকার ধারণ করতে থাকবে। হয়তো জাপানের মত দুজন চাকুরে সম্বলিত পরিবারে সন্তান নেবার ক্ষেত্রে আগ্রহ নষ্ট হয়ে যাবে। তখন ওদের দেশের মতো আমাদের দেশের জনসংখ্যার হার নিম্নগতি হতে হতে শূণ্যের কোটায় নেমে যেতে পারে।
অনেক আধুনিক পরিবারে কাজের বুয়ার কাছে বাচ্চাদের রেখে অফিসে যাবার প্রবণতা দেখা যায়। তারা বিকল্প হিসেবে বাসায় আধুনিক সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে অফিস তেকে বার বার ক্যামেরার মাধ্যমে শিশুর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। তবে সম্প্রতি এই সিসি ক্যামেরাতে ভয়ংকর তথ্য পাওয়া গেছে।
দেখা গেছে— শিশুর প্রতি যত্ন না নিয়ে কাজের বুয়া শিশৃর খাবার নিজে খেয়ে ফেলেছে। সে সারাক্ষণ টিভির রিমোট হাতে নিয়ে চ্যানেল পরিবর্তন করে সিনেমার নাচ—গান দেখতে ব্যস্ত। শিশু খাবারের জন্য কান্নাকাটি করলে তাকে মারধোর করা হচ্ছে। শিশুর কান্না না থামলে তার টিভি দেখার ব্যাঘাত ঘটে। তাই সে ি শশুর কান্না থামাতে অনবরত চড়—থাপ্পর, এমনকি বার বার লাথি মেরে চরমভাবে নিযার্তন করছে।
এমন একটি ঘটনার দৃশ্য আমাদের দেশে এক চাকুরে দম্পতির শিশুর কপালে জুটেছিল। বাধ্য হয়ে তারা দ্রুত বাসায় এস শিশুকে হিংস্র বুয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছিল।
এভাবে দিন যতই গড়াচ্ছে আধুনিক শিক্ষত কর্মজীবিদের পরিবারের শিশুরা বাবা—মায়ের আদর যত্ন ও ভালবাসা ব্যতিরেকে বড় হচ্ছে। এবং নানা ভাবে দৈহিক ও মানসিক নিযার্তনের শিকার হচ্ছে। বাবা—মায়ের স্নেহ—ভালবাসা বঞ্চিত এসব শিশুরা বড় হয়ে নিষ্ঠুর আচরণ করছে অন্যদের সাথে। তারা সহপাঠি ও বন্ধুদের সাথে মিলেমিশে চলতে পারে না। ঝগড়া—ফ্যাসাদ করতে পছন্দ করে। কোনকিছু শেয়ার করার মানসিকতা হারানো এসব শিশুরা সমাজের জন্য ভয়ংকর। তারা একদিন কিশোর গ্যাং, মাস্তানী ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়ে বড় বড় অপরাধ করতে উদ্যত হচ্ছে। এসব ভালবাসাবঞ্চিত শিশুদের শাসন করা খুব বিপদজনক। তারা একটু কড়া কথা সহ্য করতে পারে না। সামান্য ব্যাপারে ক্ষেপে যায়, বিগড়ে যায়। পড়াশুনায় মনোযোগী না হওয়ায় তাদেরকে শিক্ষক কিছু বললেই স্কুল পালানোর প্রবণতা তৈরী হয় তাদের মধ্যে। যেটা তাদের বাবা—মায়েরা জানতেই পারে না। স্কুলে যাবার নামে ফাঁকি দিয়ে অন্যত্র ঘুড়ে বেড়ায়, আড্ডা দেয়। এভাবে একদিন বাবা—মায়ের টাকা—পয়সা চুরি করে সিনেমা, সাইবার ক্যাফে, রেষ্টুরেন্টে ঢুকতে থাকে। খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে হয়ে যায় মাদকাসক্ত। অনেক গবেষণায় এসব ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে। শিক্ষিত কর্মজীবি মায়েদের পরিবারে বাবারাও কর্মজীবি হলে এবং নিকটাত্মীয়রা কোনরুপ সেবা সহায়তা দিতে অপারগ হলে এই সমস্যা সেসব শিশুদের জীবনে নিয়ে আসে চরম হতাশা ও বঞ্চনা।
এসব শিশুরা বড় হয়ে তাদের বাবা—মায়ের প্রতি তেমন ভাল আচরণ করতে চায় না। বিশেষ করে বিয়ের পর তাদের সংসার বড় হয়ে গেলে সেখানে তাদের বাবা—মায়ের অবস্থান করা কঠিন হয়ে পড়ে। দু’একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া শিশুকালে বাবা—মায়ের স্নেহ—ভালবাসা বঞ্চিত খোকনরা বড় হয়ে তাদের বৃদ্ধ বাবা—মাকে কাছে রাখে না। বাবা—মায়েরাও তাদের কাছ থেকে আদর—যত্ন, সম্মান না পেয়ে নিজেদেরকে বোঝা মনে করে। তাদের নিজেদের জীবনের প্রতি ধিক্কার ও ঘৃণা জন্মে। তাই তারা অখিমান করে আর বেশীদিন এই দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে চান না। অন্যের নিকট সেসব দু:খের কথা প্রকাশ করেন। আপন পেটের সন্তানের মায়া ছিন্ন করে তারা বৃদ্ধ নিবাসে থাকতেই পছন্দ করেন।
এভাবে বাবা—মা ও সন্তানের মধ্যেকার ভালবাসা, মায়া—মমতার কাহিনী একদিন শুধু গল্পে পরিণত হয়ে যায়। উন্নত বিশে^ বয়স্ক ও নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সরকারীভাবে সকল বয়স্কদের জন্য ভাতা ও আবাসনের ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের দেশে এখনও সেই সুবিধা গড়ে উঠেনি। শুধু কিছু গ্রামীণ দুস্থ: বয়স্কদের জন্য সামান্য পরিমাণে বয়স্কভাতার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। শহুরে দুস্থ বয়স্কগণ অনেক বিত্তমালি পরিবারের সদস্য হয়েও পরিবারের নিজের সন্তানের মাঝে বসবাস করতে পারেন না। তাদেরকে জোর করে বৃদ্ধ নিবাসে পাঠিয়ে দেয়ার কথা শোনা যায়। যেটা চরম অমানবিক। খোকনের স্ত্রী, সন্তানদের নিকট অনাদর আর অহলোয় তারা জীবন সাহাহ্নে বৃদ্ধ নিবাসে চোখের জল ফেলে একদিন মরণকে বরণ করে নেন। সেটাও একদিন একটি অমানবিক গল্প হয়ে ভেসে ভেসে আকাশ বাতাস ভারী করে ফেলে।
আজ যারা যুবক আগামীকালই তারা বৃদ্ধ হয়ে যাবে—এটা ভুলে যায় অনেকেই। নিজেদের জীবনের শেষ বেলার কথা কেউ স্মরণে আনতে চায় না। কোন খোকন তার মাকে বঞ্চিত করলে সেও একদিন তার নিজের খোকন দ্বারা অবহেলিত ও বঞ্চিত হবে এই কথা স্মরণ করে প্রতিটি মানুষকে প্রকৃত শিক্ষিত, জ্ঞানী ও মানবতাবাদী হবার জন্য তৎপর হতে হবে। এজন্য নতুন বছরে জরুরী ভিত্তিতে সবাইকে নতুন করে এ বিষয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd
সাম্প্রতিক মন্তব্য