logo
news image

মাছের আঁশে জীবন বাঁচে

ড. লিপন মুস্তাফিজ।।
সেদিন মিরপুরে গিয়েছিলাম আমরা তিন বন্ধু সুপারির বাকল নিয়ে কাজ করে এমন একটা ছোট কারখানা দেখতে। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ মাছের গন্ধে পাশের একটা টিনশেডে উঁকি দিতেই আমাদের সবাইকে অবাক করে দিল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এগুলো মাছের আঁশ। ঘরের মেঝেতে মেলে দেওয়া, পাশে কিছু বস্তায় রাখা। পেয়ে গেলাম দুই একজন যারা এর সঙ্গে জড়িত। আলাপ করে জানা গেল, এগুলো তারা বিদেশে রপ্তানি করে। বিষয়টা আমাকে ভাবাতে শুরু করল। খোঁজখবর নিতে শুরু করলাম, ধীরে ধীরে আমার আগ্রহের পারদ বাড়তে শুরু করল। জেনে অবাক হলাম আজ থেকে প্রায় সতের বছর আগে বাংলাদেশে এক বিদেশি এই মাছের আঁশ কী করে বিদেশে রপ্তানি করে অর্থ উপার্জন করা যায় তা শিখিয়েছেন বাংলাদেশের এক তরুণকে।
আমার ধারণা ‘মাছের আঁশে জীবন বাঁচে’ এই সেøাগানের সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত নই। তবে এই ধারণার সঙ্গে অনেকেই পরিচিত না হলেও এখন কিন্তু ধীরে ধীরে অনেকেই পরিচিত হয়েছেন বা হচ্ছেন। বাতিল জিনিস মানেই যে ফেলনা নয়, এটা এখন প্রমাণিত। কেননা মাছের আঁশ দিয়ে তৈরি করা যাচ্ছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। এমনকি বিভিন্ন প্রসাধনসামগ্রী, ফুড সাপ্লিমেন্ট তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে মাছের আঁশ। এছাড়াও কোলাজেন নামক একটি পণ্য বিক্রি হয় ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের দোকানে দোকানে। সেটা তৈরি হয় মাছের আঁশ দিয়ে।
সাধারণত মাছ কাটার পর আঁশ ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু এখন সেই ফেলে দেওয়া আঁশ থেকেই তৈরি হচ্ছে অপরূপ সব হস্তশিল্প। বানানো হচ্ছে গহনা এবং দেবদেবীর মূর্তি। এই সব শৌখিন কাজ স্থান পাচ্ছে মানুষের সাজে-পোশাকে, ড্রয়িং রুমের শোকেসেও। এমনকি আঁশ ব্যবহার হচ্ছে ক্যাপসুলের মোড়ক তৈরিতে। ফলে মাছের আঁশের পাশাপাশি কাঁটা, চোখ, কান সবই এখন দামি হয়ে উঠেছে। এ কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছরই অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে শত শত টন মাছের আঁশ, কাঁটা, ফুলকা রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। চিংড়ি মাছের খোলস, মাথা, কাঁকড়ার খোলসও রপ্তানি হচ্ছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। এসব মৎস্যজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাত করে দেশের বাইরে তৈরি হচ্ছে খাদ্য, গ্লু, ওষুধ, স্যুপ, কসমেটিকস সামগ্রী। নানান ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, দামি জুতা ও বিশেষ ধরনের পোশাকও প্রস্তুত হচ্ছে মাছের আঁশ থেকে। যার ফলে দিন দিন বাড়ছে অপ্রচলিত এসব পণ্যের ব্যবসা। তবে মৎস্যজাত ওই সব পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশই প্রধান দেশ নয়। প্রতিবেশী ভারত, চীন থেকেও রপ্তানি হয় একই ধরনের মৎস্যজাত পণ্য। বাজার থেকে আঁশ সংগ্রহের পর তা শুকিয়ে বাজারজাতের উপযোগী করা হয়। মাছের আঁশ প্রতিকেজি ১৫ থেকে ২০ টাকা। আবার কোথাও কোথাও মণপ্রতি চার হাজার টাকায় আঁশ বেচাকেনা হয়। বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলার অন্তত ৩৬০টি বাজার থেকে চিংড়িসহ নানা ধরনের মাছের আঁশ, খোসা, ফুলকা ও মাছের কাঁটা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এছাড়া খুলনা ও চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ কাঁকড়ার খোলস। এর প্রায় সবটুকুই রপ্তানি হচ্ছে জার্মানি, ইতালি, স্পেন, যুগোশ্লাভিয়া, কোরিয়া ও জাপানে।
এখন মাছের আঁশ দিয়ে তৈরি জিনিসের অনলাইনেও প্রচুর চাহিদা রয়েছে। দুই থেকে পাঁচ কেজি ওজনের মাছ হলে তার আঁশ থেকে তৈরি হয় ভালো গহনা। মাছের আঁশ নিয়ে কাজ করা তেমনই একজন ব্যবসায়ীর নাম খুলনার মো. জুলফিকার আলম। তিনি দেশজুড়ে মাছের আঁশ সংগ্রহ করেন। বিশেষ করে বন্দর এবং জেলা পর্যায় থেকে। তার অন্তত ২০০ লোক এই আঁশ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত। বাজারে যারা মাছ কাটেন এবং আঁশ ছাড়ান, প্রথম কাজটা তারাই করেন। মেক্সিমকোর স্বত্বাধিকারী জুলফিকার আলম বলেন, প্রথমে এক ভিনদেশির কাছে কাজটা শিখেছেন, এরপর তিনি দেশে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
পানি ও কেমিক্যাল দিয়ে ধুয়ে রোদে শুকানোর অন্তত দুদিন পর তা মচমচে হয়। এরপর সংরক্ষণ করা হয়। আঁশের সঙ্গে মাছের কিছু অন্য জিনিস ঢুকে যায়। যেমন পাখনা, লেজের অংশ, কানের অংশ, গাছের পাতা ইত্যাদি। এগুলো বাছাই করে ফেলে দিতে হয়। পরে প্যাকেট করা হয় একেকটি ২৫ কেজি করে। মাছের আঁশের বড় রপ্তানি গন্তব্য হচ্ছে জাপান। কিন্তু জাপানে সরাসরি পাঠানো যায় না। জাপানি একটি বড় কোম্পানি চীন ও ইন্দোনেশিয়ায় দুটি আলাদা কোম্পানি খুলেছে। ওখানে আগে পাঠানো হয়। মূল কোম্পানি পরে নিয়ে যায়। দক্ষিণ কোরিয়াতেও এখন কারখানা গড়ে উঠেছে। রপ্তানির জন্য তৈরি করার পর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করে। তাদের সনদ পাওয়ার পরই রপ্তানি করার অনুমতি মেলে। বছরে ৮০০ থেকে ১ হাজার টন মাছের আঁশ রপ্তানি করা যায়, এক সাক্ষাৎকারে জানান জুলফিকার আলম। মেক্সিমকোসহ বর্তমানে বাংলাদেশে মোট তিনটি কারখানা রয়েছে। মোট রপ্তানি আনুমানিক দেড় লাখ ডলারের পণ্য। তবে বেশি পরিমাণ রপ্তানি তিনিই করেন। তিনি রপ্তানি করেন বছরে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ডলারের পণ্য। বাকিটা অন্য দুই কারখানা করে।
আমাদের দেশে এখনো মাছের পাখনা, পটকা ও আঁশ সাধারণত ফেলনা বস্তু মনে করা হয়। কিন্তু এগুলো ঘিরেই চলছে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। হাঙরসহ মাছের পটকা, পাখনা, কান রপ্তানি করে বছরে ১৫ কোটি টাকা আয় হচ্ছে বলে জানা যায় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আশুতোষ দাস আশুর কাছ থেকে। জাপানি ফিশ অ্যান্ড ব্রাদার্সের সঙ্গে যুক্ত আশুতোষ বলেন, দিন দিন এ ব্যবসা কমছে। একসময় নগরীর ফিশারিঘাট এলাকায় হাঙর রাখার জায়গা থাকত না। তখন পাখনা, ফুলকা, কানসহ পুরো সেটের ব্যবসা থাকলেও এখন আগের মতো বড় হাঙর আসে না। জাপান, ফিলিপাইন ও চীনে হাঙরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিপুল চাহিদা রয়েছে। গভীর সমুদ্রে একসময় ব্লু শার্ক, টাইগার শার্ক, হেমারহেড শার্ক, কালা হাঙরসহ ১০ প্রজাতির হাঙর পাওয়া গেলেও এখন সেই পরিমাণে মাছ নেই। বর্তমানে হেমারহেড হাঙরের চাহিদা বাড়লেও মূলত রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজারে এগুলো বিক্রি হয়। ইলিশ মাছ ডিম ছাড়ে কিন্তু হাঙর বাচ্চা দেয়। ফলে হাঙর পেটের বাচ্চাসহ জেলেদের জালে আটকা পড়ে। প্রজনন হ্রাস পাওয়ায় হাঙর কম আসছে বাজারে। একটি হাঙরের দুটি কান, একটি লেজ, একটি পাখনা মোট চারটি অংশ এক সেট করে বিভিন্ন গ্রেডে আকার ও মান অনুযায়ী বিক্রি করা হয়। প্রতিকেজি হাঙর কিনতে হয় ১৪০ থেকে ১৮০ টাকার মধ্যে। এরপর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শুকিয়ে রপ্তানি করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, চট্টগ্রামে পাঁচ থেকে ছয়জন হাঙরের পাখনাসহ সামুদ্রিক মাছের পটকা রপ্তানি করে। মাছ কাটার সঙ্গে যুক্ত লোকজন এবং মাছ বিক্রেতাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা পটকা ও পাখনা প্রক্রিয়াজাত হয় স্থানীয় কারখানায়। কাঁচা পটকা ও পাখনা সংগ্রহের পর প্রথমে রোদে শুকানো হয় কড়া করে। কয়েক দিন শুকানোর পর তা শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়। এরপর তা ওজন করে প্যাকেট করা হয়। শুকনা পাখনার কেজি বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায়। আর কাঁচা পটকার দাম কেজিতে ১৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। স্বাধীনতার আগে থেকে হাঙরের পাখনা, ফুলকা এবং সামুদ্রিক মাছের আঁশ বিক্রি করছে জাপানি ফিশ অ্যান্ড ব্রাদার্স। কোম্পানির স্বত্বাধিকারী সুধাংশু দাসের কাছ থেকে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লাক্কা, কোরাল, কৈ, লাল কোরাল, শাপলা পাতাসহ বিভিন্ন মাছের পটকা, বড় মাছের আঁশ, লেজ, কাঁচা পাখনা সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে বিভিন্ন গ্রেডে ভাগ করে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করা হয়। নগরীর ফিশারিঘাট বাজারে মাছ কাটেন হরিরাম দাস। তার কাছ থেকে জানা যায় যে, বড় মাছের কাঁচা আঁশ এবং ভালো পটকা আকারভেদে বিভিন্ন দামে কেজি হিসেবে বিক্রি হয়।
বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে আয়ের জন্য নানা ধরনের উৎস, আমাদের তরুণ সমাজ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধি রাখে। তারা পড়াশুনা করে বা এর পাশাপাশি যদি এই ধরনের উদ্যোগে নিজেদের নিযুক্ত করতে পারে তবেই তারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাবে, চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়। সরকারের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ এদের করে তুলতে পারে আয়ের জন্য হাতিয়ার করে তুলতে, আর ব্যাংক যদি পাশে থাকে তবেই গড়ে উঠতে পারে মাছের আঁশ নিয়ে ছোট ছোট ক্ষুদ্রশিল্প, কর্মসংস্থান হতে পারে অসংখ্য লোকের। দেশীয় উপাদান যেমন সুপারির খোল থেকে হতে পারে প্লেট, কলাগাছের বাকল থেকে হতে পারে সুতা, কচুরিপানা থেকে হতে পারে স্যানেটারি ন্যাপকিন ইত্যাদি আমাদের তরুণদের হাতছানি দিচ্ছে। সময় শুধু অপেক্ষার। সোনার বাংলা আবার সোনালি হবে, আসবে  সুদিন। বিদেশে যেতে হবে না, দেশে বসেই আয় করা যাবে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে থাকা যাবে সুখে ও শান্তিতে।

* ড. লিপন মুস্তাফিজ: ব্যাংকার ও গবেষক। liplisa7@gmail.com

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top