logo
news image

বাস্তবমুখী শিক্ষাব্যবস্থা দেখতে চাই

দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এবং শিক্ষা দুর্নীতি দূর করতে শুধু সর্বোচ্চ মেধাবীদেরই উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একটি নির্দিষ্ট মানের ওপর ভিত্তি করে যাঁরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবেন না, তাঁদের বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করার ওপর জোর দিয়েছে সংস্থাটি।

দুদকের ২০১৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। রোববার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে প্রতিবেদনটি তুলে দেন সংস্থার চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।

প্রতিবেদনের সুপারিশমালায় শিক্ষা খাতে দুর্নীতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, নিয়োগ দুর্নীতির নানা দিক তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পথ এতটাই অবারিত হয়েছে যে সরকারি-বেসরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে লাখ লাখ চাকরিপ্রার্থী ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এঁদের অনেকেই দেশের উন্নয়নে সম্পৃক্ত হতে পারছেন না, অন্যদিকে অনেকে ঘুষ-দুর্নীতি এবং প্রতারণার মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার আশায় দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। সরকারি নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু কর্মকর্তা এবং অনেক অযোগ্য চাকরিপ্রার্থী দেশের নিয়োগ দুর্নীতির প্রধান উৎস।

ইকবাল মাহমুদ মনে করেন, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং ভবিষ্যতে দুর্নীতির নতুন উৎস বন্ধ করতে দুদকের এসব সুপারিশ কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, ‘আমরা একটি বাস্তবমুখী শিক্ষাব্যবস্থা দেখতে চাই। আমরা চাই, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কিছু করতে পারার মতো শিক্ষা নিয়ে বড় হোক। এ জন্য কোয়ালিটি শিক্ষক তৈরি করা দরকার। তাঁদের বেতন ও সুবিধা বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে প্রশিক্ষণের মান। এ জন্য প্রাইমারি শিক্ষকের ক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষক প্রথম শ্রেণি ও অন্যান্য শিক্ষক দ্বিতীয় শ্রেণি করে পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছি। একই সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার কথাও বলা হয়েছে।’

উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গে সুপারিশে বলা হয়, এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষায় পাওয়া গ্রেডিং পয়েন্ট বিন্যাস করে একটি বেঞ্চমার্ক (মান) নির্ধারণ করা জরুরি। নির্ধারিত মানের কম নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীরা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল, চিকিৎসা ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবেন না। তাঁদের বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষা, যেমন: পলিটেকনিক, মনোটেকনিক এবং ভকেশনাল শিক্ষার সুযোগ দিয়ে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদে পরিণত করা যেতে পারে। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এনে তরুণদের সুশিক্ষিত করে সক্ষম এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা সম্ভব হবে। এর জন্য প্রতি জেলা-উপজেলা, শহর অথবা মহানগরীর পর্যাপ্ত বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢেলে সাজানোর মহাপরিকল্পনা এখনই নিতে হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চশিক্ষার বিষয়ে দুদক যে সুপারিশ করেছে, সে ধরনের পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী অনুসরণ করা হয়। মেধামনন চর্চার অধিকারীরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পান। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসডিজিতেও মৌলিক শিক্ষা ১২ বছরের। এখানে দক্ষ মানবসম্পদ গড়তে কারিগরি শিক্ষার যে সুপারিশ করা হয়েছে, সেটা করতে গেল যে সমস্যা পড়তে হবে, তা হলো ভালো প্রতিষ্ঠান এবং প্রশিক্ষকের অভাব। এখনই এ ক্ষেত্রে নজর দেওয়া জরুরি। সবার আগে শিক্ষায় বিনিয়োগের ওপর জোর দেন তিনি। তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো, শিক্ষায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আমাদের অবস্থান নিচের দিকে। আর বাজেটে যে বরাদ্দ আছে, সেটার যথাযথ ব্যবহার নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

মেধাবী ও মননশীল মানবসম্পদ তৈরির জন্য প্রশ্নপত্র ফাঁস এখনই বন্ধ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে সংস্থাটি। প্রশ্নপত্র ফাঁসকে দুর্নীতির মাত্রায় নতুন সংযোজন বলে মনে করছে দুদক। কিছু কিছু ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে কিছু দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি কর্মকর্তা ও শিক্ষকের এ ধরনের অপরাধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ সরকারি প্রেস (বিজি প্রেস), ট্রেজারি এবং পরীক্ষা কেন্দ্রের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে কোচিং সেন্টার, প্রতারক শিক্ষক ও বিভিন্ন অপরাধী চক্র জড়িত রয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ ধরনের অপরাধ দমনের চেয়ে প্রতিরোধকেই উত্তম বলে মনে করছে দুদক। তাই এর প্রতিরোধে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।

প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে দুদকের সুপারিশ
১. প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটিতে মেধাবী, সৎ এবং মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষক বাছাই করে নিয়োগের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
২. প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটিতে ইংরেজি অনুবাদের জন্য একজন অনুবাদক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
৩. প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও বিতরণে যাঁরা থাকবেন, তাঁদের কাছ থেকে অঙ্গীকারনামা নিতে হবে। যাঁদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকবে, তাঁদের মনোনয়ন দেওয়া যাবে না।
৪. প্রশ্নপত্র প্রণয়ন-সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত মডারেটরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে।
৫. বিশেষ লক-সংবলিত বক্সে করে মাধ্যমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রতিটি ট্রেজারিতে প্রশ্নপত্র পাঠাতে হবে। এই তালা জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে খোলা হবে এবং একই পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রশ্নপত্র উপজেলা পরীক্ষা কেন্দ্রে পাঠানো যেতে পারে। 
৬. পরীক্ষা কেন্দ্রের সংখ্যা যত দূর সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় সর্বোচ্চ দুটির বেশি পরীক্ষা কেন্দ্র রাখা সমীচীন হবে না। কেন্দ্রগুলো উপজেলা শহরেই থাকা বাঞ্ছনীয়।
৭. প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা আইনে মামলা করাসহ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা (যেহেতু অবৈধ অর্থের লেনদেন হয়) অথবা তথ্য যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে মামলা করা যেতে পারে। এসব অপরাধে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সংশ্লিষ্ট থাকলে দুদক এসব মামলা অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগে দুদক আইনে মামলা করতে পারে।
৮. পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন হতে হবে সৃজনশীল ও বর্ণনামূলক। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষায় বিদ্যমান বহুনির্বাচনী প্রশ্ন প্রণয়ন পদ্ধতি বাতিল করা যেতে পারে।

এখনকার পরিপ্রেক্ষিতে বহুনির্বাচনী প্রশ্ন বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছেন রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি বলেন, বহুনির্বাচনী প্রশ্ন শ্রেণিকক্ষভিত্তিক মূল্যায়নে বড় ভূমিকা রাখে। এখন বহুনির্বাচনী প্রশ্নের অপব্যবহার হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top