জলবায়ু নয়-জ্বলজ্যান্ত খাদ্য অপচয়ে বিশ্বে খাদ্যাভাব
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
করোনা পরবর্তী বিশ্বে নানা খারাপ উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করেছে। মানুষ হয়ে পড়েছে অলস, অকর্মণ্য, রোগা ও ভীতু। মনের বল হারিয়ে দেহের শক্তিও আর ফেরাতে পারছে না অনেকে। করোনায় নাকাল অসহিষ্ণু মানুষ বেপরোয়া আচরণ করছে কোথাও, কোথাও হয়ে যাচ্ছে দিশেহারা। অপরাধ প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি কর্মহারা মানুষ ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের অপারগতায় জীবনী শক্তি খুইয়ে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে। পুষ্টিকর খাবার উৎপাদন ও সরবরাহ কমে গছে। বিশ্বব্যাপী আরও কমেছে শস্যদানার উৎপাদন। আমাদের দেশ সহ অনেক দেশে নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। সারা বিশ্বে জাতিসংঘ এজন্য হুঁশিয়ারী দিয়ে চলেছে।
আমাদের দেশে ভাত প্রধান খাদ্য। সেই ভাত কম খাওয়া নিয়ে আবার কথা বলাবলি শুরু হয়েছে। তাই বিষয়টি একদিকে খুব চিত্তাকর্ষক ও অন্যদিকে অতি গুরুত্ত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। ভাত শর্করা জাতীয় খাদ্য। ভাত শরীরে শক্তি যোগায়, কায়িক পরিশ্রমে গায়ে বল দেয়। এজন্য গতর খাটা মানুষ ভাত একটু বেশী খায়। গৃহস্থের ঘরে ঘরে ভাত ফুরিয়ে গেলে অভাববোধ তৈরী হয়। এ অবস্থা দেশের অনেকের মধ্যে একই সংগে শুরু হলে প্রধান খাদ্যের সংকটে দাম বৃদ্ধি পেয়ে বাজার গরম হয়ে উঠে এবং মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণহীনতা ও আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় মঙ্গা পরিস্থিতি তৈরী হয়। এ নিয়ে রাজনীতিও জমে ব্যাপক।
অনেক দিন আগে গ্রামের মানুষ রুটি খেত না। আমদানী করা গমের আটার মূল্য চালের অর্ধেক ছিল। যাদের ঘরের ধান পরিয়ে যেত তারা ’ভাত ফুরিয়েছে’ বলে খুব লজ্জা পেত। এখনও অনেক গৃহস্থ ঘরে ভাত ফুরিয়ে গেলে খুব লজ্জা পেতে হয়। ভাত ফুরালে সমাজে তাদের অসম্মান হয়। গৃহস্থ ঘরে চাল কেনাটা অপমানজনক। তাই তারা হাটে-বাজারে চাল কিনতে যায় নিজেকে লুকিয়ে। গোলার ধান বা ভাত ফুরিয়ে গেলে নিজেদের অভাব প্রকাশ পাবার ভয়ে অনেকে সেকথা কাউকে বলতে চায় না।
এখন দিন বদল হয়েছে। মানুষ গমের আবাদ করছে। আটার দাম চালের চেয়েও বেশী। তবুও এখনও অনেক গ্রামের মানুষ রুটি খাওয়া পছন্দ করে না। তারা তিনবেলা ভাত-ই খেয়ে থাকে। দেশে আশির দশকে শ্যালো বা গভীর নলকূপের পানিতে স্কীমের আবাদের পূর্বে শুধু আমনের আবাদ হতো। কোন কারণে খরা বা বন্যা হলে বছরের শস্যের আবাদ নষ্ট হয়ে যেত। তখন শুরু হতো অভাব।
পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে আমাদের এই জনপদে গ্রামীণ যৌথ পরিবারগুলোতে গড়ে ৮-১০ জন নির্ভরশীল সদস্য দেখা যেত। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বলে তখন কোন কর্মসূচি ছিল না। পৃথগন্ন পরিবার সৃষ্টি হতে থাকলে পৈত্রিক জমি ভাগাভাগির মেরুকরণ প্রক্রিয়ায় জমির পরিমাণ কমে যায়। পরিবারের সদস্য সংখ্যাও বাড়তে থাকে। অনেকে আবাদী জমিতে বসতবাড়ি তৈরী করে ও জমির ‘আইলের’পরিমাণ বেড়ে যায়। এদেশে কৃষি প্রধান উপজীব্য হলেও অগণিত নদীভাঙ্গা মানুষের বাস্তুুভিটা নেই। অনেকের ভিটা থাকলেও কৃষিজমি নেই। খাস জমি বিতরণের ফলে ভূমিহীন কিছুটা কমলেও চারভাগের একভাগ মানুষ ভূমিহীন (কৃষিশুমারী ২০১৯)। গ্রামীণ ভূমিহীনরা অন্যের জমিতে শ্রম বিকায় অথবা বর্গাচাষ করে।
একসময় চৈত্র ও কার্তিক মাসে সাধারণত: ছোট ও প্রান্তিক কৃষকের ঘরের ধান-চাল ফুরিয়ে যেত। তারা হাত পাততো মহাজনের নিকট। জমি বন্দক বা বিক্রি করে ভাত কিনে খাওয়া শুরু হতো। চারদিকে অভাব শুরু হলে চালের দাম বেড়ে যেত। বিদেশ থেকে সাদা মোটা আতপ চাল ও গম আমদানী করে খাদ্যাভাব মেটানো হতো। দুর্ভিক্ষের একসময় লঙ্গরখানা খুলে গমের আটার মোট মোটা রুটি তৈরী করে বিতরণ করা হতো। ভাতের অভাবে লঙ্গরখানায় রুটি খেতে যাবার বছরগুলোতে খাদ্যাভাবের সাথে ‘পেটের ভোক’শব্দটির কথা ছড়িয়ে পড়ে। এটাই কোন কোন এলাকায় ‘মঙ্গা’ নামে পরিচিতি পায়।
এরপর ভাতের উপর চাপ কমাতে বেশী করে আলু খাবার পরামর্শ দেন অনেকে। আশির দশকের শুরুতে শ্যালো বা গভীর নলকূপের পানিতে স্কীমের আবাদের প্রচলণ শুরু হলে ধানের ফলনে প্রাচুর্য দেখা দিতে শুরু করে। দেশে চালের দাম কমে যায় ইরি ধানের আগমনে। খরিফ মৌসুমে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে হাইব্রীড ধানের আবাদ শুরু হলে ধানের দাম কমে যায় ও তিনবেলা ভাত খাবারের সহজলভ্য উপায় তৈরী হয় খেটে খাওয়া মানুষের জন্য। একই সাথে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি চালু হয় ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে।
কিন্তু বিগত বছরগুলোতে উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক জলধারা, নদী, বন, আবাদী জমি ইত্যাদি ধ্বংস করার ফলে ফসলের আবাদ কমতে থাকে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ব্যাপক হারে প্রাকৃতিক দুর্যোগে নষ্ট হতে থাকে সারা পৃথিবীর খাদ্য উৎপাদন। মরু ও নিচু সামুদ্রিক এলাকা পরিবেষ্টিত দেশগুলোতে খরা, বন্যা, জলোচ্ছাস, পঙ্গপালের আক্রমণ প্রভৃতিতে ব্যাপক ফসলহানি ঘটে।
অপরদিকে ধনী দেশগুলাতে বছরে নষ্ট করা হয় বছরে ১০০ কোটি টনেরও বেশী খাদ্যদ্রব্য । দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনের উদ্বৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, “সারাবিশ্বে বেশিরভাগ বাড়িতে একজন ব্যক্তির বছরে খাবার অপচয়ের পরিমাণ গড়ে ৭৪ কেজি। যুক্তরাজ্যের প্রতিটি বাড়িতে অপচয় করা হয় প্রতি সপ্তাহে একটি পরিবারের আট বেলার খাবার। মোট খাবার অপচয়ের ১৭ শতাংশ হয় রেস্তোরাঁ ও দোকানে। কিছু খাবার নষ্ট হয় কারখানা ও সাপ্লাই চেইনে।”এর অর্থ হলো, মোট খাবারের এক-তৃতীয়াংশ কখনও খাওয়াই হয় না (আমাদের সময়.কম ৬.৩.২০২১)। তাই অনেকে বলছেন, জলবায়ু নয়- জ্বলজ্যান্ত খাদ্য অপচয় বিশ্বের খাদ্যাভাবের মূল কারণ।
দুর্নীতি বেড়ে গেলে আয় বৈষম্য সৃষ্টি হয় ও দরিদ্র মানুষ স্বাভাবিক ক্রয়ক্ষমতা হারালে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে থাকে দেশে দেশে। পুষ্টিহীনতায় সাব-সাহারা, এশিয়ার নিম্নাঞ্চল ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশে শিশু ও মাতৃমৃত্যু বেড়ে গেছে এর কারণে। এরই মাঝে করোনার প্রভাবে গত দুবছরে সারা পৃথিবীতে শস্যদানা ও পুষ্টিকর খাবার উৎপাদনের পরিমাণ কমে গেছে। চাকুরী ছাঁটাই ও কর্মহীনতায় দারিদ্র বেড়ে গেছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গিয়ে ভীষণ নাজুক পরিস্থিতিরি সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে, মজুতার ও প্রতারক শ্রেণির লোকেরা অতিরিক্ত লাভ ও লোভের নেশায় দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে।
এমতাবস্থায় অনেক ত্যাগ স্বীকার করে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করা হলেও এখনও করোনার তৃতীয় ঢেউ নতুন করে ভয়াল থাবা বিস্তার করে চলেছে। ইউরোপের আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতিতে পুনরায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। স্কুল খোলা হলেও কোরিয়া ও জাপানে ফাইজারের ২য় ডোজ টিকা নেবার পরও মৃত্যুর ঘটনায় পুনরায় সেসব স্কুল বন্ধ ঘোষণার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
নভেম্বরে এসে উপমহাদেশে অপেক্ষাকৃতভাবে ভাল সময় পর্যবেক্ষণ করা গেলেও অতি উদাসীনতা ও অবহেলায় করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের গতি-প্রকৃতি নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করার সময় তৈরী হয়নি।
আমাদের দেশে খাদ্যের উৎপাদন বেড়েছে। তবু কেন খাদ্যাভাব? বাজারে খাদ্যদ্রব্য ও তৈজষপত্রের সরবরাহে ঘাটতি নেই, তবু কেন সংকট? লক্ষ লক্ষ টন খাদ্যশস্য গুদামে মজুদ করা আছে বলে তথ্যে দাবী করা হচ্ছে। তবুও কেন ক্ষুধার সময় ভাত কম করে খেতে বলতে হবে?
ব্যাপক আয় বৈষম্যে ও শহর-গ্রামের মানুষের মধ্যে জীবনযাত্রায় ব্যাপক ভিন্নতা খাদ্যগ্রহণের ক্ষেত্রেও নানা ফাঁরাক তৈরী করেছে বিশ^ব্যাপী। শহরের বিত্তশালি পরিবারের স্বাস্থ্যবান শিশুকে তোয়াজ করে দামী খাবার খাওয়ানো যায় না। অথচ গ্রামের শিশুরা ভাতের নাগাল পেতে হিমশিম খাচ্ছে। শহরে হচ্ছে একম্রেণির মানুষের বাহারী বিলাসী খাদ্যে খাবারের নামে পুষ্টিমানের অপচয় আর বস্তিতে ও গ্রামে হচ্ছে পুষ্টিমাত্রা গ্রহণের অভাব। গ্রামের প্রান্তিক কৃষক-মজুররা দুধ, ডিম উৎপাদন করে নিজে না খেয়ে অর্থের প্রয়োজনে শহরের বাজারে চালান বা বিক্রি করে দিয়ে ভাত-রুটি কিনে আনে।
ধনী দেশে খাদ্যের অপচয় ব্যাপক। তারা খাদ্যদ্রব্য আমদানী করে। যেমন আমাদের দেশের ইলিশ মাছ কানাডা, আমেরিকায় যে দামে বিক্রি হয় তার চেয়ে আমাদের দেশের বাজারে ইলিশের বেশী দাম। ধনী দেশের মানুষের ঘরের ফ্রীজে রাখা খাবারের মেয়াদ পার হয়ে যায়। নতুন কিনে বাসী-মেয়দোত্তীর্ণ খাবার ডাষ্টবিনে ফেলে দেয়।
আরবের শেখরা একটি আস্ত দুম্বা বা উটের রোষ্ট পাতে নিয়ে সামান্য খেয়ে বাকীটা অপচয় করে। করোনায় ভিক্ষুকদের ভাঙ্গা থালা বা হাত ধনীদের তালা দেয়া দুয়ারের বাইরে রয়ে যায়। ফলে দান বা সাহায্য কিছুই সম্ভব না হওয়ায় ভিক্ষুক ও নিম্ন আয়ের মানুষের কাছ সেগুলো অধরা থেকে অভাবকে আরো কঠিন করে তুলেছে। করোনার খারাপ প্রভাব দরিদ্রকে আরো দরিদ্র করেছে। করোনাভীতি খাদ্যহীনকে তালাবদ্ধ ধনীর দরজায় ফিরিয়ে দিয়ে আরো ক্ষুধা কাতর করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।
জলবায়ুর প্রভাবকে ঠেকিয়ে মানুষ কৃত্রিম পদ্ধতিতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ালেও সেগুলোর মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে গরীবের নাগালের বাইরে চলে গেছে। সাম্প্রতিক ইউএনএফসিসি আয়োজিত ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ (কপ-২৬)’ সম্মেলনে সেকথা মোটেও গুরুত্ত্ব পায়নি। দরিদ্র দেশের মানুষ কপ-২৬-এ যোগদান করলেও তারাও সেসব দেশের ধনীক শ্রেণি ও পাঁচতারা হোটেলে থাকা এবং বিলাসীখাদ্য ভক্ষণে অভ্যস্ত শ্রেণি পেশার। আসল অভাবী মানুষ সে সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেনি, সেখানে বক্তব্য দেবার সুযোগ নেই তাদের।
জলবায়ুর প্রভাবে যতটুকু ক্ষতি হচ্ছে তার চেয়ে হাজার গুণ বেশী ক্ষতি হচ্ছে বিত্তশালীদের খাদ্যবিলাস, দরিদ্র মানুষের প্রতি কার্পণ্য, অবহেলা ও কোটি কোটি টন খাদ্য অপচয়ের দ্বারা। তাই জলবায়ু নয়- জ্বলজ্যান্ত খাদ্য অপচয় বিশ্বে খাদ্যাভাব সৃষ্টির মূল কারণ। এই অবিবেচক ও হৃদয়হীন মানুষগুলোর খাদ্যঅপচয় ঠেকানোর জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো উচিত।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd
সাম্প্রতিক মন্তব্য