বই গতিহীন জড়বস্তু নাকি অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন
জালাল উদ্দীন বাবু।।
আমরা অনেকেই দেখি মানি বিশ্বাস করি ‘বই’ সুবোধ, সরল, গোবেচারি, অকেজো, গতিহীন, বোবা, প্রানহীন, জড়বস্তু। এর জায়গা গাছের নিভৃত ছায়ায়, বোকা লোকের বগলে, লাইব্রেরী গুলোর নির্জন প্রকোষ্ঠে, কিংবা বিদ্যালোয়ের শান্ত পরিবেশে অথবা বাড়ির এ কোনায় ও কোনায় পড়ে থাকা ধুলি ধূসরিত জঞ্জাল। না যায় ফেলে দেয়া, না লাগে কোনো কাজে। অবাস্তব কল্পনার বিলাস ছাড়া কিছুই নয় । বিভিন্ন কাজে সংগ্রামরত গতিশীল মানুষের কাছে বই সময় অপচয়ের উপকরন ছাড়া আর কিছুই নয়।
আসলেই কি তাই? ইতিহাস কি বলে ? বই এর যে অলৌকিক ধ্বংস বা সৃজনশীল ক্ষমতা বিদ্যমান, মানুষের গতিশীল বা গতিহীন পথ কে মুহূর্তে পরিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার; সবচেয়ে সচল, সবচেয়ে গতিশীল বস্তু এই বই যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের এই পৃথিবীকে ধাবিত করেছে কখনো ভালোর দিকে কখনো মন্দের দিকে। তার খবর আমরা কয়জন, কতটুকু রাখি?
সাধারন মানুষ না জানলেও অত্যাচারী, একনায়কী, ফ্যসিস্ট শাসক মাত্রই জানতেন বই এর আশ্চর্য বিধ্বংসী ও সৃষ্টিশীল ক্ষমতা সম্পর্কে। তাই তারা কণ্ঠরোধ করেছে প্রবলভাবে বিরুদ্ধবাদী মতবাদের। নিষিদ্ধ করা হয়েছে, পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে কিংবা যে কোনো উপায়ে ধবংস করে দেওয়া হয়েছে বিরুদ্ধ মতবাদের বই। সেই সাথে সুকৌশলে অত্যন্ত চাতুর্যতার সাথে প্রচার করে কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে স্বপক্ষীয় মতবাদের বই। এর হাজারো স্বাক্ষর রয়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তাইতো বই এর বিস্ময়কর ক্ষমতা, বিস্ফোরনী ক্ষমতা সম্পর্কে অত্যাচারী শাসক মাত্রই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন ।
কিন্তু কিভাবে নির্ধারিত হবে বই এর প্রভাব? কিভাবে নির্ণয় করবেন জড় বস্তু ‘বই’ এর উত্তাপ? অনেক চিন্তা করে বের করা হয় সমকালীন যুগের প্রতিক্রিয়া হতে পারে বইটির উত্তাপ নির্ণয় এর মাপকাঠি। সেটা হতে পারে সুপ্রভাব বা কুপ্রভাব, হতে পারে বই এর স্বপক্ষে বা বিপক্ষে। সমকালীন সময়ের পত্র-পত্রিকা, বা দলবেঁধে বই এর পক্ষে বা বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মানুষের চিন্তন শক্তি ও মননশীলতাকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছে। ঝড় তুলেছে মানুষের হৃদয়ে যার সুস্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায় সমাজে, ঐতিহাসিকদের বর্ণনায়, বিভিন্ন পুস্তিকায়, সাহিত্য সমালোচনায় বা কারো জীবনীতে । কখনো কখনো সেই বই এর সাথে বা বইটির চিন্তা ধারার সাথে স্ব স্ব সময়ের মানুষ মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তারমানে বইগুলোর সাফল্যের মুল রহস্য হলো প্রকাশের সময় উপযোগীতা।
কি সেই বই! কোন গুলো সেই গ্রন্থ! আদৌ কি আছে এমন গ্রন্থ? যা মানুষের মন কে দোলা দিয়ে এগিয়ে দিয়েছে পৃথিবীকে । বিভক্ত করেছে দেশ কে, সমাজ কে । কিংবা পৃথিবীবাসী কে দিয়েছে জ্ঞান, বিজ্ঞান, মানবিকতায়, সাহিত্যে এক ভিন্ন যুগ। আসুন আমরা জানি এমন কিছু গ্রন্থ নিয়ে। সত্যই কতটা ঝড় তুলেছিল এই পৃথিবীতে।
আল কোরআন
যদিও এটি একটি ধর্মগ্রন্থ, যদিও পৃথিবীর প্রায় এক পঞ্চমাংশ মানুষ এর অনুসারী তবু গ্রন্থের বিচারেও এর মান অসীম তা ২/১ টি কথাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে বলে আমি বিশ্বাস করি। প্রায় ১৪শত বছর আগে কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকেই বিশ্বের সবচেয়ে পঠিত ও বিক্রিত গ্রন্থ হচ্ছে এই আল কোরআন। আবার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রতি ৫ মিনিট এ কোরআন এর বিরুদ্ধে একটি বই লিখিত হয়। তাহলে বুঝতেই পারছেন পক্ষে হোক এবং বিপক্ষে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে এই ঐশী গ্রন্থটি।
তবে পৃথিবীতে কোনো বই সত্যিকারের বিপ্লব এনে থাকলে তা এনেছে এই আল কোরআন। আইয়ামে জাহেলিয়াতের সেই যুগে এই যুগের মৌলিক চিন্তার বিপ্লব এনেছে । অন্যদিকে যাবতীয় মিথ্যা মতবাদ থেকে রক্ষা করেছে দিশেহারা মানবজাতিকে । এ গ্রন্থেই রয়েছে রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যাক্তি জীবনের আদর্শের সন্ধান। এর গর্ভে লুকিয়ে আছে সমস্ত সুচিন্তন ও মিথ্যা ধ্বংসকারী বিপ্লবের বীজ।
আসলে আইয়ামে জাহেলিয়াতের সেই ভয়ানক অন্ধকার যুগে মরুর বুকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন দিশেহারা মানুষকে শান্তির সুবাতাস দিয়েছে এই গ্রন্থ যা আজকের যুগে চিন্তা করাও কঠিন। মানুষের অনুভূতি যখন দিশেহারা, মানবাত্মা যখন অন্ধগলির পথের রেগুলার পথিক, মানুষ আর মনবতা যেখানে নিপীড়িত, নির্যাতিত প্রতিনিয়ত; সেই সময় সেই সমাজে আলোর দিশা হিসেবে সামনে আসে এই গ্রন্থের অমিয় বাণী এবং বিপ্লব আনে শুধু সমাজে বা রাষ্ট্রেই নয় মানুষের অন্তরের গভীরে। শুধু তাই নয় গ্রন্থ হিসেবেও যেন নিয়ন্ত্রন করছে শুধু বর্তমান নয় ভবিষ্যতকেও।
কোরআন একাধারে ধর্মগ্রন্থ, জীবনীগ্রন্থ, শিশু, কাব্য ও গদ্য সাহিত্য, নীতিশাস্ত্র, আইনশাস্ত্র, রাষ্ট্রতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বিজ্ঞানের সকল রহস্য উদ্ঘাটনের চাবিকাঠি। শুধু তাই নয় মানব মনের অপূর্বশক্তি, সম্ভাবনা, সংগ্রাম, বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিকতা বিবৃত হয়েছে। তৌহিদ বা একত্ববাদ, আত্মার অমরতা, সাম্য-মৈত্রী, স্বাধীনতা, নারীজাতির মানোন্নয়ন এমন কি নভোবিজ্ঞান ও রয়েছে এতে। যাকে ঘোষণা করা হয়েছে পূর্ণাংগ জীবন বিধান হিসেবে।
পরিশেষে বলা এই যে, কোরআন একটি বিশ্বগ্রন্থ। এত সংক্ষিপ্ত পরিসরে এর বিবরণ কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। আবার বর্ণনা করে সম্ভব না এর মাধুর্য ও বৈশ্বয়ীকতা। এটা বোঝা সম্ভব শুধুই হয়তোবা অনুভবে, হৃদয়ে।
নিকোলো ম্যকিয়াভেলী এর ‘দি প্রিন্স’ (ক্ষমতা ও রাজনীতির তত্ত্বকথা)
শয়তানী, শঠতা, নিষ্ঠুরতা, মিথ্যাচার, ধূর্ততা চতুরতা, পাপাচার যেন ম্যাকিয়াভেলীর পরিপূরক শব্দ। পৃথিবীর মানুষ তাকে ধরেই নিয়েছে নীতিজ্ঞান বিবর্জিত, অসাধু, খল, প্রবঞ্চক রাজনীতিকের প্রতীক হিসেবে। এসব রাজনীতিকদের মুল তত্ত্ব “উদ্দেশ্যই সিদ্ধিলাভের চরম কথা সেখানে নৈতিকতার গুনাগুন ধর্তব্যের বিষয় নয়” । ম্যকিয়াভেলীর এমন কুখ্যাতির মুলে ছিল মাত্র একটি বই নাম ‘দি প্রিন্স’।
১৫১৩ সালে লিখিত বইটি লেখকের মৃত্যুর ৫ বছর পর ১৫৩২ সালে প্রকাশিত হয়। তার মুল বক্তব্য ছিল,
“মুখে রাজনীতিকরা যত আদর্শই প্রচার করুক না কেন সবক্ষেত্রে তাদের রাজনীতির মুলে রয়েছে ব্যক্তিগত লোভ ও সবার্থপরতা” ।
১৫২৭ সালে মৃত্যুর পুর্বে তিনি রচনা করেন “দি প্রিন্স, দি ডিসকোর্সেস, দি আর্ট অব ওয়ার, দি হিস্ট্রি অব ফ্লোরেন্স” । যে গুলোর মুল বিষয়বস্তু ছিলো যুদ্ধ আর রাজনীতি। সেই সময় তার দেশ ইতালির যে করুন দশা ছিলো সেই ভাবাবেগ, সেই প্রাণের স্পন্দন চেপে রেখে অশ্রু সংবরণ করা একজন দেশপ্রেমিক এর জন্য কঠিন ছিলো। সেই কঠিন সময়ের পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে রচিত বইগুলো তাকে ‘রাজনীতি বিজ্ঞানের জনক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
‘দি প্রিন্স’ এর মুল বক্তব্য ছিলো, “রাজ্যের উন্নতির জন্য যে কাজই করা হোক না কেনো তাতে কোনো অপরাধ হয় না”।
তাই এই বইটিকে বলা হয়েছে শাসকদের পথ নির্দেশক । অনেকের মতে অত্যাচারী শাসকের হাতে খড়ির কেতাব। কিভাবে ক্ষমতা লাভ করতে হয়? কিভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে হয়? কিভাবে ক্ষমতার ভিত মজবুত করতে হয়? কিভাবে বিপ্লব, বিদ্রোহ ও বিদেশী আক্রমন প্রতিহত করা যায়? দেশকে নিরাপদ করতে যে দৃঢ়তা দরকার তা কিভাবে অর্জন করতে হয়? তার সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা রয়েছে। দি প্রিন্স এর বিখ্যাত কিছু কথা-
“যে শাসক অবৈধভাবে জোর করে রাষ্ট্র চালাতে চাই তার কাজ হলো অবশ্যম্ভাবী দ্রুত আঘাত হানা যেন বারবার এ কাজ করতে না হয়”।
“জনতার চিত্ত দুর্বল তাই আঘাত কর দ্রুত। আর রাজ্যের শান্তি ও বিশ্বাসের কাজ গুলো করো আস্তে আস্তে ধীরে ধীরে যেন জনগন সেটা পরিপূর্ণ ভাবে উপলদ্ধি করতে পারে “।
‘অপরের সম্পত্তি থেকে দান করলে নিজের সুনাম কমেনা বরং বাড়ে’
‘প্রজার ওপর ভরসা করে যে ইমারত গড়া হয় তা বালির ওপর প্রাসাদ গড়ার সমতুল্য’
‘জনগনের ভালোবাসা আর ভয় দুটো দিকের মধ্যে একজন রাজাকে “ভয়” টা বেছে নেয়া নিরাপদ’
‘সত্যরক্ষা যেমন প্রশংসনীয় তেমনি রাজ্য চালাতে শঠতা, প্রবঞ্চনা ও বিশ্বাস ভঙ্গের প্রয়োজনীয়তাও অপরিসীম’
‘জনগন কে দাবিয়ে রাখার দুটি উপায়; একটি আইন, অন্যটি জোর। প্রথমটি মানুষের দ্বিতীয়টি পশুর। একজন রাজাকে দুটোই সুচারু রুপে ব্যবহার করতে জানতে হয়’
এর উল্টো মতবাদ ও আছে কিছু যথা-
‘প্রজা যেন রাজাকে ঘৃণা না করে সেদিকে চরমভাবে খেয়াল রাখতে হবে’
‘রাজার উচিত গুণীর কদর করা। শিল্পকলার লোকদের সম্মানিত করা’
‘প্রজাদের মনে শান্তি বজায় রাখতে চাষাবাদ ও বাবসা বাণিজ্যে যেন সাবলীলতা থাকে’
‘করের বোঝা যেন না বাড়ে’
১৫৩২ সালে বইটি প্রকাশ হওয়ার পর পরই এত কপি বিক্রি হয় যে ২৫ টি সংস্করন বের করতে হয় প্রকাশককে। কিন্তু এরপরই এলো ঝড়। যে রোমের মুক্তির জন্য প্রার্থনা করতেন সেই রোমেই প্রথমে নিষিদ্ধ হয় তার বই। তাকে নাস্তিক ঘোষণা করা হলো। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তার বই নিষিদ্ধ করা হলো। জার্মানিতে তার মূর্তি, কুশপুত্তলিকা দাহ করা হলো। ১৫৫৯ সালে তার সমস্ত রচনা নিষিদ্ধের তালিকায় পড়লো।
পরিশেষে বলা যায় রাজনৈতিক চিন্তা ধারায় ম্যাকিয়াভেলীর মত বিপ্লবাত্মক ঝড় তুলতে কেউ পারেনি। যদিও পৃথিবীর একনায়কেরা বইটিকে চিরকাল তাদের শাসন কার্যের সেরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে তবু বলা যায় বইটিতে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মত এমন কিছু শিক্ষনীয় বিষয় স্থান পেয়েছে যা সর্ব যুগের, সর্ব শতাব্দীর, সর্বকালের।
আলফ্রেড টি মাহান এর ‘দি ইনফ্লুয়েন্স অব সি পাওয়ার আপন হিস্ট্রি’ ও
জে ম্যাকিন্ডারের ‘দি জিওগ্রাফিক্যাল পিভট অব হিস্ট্রি’
সামুদ্রিক শক্তির প্রভাব বিস্তারকারী বই দুটিকে একদিকে বলা হয়েছে সুন্দর অন্যদিকে বলা হয়েছে বিপদজনক। বর্তমান পৃথিবীর নৌশক্তি গঠনে মাহান ও ম্যাকিন্ডারের এর অবদান অনন্য
স্থল মাত্রেই বাঁধা আর সমুদ্র মানেই উম্মুক্ত প্রান্তর। যে জাতি যত বেশি নৌ শক্তি দ্বারা সমুদ্র শাসন করবে সে তত বেশী পৃথিবীর সম্পদ শোষণ করবে এবং নিজের কাজে লাগাবে। এমন কথা বলার পর মাহান কে বলা হতো পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজনক লোক। মাহানের বইটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলো স্থল শক্তির চেয়ে সামুদ্রিক শক্তি বিপদজনক। তার এমন শিক্ষার ফলে উপনিবেশিকতার বিস্তারে যে শিখা চারিদিকে জ্বলছিল তাতে যেন তেল পড়লো। আর তাতেই সে শিখা দেখতে দেখতে বিস্তারিত হয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। সারা পৃথিবীতে উপনিবেশিকতার বিস্তার যেন নতুন রূপ পেল।
অ্যাডমিরাল মাহান তার বইতে বহু তথ্য প্রমান দিয়ে নৌ শক্তির ঐতিহাসিকতায় চুড়ান্ত অপরাজেয়তার প্রমান দেন।
বেশ কিছুকাল পরেই রাইট ভাতৃদ্বয় প্লেন আবিষ্কার করলে জে ম্যকিন্ডার মাত্র ২৪ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন ‘ইতিহাসের ভউগোলিক প্রানকেন্দ্র’ নামে। ২৪ পৃষ্ঠার পুস্তিকার যে ভাবধারা তা সারা পৃথিবীর রাজনৈতিক, সামরিক নেতা, অর্থনীতিবিদ, ভূগোলবিদ এবং ঐতিহাসিকগণের চিন্তাকে গভীরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।
তিনি তার শক্তির প্রাণকেন্দ্রিক অঞ্চল এর হিসেব দেখান ৫ টি মানচিত্রের সাহায্যে। তিনি মাঞ্চিচিত্রে দেখান ভূ- হৃতপিন্ড যা পৃথিবী নামক দ্বীপের ঠিক মাঝখানে। যা দিয়ে গোটা পৃথিবী শাসন করা যায়। ঐতিহাসিক বিবৃতি সম্বন্ধীয় বইটি আসলে বর্ণনা করে বোঝানো সম্ভব নয়। সহজ ভাষায় বলা হয়েছে ২টি কথা।
১ম- ‘যে পুর্ব ইউরোপ শাসন করবে সে ভূ- হৃতপিন্ড শাসন করবে, যে ভূ- হৃতপিন্ড শাসন করবে সে পৃথিবীর দ্বীপ শাসন করবে, যে পৃথিবীর দ্বীপ শাসন করবে সে গোটা পৃথিবী শাসন করবে’।
২য়- ‘ যে বিমানপোত শাসন করে সে ভিত্তিভুমি শাসন করে , যে ভিত্তিভুমি শাসন করে সে আকাশ পথ শাসন করে, আর যে আকাশ পথ শাসন করে সে দুনিয়া শাসন করে’।
এই-ই ছিলো ম্যাকিন্ডারের মুল বক্তব্য। জে ম্যকিন্ডারের ধারনার ওপরই আধুনিক ভুগোলের ভিত্তিমুল প্রতিষ্ঠিত। তাই তাকে ‘ভউগোলিক রাজনীতির জনক’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
এডলফ হিটলার এর ‘মেইন ক্যাম্পফ (আমার সংগ্রাম)’
হিটলারের নাৎসী বাহিনী ১৯৩৩ সালে ক্ষমতা গ্রহনের পর এক যুগ যে কর্মকান্ড পরিচালনা করে তাতে গোটা পৃথিবী স্তম্ভিত হয়ে যায়। যার দায় বয়ে বেড়াচ্ছে আজও পৃথিবীর মানুষ। কিন্তু পৃথিবীবাসী যদি একটু কষ্ট করে হিটলার এর মেইন ক্যাম্পফ বইটি পড়তো তাহলে দেখতো হিটলারের এই বর্বর কর্মসুচির বিশদ বিবরন লিপিবদ্ধ রয়েছে এই বই এর পাতায় পাতায়। অনেকে এটাকে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে মারাত্মক গ্রন্থ হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন ।
বিশুদ্ধ রক্তের জার্মান জাতি গঠনে দৃপ্ত অঙ্গীকারাবদ্ধ হিটলার বরাবরই ঘৃণা করতো গণতন্ত্র নামের অবলার শাসন ব্যবস্থা কে । তার মতে
‘একশোজন নির্বোধ মিলে একজন বিজ্ঞজন হয় না তেমনি একশো জন কাপুরুষ মিলে কোনো বীরোচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না।‘
গনতন্ত্র কে বলতেন, মিথ্যা ও প্রবঞ্চনার নীতি।
তাইতো নাৎসি পার্টির প্রধান হয়ে উঠার পর পরই প্রথমেই সভ্যদের ভোটে পার্টির সিদ্ধান্ত গ্রহনের অর্থহীন, হাস্যকর প্রথা বাতিল করেন। ১৯২৩ সালে মিউনিখে এক ব্যার্থ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কারারুদ্ধ হন হিটলার। আর এই কারারুদ্ধই যেন পৃথিবীবাসীর এক দুঃসবপ্নের এক পরিকল্পনা রচিত হল যার নাম ছিল ‘মেইন ক্যাম্পফ’। প্রথমে বইটির নাম দেন “মিথ্যা, নির্বুদ্ধিতা ও কাপুরুষতার বিরুদ্ধে সাড়ে চার বছরের সংগ্রাম” ওটো টালিস্কাস নামে এক বিখ্যাত মনিষী বলেন,
‘বইটির ১০ ভাগ আত্মজীবনী, ৯০ ভাগ অবধারিত মতবাদ বা অনুশাসন বাক্য। তবে শতকরা ১০০ ভাগই প্রচারকার্য’।
হিটলার এর ‘মেইন ক্যাম্পফ’ এর প্রতিটি ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে সাধারন মানুষের প্রতি বিদ্বেষ আর ঘৃণা। জার্মানদের বিষয়ে তার মানসিকতা ছিল,
“জার্মান জাতি আর্য জাতি। অন্য কোনো নিকৃষ্ট জাতের সংমিশ্রণে একে জারজীকরণ হতে দেওয়া চলবে না। এমন হলে এটা এ জাতির পবিত্রতাহানি। জাতিকে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাতে এই রক্ত কে অমলিন ও পবিত্র রাখতেই হবে”।
তার জন্মভুমি অস্ট্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, “রাজধানীতে যে বিভিন্ন জাতের সংমিশ্রণ দেখলাম তাতে আমার মন ঘৃণায় বিষিয়ে উঠলো। চেক, পোল, সার্ব, ক্রেটরা হাজারো জাত যে জট পাকাচ্ছে তার সর্বত্র রয়েছে মানব জাতির চিরন্তন ব্যং এর ছাতা ইহুদি, আর ইহুদি, আরো ইহুদি” ।
আফ্রিকানদের সম্পর্কে বলেন, “একটা আধা বানর লোককে উকিল বানিয়ে তোলার চেষ্টার বাতুলতা একটা অপরাধ। আবার অন্যদিকে ইটেনটট ও কাফ্রী জুলুদের বুদ্ধিবৃত্তি ও সচকিত করে তুলতে শিক্ষিত করে তোলা প্রচেষ্টা একটা মহাপাপ” ।
হিন্দু জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বলেন, “ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়েছে বাস্তব পটভুমি বিবর্জিত বাক সর্বসব হামবড়া প্রাণী”।
তিনি সাধারন জনগণকে প্রচন্ড ঘৃণা করতেন। হিটলার এর ‘মেইন ক্যাম্পফ’ পাতায় পাতায় লিখেছেন এ সম্পর্কে। যেমন,
“মানুষ নির্বোধ একদল ভেড়ার পাল”।
“মানুষ নির্বুদ্ধিতার অবতার”।
তার গগনচুম্বী উচ্চাশা সফল করার জন্য ৩ টি পন্থা অবলম্বন করতেন। তা হলো প্রচারণা, কুটনীতি, ও বল প্রয়োগ।
প্রচারণায় হিটলার ছিলেন বিশ্বের সর্বশীর্ষে । এই সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে তার বিবৃতি এমন- “জনসাধারনের মধ্যে রয়েছে আদিম সরলতা। তাদের কাছে ছোট মিথ্যার চেয়ে বড় মিথ্যার কার্যকারিতা বেশি। জনসাধারন ছোট ছোট মিথ্যা বলেন। বড় মিথ্যায় তাদের মাথা কাটা যায়। তাই তারা বড় মিথ্যার প্রশ্রয় নেয় না। তাই মিথ্যা যত বড় জনসাধারনের বিশ্বাস করার ক্ষমতা তত বেশী”।
“তাদের বুদ্ধি অল্প কিন্তু বিস্মৃত হওয়ার ক্ষমতা বেশী। তাই প্রচারনার ক্ষেত্রে শেষ ব্যক্তিটি না বোঝা পর্যন্ত তোমার শ্লোগানের প্রচারণা চালিয়ে যাও”
“চতুর ও বিরামহীন প্রচারণার দ্বারা মানুষ কে বিশ্বাস করানো যায় স্বর্গ হচ্ছে নরক, আর নরক হচ্ছে স্বর্গ”
তাইতো হিটলার কে বলা হয়েছে প্রচারণা ক্ষেত্রের আধুনিক ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা। আর তার বই ‘মেইন ক্যম্পফ’ কে এই শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারধর্মী সাহিত্য হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
হিটলার বলতেন, ক্ষমতাই আক্রমনের স্বপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি।
ইহুদিদের প্রচন্ড ঘৃণা করতেন বলতেন, “ইহুদিরা পৃথিবীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ও বিনাশক”।
বইটি সম্পর্কে বলেছেন হাজারো সমালোচক। কেউ পক্ষে কেউ বিপক্ষে। তবে কিছু কথা না বললেই নয়। মেইন ক্যম্পফ এর প্রতিটি শব্দের জন্য মারা গেছে ১২৫ জন, প্রতিটি পৃষ্ঠার জন্য মারা গেছে ৪৭০০ জন আর প্রতিটি অধ্যায়ের জন্য মারা গেছে ১লক্ষ ২০ হাজার মানুষ। ক্ষমতা গ্রহণের এক যুগের মধ্যে ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করে তার নৃশংসতার চরম থেকে চরমতর স্বাক্ষর রাখেন। যার মেনুফিস্টো ছিল এই বই। বিশ্বের কোনো বই কে ঘিরে এমন নৃশংসতা বিশ্ববাসী অবলোকন করে নাই। এই বইটাকে জার্মানীর সাধারণ মানুষ ‘রাজনৈতিক বাইবেল’ হিসেবে গ্রহণ করে। নাৎসি বাহিনীর প্রতিটা ব্যক্তি ও সমস্ত চাকুরীজীবীর কাছে এর কপি ছিল। অবাক করা ব্যপার ছিল এই যে এই বইটিতে সরাসরি রাশিয়া ও ফ্রান্স কে আক্রমনের কথা উল্লেখ করা ছিল।
পরিশেষে বলা যায়, ‘মেইন ক্যাম্পফ’ এর প্রতিটি পাতা থেকে দুনিয়ার একনায়কেরা চিরদিনই তাদের কুমতলবের সমস্ত মুল খোরাক খুজে পেয়েছে । ভবিষ্যতের একনয়কেরাও পাবে। যেমন খুজে পেয়েছে গত চারশো বছর ধরে ম্যাকিয়াভেলির ‘দি প্রিন্স’ থেকে।
টমাস পেইন এর কমনসেন্স
১৭৭৬ সালে ১০ জানুয়ারী আত্মপ্রকাশ করে ‘কমনসেন্স’ । লেখকের জায়গায় লেখা ছিলো ‘জনৈক ইংরেজ কর্ত্রিক রচিত। ইংরেজ করতলে পরাধীন আমেরিকায় ২ শিলিং মুল্যের বইটি তিন মাসের মধ্যে বিক্রি হয় ১ লক্ষ ২০ হাজার কপি। সেই সময়ের সচেতন শিক্ষিত মানুষ বইটি পড়ে প্রমান করেন বইটি কতটা উন্নত ছিল। ছিলো কত টা গ্রহণযোগ্যতা। এই বইতেই পেইন ঘোষণা করেন,
“যুদ্ধ ছাড়া কোনো পথ নেই। এটা শহর , জেলা, বা প্রদেশের প্রশ্ন নয়, এটা অনাগত ভাবীকাল মহাদেশের প্রশ্ন। তাই স্বাধীনতা আমাদের লক্ষ্য এবং আমাদের মিলনের স্পন্দন”।
বইটি প্রকাশের পর পরই আমেরিকার অধিকাংশ রাষ্ট্র তাদের প্রতিনিধীদের সবাধীনতার স্বপক্ষে ভোট নির্দেশ দেন। বইটি প্রকাশের ৬মাস পেরুতেই ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই ফিলাডেলফিয়া স্টেট হাউজ এর কনটিনেন্টাল কংগ্রেস তার অধিবেশনে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। মাত্র একটি বই!! পাঠক ভেবে দেখেন।
সমসাময়িক পত্র পত্রিকা থেকে জানা যায়, হাজার হাজার মানুষ যারা স্বাধীনতার কথা শুনতেই পারত না ‘কমনসেন্স’ পড়ার পর তারাই হয়ে উঠে সেই দাবীর শ্রেষ্ঠ দাবীদার। অলৌকিক কান্ড ঘটানো বইটি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র শব্দটি ব্যবহারের প্রথম ব্যবহার করেন। আমেরিকার ‘স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার দাবীদার পেইন এর চাইতে বেশি আর কেউ নয়। কারন তার বইটি সুস্পষ্টভাবে আমেরিকার স্বাধীনতার সংগ্রাম কে উসকে দিয়েছিলো। সাহিত্যের ইতিহাসে ‘কমনসেন্স’ এর মত আর কোনো বই প্রকাশের সাথে সাথে এতখানি প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি।
পেইন কে বুঝতে তার একটি কথাই যথেষ্ট- ‘যেখানে স্বাধীনতার সংগ্রাম সেটাই আমার দেশ’
এন্ড্রু জ্যাকবস বলেন, ‘পেইনের জন্য হয়তো বাস্তবে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ হয়নি ঠিকই কিন্তু সমস্ত স্বাধীনতা প্রেমিকের অন্তরে তিনি স্মৃতিস্তম্ভ সৃষ্টি করেছেন’
হেনরি ডেভিড থরো এর ‘সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্স’ (আইন অমান্য)
ডেভিড থরো তিনি একজন প্রকৃতির তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষক, নির্জনতার প্রেমিক, সরল জীবনের ব্যখ্যকারক, সাধারন কবি ও দার্শনিক। ১৮৪৯ সালে তার লেখা এই বইটি প্রকাশ হলে কিছুই হয়নি। কিন্তু পরবর্তী একশ বছরে বইটির লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়। যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে।
টমাস জেফারসন বলেছিলেন, “যে সরকার সবচাইতে কম শাসন করে সেই-ই সর্বশ্রেষ্ঠ”
কিন্তু থরো জানালেন, “যে সরকার মোটেই শাসন করেনা সেই-ই সর্বশ্রেষ্ঠ”
তিনি আরো বলেন, “সকলের আগে আমাদের মানুষ হওয়া উচিত পরে প্রজা”
“ন্যয় ও সত্যের প্রতি যতটা শ্রদ্ধা থাকা দরকার আইনের প্রতি অতটা শ্রদ্ধা বাঞ্ছনীয় নয়”
শ্রেণী হিসেবে রাজনীতিবিদদের নিচু হেসেবে দেখতেন। তার মতে,
“অধিকাংশ আইনপ্রণেতা, উকিল, রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী স্রষ্টার স্থলে শয়তানের সেবা করে চলে”
“মানুষের অর্থের পরিমান যত বাড়ে পুণ্য তত কমে”
তিনি আইন অমান্যের প্রতীক হিসেবে অসমর্থ প্রজাদের কর দিতে অস্বীকার করাকে সমর্থন করতেন।
“সত্যি সত্যি ন্যয়ের বিচার করতে হলে শাসন ব্যবস্থা কে শাসিতের সম্মতি ও অনুমোদন লাভ করতে হবে”
“যতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্র ব্যক্তিকে তার চাইতে স্বাধীন ও উন্নত শক্তি বলে স্বীকার করবে না, স্বীকার করবে না যে তার ক্ষমতা ও প্রভুত্ব ব্যক্তির কাছ থেকে অর্জিত ততদিন পর্যন্ত সত্যকারের স্বাধীন ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র কখনই প্রতিষ্ঠিত হবে না”
সিভিল ডিস অবিডিয়েন্স এ ডেভিড থরো এর মুল বক্তব্য,
“ব্যক্তির জন্যি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তির নয়। নাগরিকের নৈতিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের কোনো অধিকার রাষ্ট্রের নেই। সর্বক্ষেত্রে মানুষের বিবেকই হবে তার সর্বশ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শক”।
হ্যারিয়েট বীচার স্টো এর ‘আংকেল টমস কেবিন’
আমেরিকায় ‘পলাতক দাস আইন’ পাশের পর দাসপ্রথা উচ্ছেদ নিয়ে উত্তর ও দক্ষিনের, কংগ্রেস সভ্যদের বা যাজকদের মধ্যে যে বিভক্তি দেখা দেয়, সেই বিভক্তির বিস্ফোরনে প্রয়োজন ছিলো সামান্য স্ফুলিঙ্গের। সেই স্ফুলিঙ্গ টুকু সরবরাহ করে ‘আংকেল টমস কেবিন’ নামের খুবই সাধারন একটি উপন্যাস। মানব দাসত্বের বিরুদ্ধে জেহাদ করার যে প্রবণতা তা সুদুর ইউরোপ থেকে সাগর পেরিয়ে উসকে দেয় এই ‘আংকেল টমস কেবিন’।
বইটিতে দাস আংকেল টম এর যে নির্মম জীবনের বর্ণনা করা হয়েছে তা অত্যন্ত প্রাণস্পর্শী। মানুষ হয়ে একজন দাস মানুষের জীবন কতটা নির্মমতায়, বিষাদ্গ্রস্ত, মনবতাহীন, জীবনহীনতায় ভরা তা মানুষ হিসেবে মানব জাতিকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে চরমভাবে।
বইটি প্রকাশের সময় এর সাফল্য নিয়ে কেউ ভাবেনি। সাধারন সাময়িকীতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের পর অনেকটা বিনা রয়ালিটিতে ‘স্টো’ প্রকাশককে ছাপানোর অনুমতি দেন। প্রকাশক ৫ হাজার কপি ছাপালে ১ম দিনে ৩হাজার কপি ২য় দিনে ৫হাজার কপি সব শেষ। পরবর্তী ১মাসে ১০ হাজার কপি। পরবর্তী ১বছরে শুধু আমেরিকাতেই বিক্রি হয় ৩লক্ষ কপি। প্রকাশক কোনভাবেই সামাল দিতে পারছিল না সেই সময় ৮টি ছাপা খানা ও ৩টি কাগজ কারখানা দিনরাত ব্যস্ত ছিলো বইটি ছাপানোর কাজে। পরবর্তীতে শুধু গ্রেট ব্রিটেনে বিক্রি হয় ১৫ লক্ষ কপি। সেই সময়েই ২২টি ভাষায় অনুদিত হয়। বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই যে দেশে এই বই এর কপি পৌঁছেনি। এই বই নিয়ে স্টো এর পুত্র- পৌত্ররা বলেন,
“এ যেন এক বিরাট অগ্নিকান্ডের সৃষ্টি করলো। সমস্ত আকাশ এক অপ্রতিরোধ্য আবেগের বন্যায় তার সামনের সব কিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। আর সে ঢেউ পৌঁছালো সাগরের এপার থেকে ওপারেও। শেষে মনে হলো কারো মুখে কোনো কথা নেই”
একটি পত্রিকা বইটিকে বলেছে, “কল্পনার সুমহান রাজ্যে এক জঘণ্য ব্যভিচার”
সত্যকে বিকৃত করার চরমতম অভিযোগ আনা হলো বইটির বিরুদ্ধে। দক্ষিনের মানুষেরা ‘স্টো’ কে ‘শয়তানের দোসর’ উপাধি দিলো। সেই সাথে দক্ষিণে অঘোষিত ভাবে নিষিদ্ধ করা হলো। উত্তরের মানুষের কাছে বইটি “দাস প্রথা মুক্তির সনদ” হিসেবে বিবেচিত হতে লাগলো। চার্লস সামনার নামে বিখ্যাত এক ব্যক্তি বলেন,
“আংকেল টমস কেবিন রচিত না হলে লিঙ্কন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন না”
শুধু এই একটি কথাতেই বোঝা যায় বইটির ক্ষমতা সম্পর্কে। শুধুমাত্র এই বইটির জন্যই আন্তর্জাতিক খ্যাতি পান ‘হ্যারিয়েট বীচার স্টো’।
সার্বিক ভাবে বোঝা যায় যে, ‘স্টো’ এর এই বইটি জাতীয় চেতনাবোধ ও মানিবীয় অনুভূতিকে মানব অন্তরে যতটা জাগাতে পেরেছিলো বিশ্বের ইতিহাসে আর কোনো বই ততটা জাগাতে পারেনি।
মানব জগত সম্পর্কীয় উপরোক্ত বই গুলোর সাথে আরও কিছু বই সংযুক্ত করা যায় যেমন অ্যাডাম স্মিথ এর ‘অয়েলথ অব নেশনস’, টমাস ম্যালথাস এর ‘এস এ অন দি প্রিন্সিপাল অব পপুলেশন’ মওলানা জালাল উদ্দিন রুমির ‘মসনবীয়ে রুমি’ প্রভৃতি বইগুলি শুধু স্ব স্ব সময়ই নয় এখনো এর বিপুল প্রভাব বিদ্যমান।
বিজ্ঞান জগতের কিছু বই আছে যা সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করছে বিজ্ঞান জগতকে। তার মধ্যে নিকোলাস কোপারনিকাস এর ‘ডি রিভল্যুশানিবাস অব বিয়াম সেলেসটিয়াম’ বাংলা ‘জ্যোতির্মন্ডলের আবর্তন’, উইলিয়াম হার্ভের ‘দি মোটু কডিস’ বাংলা ‘বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা বিদ্যার উদয়কাল’ স্যার আইজ্যাক নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটকা’ বাংলা ‘জাগতিক নিয়মাবলী’, চার্লস ডারউইন এর ‘অরিজিন অব স্পেসিস’ বাংলা ‘যোগ্যতমের বাঁচার অধিকার’, সিগমুন্ড ফ্রয়েড এর ‘দি ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস’ বাংলা ‘অবচেতন এর মনোবিজ্ঞানী’ আলবার্ট আইনস্টাইন এর ‘রিলেটিভিটিঃ দি স্পেসিয়াল এন্ড জেনারেল থিওরিজ’ বাংলা ‘আনবিক যুগের পথিকৃৎ’ অন্যতম।
এসব গ্রন্থগুলোতে বিজ্ঞানের অসামান্য আবিষ্কার দ্বারা বুঝিয়ে দিয়েছে, সত্যের উৎপত্তি যেখানেই হোক না কেন তাকে স্বীকার করে নিতে হবেই; সময়ের দীর্ঘতা অপেক্ষা সত্য মহামূল্যবান।
ইতিহাসের খুবই সামান্য কিছু কীর্তিমান প্রতিভা তাদের কল্পনাশক্তি, প্রতিভার নির্ভীকতা, চিন্তার ব্যপ্তি এবং তা হৃদয়ঙ্গম করার অসাধারন ও মৌলিক ক্ষমতা দিয়ে মানুষকে একজন যাদুকরের মত ভবিষ্যতের মানুষদের বৈপ্লবিক চিন্তাধারায় গতি এনে দেন। যার ফলে তাদের বইগুলি যেমন দিয়েছে মহাবিস্ময় তেমনি তারাও পরিনত হয়েছে সাধারন মানুষের কছে রুপকথার নায়কে।
পরিশেষে বলা যায়, মানব ও বিজ্ঞান জগতের বইগুলি যে আবেগময় বাণী বহন করছিলো তা কোটি কোটি মানুষের মনে দোলা দেয় মহাসাগরের এপার থেকে ওপারে। তাই স্পষ্টই বলা যায় বই সুপ্রভাব বা কুপ্রভাব বিস্তারে সমান পারদর্শী। এখানে বই এর আলাদা কোনো গুন দেখানো হয়নি। দেখানো হয়েছে বই মোটেই কোনো নিস্প্রাণ বস্তু নয় বরং জীবনের ক্ষেত্রে জীবন্ত ও শক্তিশালী হাতিয়ার।
বিদ্রঃ বই সংক্রান্ত এই আলোচনায় ধর্ম, সাহিত্য ও দর্শন এর ক্ষেত্রকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম হিসেবে নেয়া হয়েছে ‘আল কোরআন’। কারণ জ্ঞানের সর্বক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে এই ‘আল কোরআন’। আবার সব ধর্ম-বর্ণের লোকের কাছে পক্ষে বা বিপক্ষে সবচেয়ে সমালোচিত গ্রন্থ এটি । তাই একে বাদ দেওয়া যায়নি এই তালিকা থেকে।
* জালাল উদ্দীন বাবু: প্রভাষক, লালপুর ডিগ্রি কলেজ ও নির্বাহী পরিচালক, প্রাকীর্তি ফাউন্ডেশন।
সাম্প্রতিক মন্তব্য