দুর্নীতি প্রতিরোধে শিশু শিক্ষা
আবুল কাশেম উজ্জ্বল।।
প্রায় প্রতিদিন সংবাদপত্রে দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ থাকে, যার মধ্যে ‘পুকুর চুরি’র মত সংবাদ আমাদের হতবাক করে। কেমন করে এসব সম্ভব হয় তা নিয়ে আমরা ভাবতে ভাবতেই দুর্নীতিবাজরা কানাডা, মালেশিয়াসহ অনেক দেশে পাড়ি দিয়ে দেয় অথবা তাদের তেমন কিছু হয় না। কিছু দিন পর পর একেকটা ঘটনা তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে, সবাই একটু নড়ে-চড়ে বসে, আর চলে কর্তাব্যক্তিদের হম্বি-তম্বি। কিন্তু ফলাফল প্রায় একই, বছরের পর বছর ধরে চলে তদন্তের নামে সময়ক্ষেপন। আর কোন ভাবে যদি কাউকে ধরা হয় তবে চূড়ান্ত ফল পেতে যুগ পার। বলবনা যে বিচার হচ্ছেনা, তবে বাস্তবতা হচ্ছে বিচার প্রক্রিয়া আর তথ্য-প্রমাণের চুর-পুলিশ খেলা খেলতেই মানুষ ভুলে যায় কি হয়েছিল আর কি হচ্ছে।
দুর্নীতি নতুন কোন বিষয় নয়, বরং অতীতেও এটা হয়েছে। তবে সময়ের সাথে সাথে সেটা ‘ওরগেনাইজ ক্রাইম’ হয়ে যাচ্ছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিবারিক রুপ নিচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অব্যাহত নির্দেশ আর তদারকীর পরও পরিস্থিতির আশানুরুপ উন্নতি হয়নি। আইন, কমিশন ও সরকারী অনেক নির্দেশনা থাকার পরও দুর্নীতি যেন লাগামহীন এক পাগলা ঘোড়া। পাড়ার খুচরা দোকানদার থেকে শুরু করে কোম্পানি, অফিসের দারোয়ান থেকে শুরু করে বড় কর্তা, ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠান- সবাই যেন এক অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। করোনা মহামারির সময়েও তাদের দুর্নীতি থামেনি, বরং অনেকের কাছে সেটা সাপে বর হয়েছে।
দুর্নীতির শিখড় এত গভীরে চলে গেছে যে এখন প্রচলিত আইন ও আইনী কাঠামো দিয়ে এর মূলোৎপাঠন করা কতটা সম্ভব তা সমাজ বিজ্ঞানীদের ভাবার বিষয়। অনেক ঘটনায় আইনের লোকজনের দুর্নীতির বিষয় আমাদের আরো আতঙ্কিত করছে। একদিকে দুর্নীতিবাজরা ক্রমাগতভাবে শক্তিশালী হচ্ছে, অন্যদিকে সমাজের সচেতন অংশ তাতে বাধা দেয়ার মনোবল ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে। মনে হচ্ছে আমরা দুর্নীতিকে ‘নিউ নরম্যাল’ পরিস্থিতি হিসেবে মেনে নিচ্ছি। ভয়াবহ দিক হচ্ছে দুর্নীতির সাথে পরিবারের সম্পৃক্ততা যা আমাদের সমাজ ব্যবস্থার রুগ্ন বাস্তবতাকেই ইঙ্গিত করে। এটা এখন সোস্যাল প্যাথলজিক্যাল অবস্থার সৃষ্টি করেছে, ফলে ভাল-মন্দ, নৈতিক-অনৈতিকতার প্রার্থক্য আমরা প্রায় ভুলে যাচ্ছি।
অতীতে নিজের অবৈধ সম্পত্তি স্ত্রীর নামে গচ্ছিত রাখার যে প্রবণতা ছিল এখন সেটা পরিবর্তিত হয়ে সামষ্টিক পারিবারিক দুর্নীতিতে রুপ নিচ্ছে। অনেক ঘটনায় দেখা যায় ব্যক্তির পুরো পরিবার দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে আছে বা যাচ্ছে। পরিবারের প্রথাগত ভূমিকার নেতিবাচক পরিবর্তন আমাদের সামাজিক জীবনের জন্য হুমকি হচ্ছে। এভাবেই পারিবারিক আবহে দুর্নীতি বিস্থার লাভ করছে যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে শিশুদের উপর। ফলে পরিবার থেকেই শিশু অনৈতিক ও অপরাধমূলক কাজের প্রাথমিক শিক্ষা পাচ্ছে। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি নিয়ে চিন্তা করছি কিন্তু পারিবারিক বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছেনা বা আমাদের বিবেচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে পারিবারিক আবহে দুর্নীতি ও অপরাধের বিকাশ ঘটছে, তাতে ভবিষ্যতে এটা আমাদের সমাজ ব্যবস্থার জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী।
নৈতিক ও অনৈতিকতার মধ্যকার ব্যবধান ধীরে ধীরে কমে আসছে। বিশেষ করে পরিবারের নির্ভরশীল ও শিশুদের নিকট তাদের অভিভাবকের দুর্নীতির বিষয়টি কোন প্রশ্ন ছাড়াই গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। অনেক কিছু বুঝার আগেই তারা এমন এক জগতের সাথে মানসিকভাবে অভ্যস্থ হচ্ছে যা থেকে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব বলা যায়। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের কেবল আইনের উপর ভরসা করে থাকলে হবে না, বরং দুর্নীতির মনো-সামাজিক দিকটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে প্রতিরোধের কথা ভাবতে হবে। তাই শিশুদের সচেতন ও দুর্নীতি বিরোধী নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস নিতে হবে।
শিশুরা খুব ভাল প্রশ্ন করতে পারে যদি তাদের সেভাবে গড়ে তোলা যায়। সমস্যা হচ্ছে আমরা তাদের মনে কৌতুহল তৈরী করতে পারছি কি-না। সম্ভবত বেশীরভাগ ক্ষেত্রে পারছিনা, ফলে পরিবার থেকে শুরু করে সামাজিক বলয়ে তারা এমন কিছু বিষয়ের সাথে পরিচিত হচ্ছে যা কাম্য নয়। উন্নত দেশের শিশুরা কারো কোন কাজ বা আচরণ অপছন্দ হলে বা অন্যায্য মনে হলে প্রতিবাদ করে। এমনকি তারা পুলিশের কাছে অভিযোগও করে এবং পুলিশ সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়। বিদ্যালয়ে শিশুদের প্রথম পাঠের মধ্যেই তাদেরকে নৈতিক শিক্ষা দেয়া হয় যেখানে তাদের অধিকার, কর্তব্য এবং অন্যায়ের প্রতিবাদের প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়। বড় কথা হচ্ছে তাদের দেশে শিশুদের মনে প্রশ্ন করার যে শক্তি তৈরী করে দেয়া হয় সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে জন্য তাদের অভিভাবকরাও পরিবারের শিশু ও অন্যদের প্রতি দায়িত্ব পালনের বিষয়ে সতর্ক থাকেন।
আমাদের দেশেও নৈতিক শিক্ষার পাঠ আছে তবে সেটা কতটা সময় উপযোগী ও বাস্তব সম্মত তা ভেবে দেখার প্রয়োজন। আবার আমাদের দেশে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কারিকুলাম একই নয় বলে শিশুদের শিক্ষার বিষয়টিও ভিন্ন হয়ে যায়। আমাদের শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিৎ শিশুদের মনোজগতে দুর্নীতি বিরুধী চেতনা তৈরী করা। কোন ধরনের কাজ বা আচরণ দুর্নীতির সাথে সম্পর্কিত সেটা তাদের শিক্ষা দিতে হবে। শিশুদের যদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় এ বিষয়গুলো সম্পর্কে ভালভাবে অবহিত করা যায় তাহলে কিছু ইতিবাচক ফল পেতে পারি। তারা যাতে অভিভাবকসহ অন্যদের যৌক্তিক প্রশ্ন করতে পারে, বৈধ-অবৈধ, নৈতিক-অনৈতিকতার ব্যবধান উপলব্ধি করতে পারে, সেভাবে তাদের মনোজগতে প্রভাব তৈরীর কাজ করতে হবে।
তাই আমাদের প্রয়োজন শিশু ও পরিবারের সদস্যদের মানসিকতা পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া। এ জন্য পাঠ্যক্রমে নতুন অধ্যায় যুক্ত করা এবং তা যথাযথভাবে অনুশীলনের প্রতি গুরুত্বারোপ করা খুবই প্রয়োজন। প্রয়োজনে বিদ্যালয় কেন্দ্রীক নিয়মিত আলোচনা, প্রদর্শনী বা সম্পর্কিত অন্য বিষয়গুলো আয়োজন করার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। শিশুদের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের ইতিবাচক ভুমিকা পালনের জন্য আলাদা উদ্যোগ নেয়ারও প্রয়োজন রয়েছে।
তাই সময় হয়েছে দুর্নীতি বিরুধী পারিবারিক ও শিশু শিক্ষার উদ্যোগ নেয়া। আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে, এর যথাযথ তদারকীর দায়িত্বও আমাদের। কেবল আইনের উপর ভরসা করে বসে থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা খুব কঠিন হবে। আশা করি সরকার এ বিষয়টি নিয়ে ভাববেন।
* আবুল কাশেম উজ্জ্বল: অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
সাম্প্রতিক মন্তব্য