ইউরোপে বাস নাকি ভূ-মধ্যসাগরে লাশ
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
কোনক্রমেই থামছে না অবৈধপথে বিদেশ যাত্রা। আগে টেকানাফ দিয়ে থাই-জাভা-সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ায় পৌঁছানো ছিল লক্ষ্য। এখন রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সমুদ্রপথ রুদ্ধ করে রাখায় আদম দালালরা নতুন গন্তব্য চিহ্নিত করে কমবয়সীদের অবৈধ পথে বিদেশে পাঠানোর টার্গেট করেছে। তারা এ যাত্রায় অনেকটা কৃতকার্য। এর অনেক কারণের সবচেয়ে বড় কারণ হলো- ঘাটে ঘাটে বিভিন্ন দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে অবৈধ সহযোগিতা প্রাপ্তি। তারা অন্যায় সুযোগের পথ তৈরী করে না দিলে অবৈধ পথে যে কারো দেশ থেকে বাইরে যাওয়া বা মাদক চোরাচালানের ব্যবসা করা অসম্ভব ব্যাপার।
দেশে উন্নয়নের এত ডামাডোলের মধ্যেও কি এমন নেই যে মরণকে সঙ্গী করে অবৈধ পথে বিদেশ যাত্রা করতে হবে? সেটা এখন সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন। মানুষই এখন বড় সম্পদ। যে দেশে মানুষ বেশী কর্মঠ সে দেশেন উন্নয়নের গতি তত বেশী। লক্ষ লক্ষ বিদেশী নির্মাণশ্রমিক, এঞ্জিনিয়র, দর্জিগুরু, শিক্ষক, রাধুঁনী, ডাক্তার এখন আমাদের দেশে চাকুরী করছেন। তারা অনেকে বৈধ আবার অনেকে অবৈধ। আরো আছেন হাজার হাজার অবৈধ জুয়াচোর, বাটপার, কম্পিউটারহ্যাকার, ব্যাংকচোর, অবৈধ স্বর্ণ ও মাদক কারবারী, স্পাই আরো কত কি! শুধু প্রতিবেশী দেশের প্রায় বিশলক্ষ মানুষ আমাদের দেশে বৈধ-অবৈধভাবে বিভিন্ন চাকুরী ও ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন বলে সংবাদে জানা গেছে। এটিএম বুথ থেকে টাকা সরানোর কাজে নিযুক্ত রয়েছে আফ্রিকা ও ইউরোপের অনেক দেশের জালিয়াতরা। তারা মাঝেমধ্যে পুলিশের হাতে আটকও হন। এদের সংখ্যা অগণিত, তাদের সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই।
তারা ভ্রমণকারীর ছদ্মবেশে প্রতিনিয়ত দেশে ঢুকছেন-বের হচ্ছেন। আমাদের দেশ মাদক ও সোনা চোরাচালানের রুট হওয়ায় এবং তারা এদেশের দামী দামী মানুষের সাথে সখ্য গড়ে চলাফেরা করায় তাদেরকে চিহ্নিত করা কঠিন কাজ। ওরা ইংরেজি জানা স্মার্ট, অভিজ্ঞ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে পটু। তাই তাদের অবৈধ চাকুরী বা ব্যবসার ধরন দেখে কারো বোঝার উপায় নেই তারা বিশ^চোর ও জগৎ জালিয়াতের সদস্য।
আর আমাদের দেশের মানুষ একবিংশ শতাব্দীতে এসে উচ্চশিক্ষিত হয়েও প্রযুক্তিতে দক্ষ হয় না, এমএ পাশ করেও শুদ্ধ করে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না। টেকনিক্যাল কাজ করতে জানে না। এখনও অনেকেই বিদেশে যান ঘরকন্নার ছোটখাটো ম্যানুয়েল কাজ করতে। সবাই নয়, তবে অনেকে ইউরোপের গ্রীস ও উন্নত দেশে গিয়েও দক্ষতার অভাবে ড্রাইভার ও কৃষিফার্মের সাধারণ শ্রমিক। দেশে ধনীর দুলাল হয়ে বাবার মাথা ভেঙ্গে খেলেও মধ্যপ্রাচ্যে অনেকেই গৃহকমী বা মেষপালক। ওদের বেতন যৎসামান্য। বাসস্থানের অবস্থা খুব করুণ। কেউ কেউ পানির অভাবে বহুদিন গোসল করার সুযোগও পান না। হাঙ্গেরী, লিথুয়ানিয়া, গ্রীসের কৃমিফার্মের ব্যারাকের একই অবস্থা। তবু কেন ইউরোপে যাবার মোহ? এর চেয়ে দেশে বাবার জমি বা অন্যের পতিত জমি লিজ নিয়ে কৃষি শ্রমিক হওয়া অনেক ভাল। অনেক শান্তি আছে তাতে।
হ্যাঁ, যদি বৈধ পথে গিয়ে সম্মানজনকভাবে সেখানে কাজ করার সুযোগ হতো তাহলে আমি এসব কথা লিখে কাউকে কষ্ট দিতাম না, নিজেও দু;খ পেতে আগ্রহী হতাম না। আমি নিজের চোখে অনেকের দূরাবস্থা দেখেছি। তাই তাদের কষ্টের জীবন আমার মোটেও সহ্য হয় না।
বিশেষ করে আমার এক বাল্যবন্ধু বহু বছর পূর্বে স্থলপথে ভারত- আফগানিস্তান, ইরান হয়ে ইউরোপে যাবার পথে বরফশীতল খরস্রোতা ছোট পাহাড়ি নদী রাতের আঁধারে সাঁতরে পার হতে গিয়ে অনেকের সাথে ঠান্ডায় জমে মারা গিয়েছিল। তাদের সঙ্গীরা বনের মধ্যে কোন এক জায়গায় তার লাশ পুঁতে রেখে সেই সংবাদ বহুদিন গোপন করেছিল। সেই বাড়িতে বাবা-মায়ের কান্না আজও থামেনি।
তার ওপর প্রায় প্রতি মাসেই ভূ-মধ্যসাগরে রাবারের নৌকাডুবি হয়ে অথবা কোষ্টগার্ডের গুলিতে প্রাণ হারিয়ে সাগরের নীল পানিতে সমাধিস্ত হওয়া মানুষগুলোর কথা টিভিতে দেখলে আমার মোটেও ভাল লাগে না।
আজ একটি টিভিতে দেখলাম আদম দালালরা নোয়াখালী চট্টগ্রাম ছেড়ে এখন শরীয়তপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, মাগুড়া প্রভৃতি জেলায় হানা দিচ্ছে। তারা স্থানীয় দালালের সহযোগিতায় হাইস্কুলে, কলেজে গিয়ে স্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করছে। গরীব শিক্ষার্থীদের বাবা-মাকে জমি বিক্রি করে ইউরোপে পাঠানোর জন্য প্রলুব্ধ করছে। মিথ্যা প্রলোভন দিচ্ছে- সেখানে পড়াশুনা করবে, অনেক আয় করে বাড়িতে টাকা পাঠাবে, দ্রুত ধনী হবে ওদের বাবা-মায়েরা। কতটা নিচ, অসৎ ও অমানবিক এসব আদম দালালরা।
পাশাপাশি অনেক গ্রামে ছেলেহারা মায়েরা ডুঁকরে কান্নাকাটি করে দালালদের গালি দিচ্ছে, কেউ মারপিট করতে উদ্যত হচ্ছে। কিন্তু দালাল চক্র খুব শক্তিশালী, রাজনীতিও করে। তারা উল্টো পরিবারকে আক্রমণ করছে মাস্তান দিয়ে। থানায় মামলা দিচ্ছে মিথ্যার ডালি সাজিয়ে। বাড়িতে পুলিশ পাঠাচ্ছে। টাকার লোভে বাড়িতে পুলিশ এসে বার বার হানা দিচ্ছে বলে এক সংবাদে জানা গেল।
এটাই কি আমাদের দেশে সামাজিক নিরাপত্তা? এটাই কি সরকারী নিরাপত্তামূলক জনসেবার নামান্তর? ঢাবি পড়াকালীণ মরহুম ফকির আলমগীরের গান শুনতাম টিএসসি চত্ত্বরে- “চল সখিনা দুবাই যাব, দেশে বড় দু:খ রে...” তখন দুবাইতে যাবার কারণ ছিল, দেশে কাজ ছিল না, আমিরাতে তরল সোনা বা তেলের দাম বেশী ছিল, বেতন বেশী দিত। আর এখন? এখন কি ইউরোপে বা গ্রীসে যাব জমির ঘাস কাটতে? ওদের ভেড়া ও ঘোড়া চড়াতে? কেন যাব? কোন মোহে? দেশে নিজের জমিতে কৃষিকাজ করতে এত লজ্জা কিসের? আমাদের দেশের মাটি-সে তো সোনাফলা নিয়ামত!
আমাদের নেতারা এসব জরুরী সমস্যার দিকে নজর না দিয়ে তাপানুকুল ঘরে বসে নাক –মুখ ঢেকে নিজেরা এক অপরের নামে বিষোদগার করে প্রেসব্রিফিং দিচ্ছেন। মানুষ সেটাকে অপছন্দ করছে, প্রতিদিন একই কায়দায় কারো লিখে দেয়া বালখিল্যমূলক কথার ফুলঝুড়ি শুনতে শুনতে টিভি দেখতে ঘৃণা ধরে গেছে। কারণ, দেশের প্রাণশক্তি সম্ভাবনাময় যুবশক্তি নানা হতাশায় জর্জরিত হয়ে দেশ ছেড়ে বিদেশে পালাতে গিয়ে সাগরে ডুবে প্রাণ হারাচ্ছে- এগুলো দেখে তাঁদের প্রাণে কোন দয়া-মায়া হয় না?
নেতাদের এই অজ্ঞানতা ও বেহাল দশা দেখে দেশের আইন-শৃংখলা ও সেবাদানে দায়িত্বরতরা মহাখুশী। জবাবদিহিতা না থাকায় তাদের মোহগ্রস্থতা থেকে বিলাসী জীবন যাপন দেশের অপরাধ তথা অবৈধ মাদক ব্যবসা, চোরাচালানী, গ্যাংকৃষ্টি, অবৈধ আদম ব্যবসা বন্ধ না হয়ে বেড়েই চলেছে। আইন-শৃংখলাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য একটু কঠোর ভূমিকা পালন করলে দ্রুত মাদকব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব এবং ভূ-মধ্যসাগরে বা অন্য কোথাও সলিল সমাধি বরণ করতে হবে না বলে আমার বিশ্বাস।
আমরা শ্রমিকদের বা অবৈধ অভিবাসীদের পাঠানো টাকায় কয়টি ট্রেনের বগি কিনলাম তা বিদেশীরা দেখতে চায় না। আমাদের শ্রমিকরা দেশে রেল লাইনের বস্তিতে ও রেল স্টেশনে ঘুমায়, লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল, নদীভাঙ্গা, বাস্তুহারা, ফকির রাস্তার দামী গাড়ির জানালায় হাত পাতে ভিক্ষার জন্য সেটা ওদের দেশের মানুষের জানা। আমরা যতই উন্নতির কথা প্রচার করি না কেন, ভূ-মধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে অবৈধ অভিবাসীদের ঘন ঘন মৃত্যুর ঘটনা আমাদেরকে সারা বিশে^ হেয় প্রতিপন্ন করছে, আরো বন্যার্ত্য, কর্মহারা দরিদ্র মিস্কিন হিসেবে।
মানুষের জন্য যদি নেতার প্রাণ না কাঁদে তাহলে তারা কিসের মানবদরদী? দেশের মানুষ লইছকা বিলে ডুবে মরছে, মেঘনায় ডুবে মরছে, ভূ-মধ্যসাগরের নীল পানিতে ডুবে মরছে, বেওয়ারিশ লাশ হচ্ছে- আর নেতারা বিবৃতি দিয়ে খালাস! আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেশে করবে বসবাস- অবৈথ পথে পালাতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে আর হবে না বেওয়ারিশ লাশ। এই হোক আজকের ডিজিটাল রাজনীতির মূলসুর, আজকের বদলে যাওয়া বাংলাদেশের পরম প্রত্যয়।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd
সাম্প্রতিক মন্তব্য