logo
news image

ব্লেন্ডেড শিক্ষায় দেশজ ব্লেন্ডার চাই

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
সশরীরে উপস্থিতি ও ভার্চুয়্যাল পদ্ধতি মিশ্রণ করে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোকে সহজ কথায় ব্লেন্ডেড শিক্ষা বলা হয়ে থাকে। এ ধরনের শিক্ষায় শ্রেণিকক্ষের একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্য কিছু সময় মুখের বক্তৃতা ও কিছু সময় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাঠদান করা হয়। পাঠদানে বৈচিত্র্য আনতে ও তা আনন্দময় করতে ব্লেন্ডেড শিক্ষণ পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছে।
অন্যকথায় বলা যায়- একই সাথে সশরীরে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি ও অনলাইনের বা অনসাইটের শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীদের মাঝে বুঝানো ও প্রদর্শণ করার মাধ্যমে পাঠদান করার পদ্ধতি হচ্ছে ব্লেন্ডেড শিক্ষা। প্রত্যেক মানুষের শেখার ইচ্ছে ও মনন এক নয়। আবার প্রত্যেক শিক্ষকের শেখানোর কৌশল ও ধরন এক নয়। কেউ একবার শুনেই শিখে ফেলে, কেউ দেখে শিখে, কেউ লিখে শেখে। কাউকে বহুবার বহু কসরৎ করেও শেখানো যায় না। এই নানা কারণ ও নানা ধরনের মধ্যে  ‘ঘোল’ তৈরী করে শিক্ষার বিষয়বস্তুকে সহজবোধ্য করে মাথায় ঢুকিয়ে দেয়ার কৌশলকেও আমরা ব্লেন্ডেড শিক্ষণ বলতে পারি। করোনাকাল শুরু হবার আগে এই পদ্ধতিতে শিক্ষাদানে কিছুটা ভাটা পড়লেও দীর্ঘদিন ঘরবন্দী মানুষ আবার নতুন করে এর ব্যবহার করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
তবে ব্লেন্ডেড শিক্ষা পদ্ধতি নতুন কিছু নয়। প্রথমদিকে শিশু ও বয়স্ক শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্লেন্ডেড শিক্ষার কথা ভাবা হলেও পরবর্তীতে প্রযুক্তির সাহায্যে লেখাপড়াকে সহজ করে তোলা এর মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। মূল্যবান সময়কে জয় করে সব মানুষের জন্য দ্রুত আধুনিক শিক্ষা ও প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের নিরীখে এটাকে আধুনিক শিক্ষার নীতি ও রূপরেখার মধ্যে বিবেচনা করা শুরু হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ^বিদ্যালয় ১৯৬০ সালে এই পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের চিন্তা শুরু করে। এরপর প্লাটো বা- ‘প্রোগামড লজিক ফর অটোমেটিক টিচিং’ বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে শেখাতে পারে এমন একটি উদ্যোগ হাতে নয়া হয়। এজন্য ১৯৭০ সালে স্যাটেলাইট বেজড্ লাইভ ভিডিও শুরু করা হয়। এটা ব্যয়বহুল প্রমাণিত হওয়ায় সাথে সাথে ছোট প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে গবেষণা অব্যাহত থাকে।
এরপর ১৯৯০ সালে আটলান্টার একটি এডুকেশনাল কোম্পানি তাদের ইন্টার্যাক্টিভ লার্নিং সেন্টারের প্রেস রিলিজে প্রথমবারের মত আইপিএসসি লার্নিং নামে এর ঘোষণা দেয় (ওয়াসিফ জান্নাত ২০০০)। কিন্তু ব্লেন্ডেড শিক্ষা নামটি দুর্বোধ্য ও অস্পষ্ট ছিল। এরপর ‘হ্যান্ডবুক অব ব্লেন্ডেড লার্নিং’ নামক পাবলিকেশনে (গ্রাহাম ও বঙ্ক ২০০৬) বলেছেন, “ব্লেন্ডেড লার্নিং’  এমন একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া যেটি ফেস-টু-ফেস ইন্সট্রাকশন ও কম্পিউটার ব্যবহার করে ইন্সট্রাকশনের একটি ব্লেন্ডেড মডেল”।
ব্লেন্ডেড লানিং’ এর জন্য বিশ^ব্যাপী নানা কৌশলের অবতারণা করা হয়। দেশজ প্রাযুক্তিক সক্ষমতা, আর্থিক বরাদ্দ, মানুষের শিক্ষা ও সচেতনতার হার, গ্রাম ও শহরের মধ্যে আয় ও জীবনমানের সমতা ইত্যাদি নানা বিষয়ের উপর নির্ভর করে তারা খুব সহজেই ‘ব্লেন্ডেড লানিং’ প্রক্রিয়ায় তদের সমাজ ও দেশকে এগিয়ে নিতে পারছেন। বিশেষ করে করোনাকালীণ শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনেক দেশ খুব দ্রুত শিক্ষা সমাযোজন বা এডাপ্টেশন প্রক্রিয়ায় উপনীত হয়েছে। তাই উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষায় পিছিয়ে যাওয়া বা সেশনজট সংক্রান্ত সমস্যার কথা তেমন একটা শোনা যায় না।
ব্লেন্ডেড লানিং-এর জন্য নানা আধুনিক মডেল প্রচলিত রয়েছে। তার কতগুলো কমন বা সব দেশের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। যেগুলো সহজ, আনন্দময়, ইন্টারেক্টিভ ও ইন্টারেস্টিং সেগুলো সব দেশের সব বয়সী মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য। তবে এগুলো বাস্তবায়নের জন্য যেসকল উপকরণের কথা বলা হয়েছে তা আমাদের মত দরিদ্র দেশের পক্ষে একসাথে যোগান ও সামাল দেয়া সম্ভব নয়।
আমাদের দেশে কয়েক দশক আগে চালু হওয়া দূরশিক্ষণ এক ধরনের ব্লেন্ডেড লার্নিং ছিল। দেখা গেছে অনেক বয়স্কদের বাড়িতে টিভিসেট নেই। বয়স্কশিক্ষা কেন্দ্রে টিভি অনুদান দেয়া হলেও সেখানে পাড়ার যুবকরা ডিশের ঢাকনা লাগিয়ে অথবা ভিসিআর-এ রাতভর বিদেশী সিনেমা চালাতো। এখনও ব্লেন্ডেড লার্নিং-কে দূরশিক্ষণের ভাবনার মতো মনে করা হয়। একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি গত ২৭.০৫.২০২১ তারিখে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘ব্লেন্ডেড লার্নিং একটি জীবনব্যাপী শিক্ষা। এট বয়স্কদের ও কর্মজীবিদের জন্য।’ এটা অতি পুরাতন ভাবনা। অথচ, করোনাকলে আমরা ২০২১ সালে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে উচ্চশিক্ষার ঘাটতি পুষিয়ে নেবার জন্য ব্লেন্ডেড লার্নিং-এর আধুনিক প্রচলণের কথা ভাবছি।
আমরা ‘স্ট্রাটেজিক প্লান ফর হায়ার এডুকেশন ইন বাংলাদেশ-২০১৮-২০৩০’ এর অধীনে উন্নত বিশে^র আদলে ব্লেন্ডেড লার্নিং পরিকল্পনার কথা ভেবে কর্মপরিকল্পনার খসড়া চূড়ান্ত করেছি। কারণ, আমাদের উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়াদের আর্থ-সামাজিক ও পারিবেশিক অবস্থা সমান নয়। আয় বৈষম্য, ভৌগলিক অবস্থান এবং সচল বিদ্যুৎ, ইন্টারনেটে সবার আ্যাকসেস্হীনতা ও গতির তারতম্য অনলাইন পাঠদানের ক্ষেত্রে চরম হতাশার চিত্র তুলে ধরায় অদ্যাবধি পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় ও কলেজগুলো পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারেনি। শুধু কর্মপরিকলাপনা ও সমস্যা চিহ্নিত করতেই আমরা ২২ মাস অতিবাহিত করে ফেলেছি। কারণ, উন্নত বিশে^র আদলে আমাদের অনলাইন শিক্ষা প্রক্রিয়া অচল প্রমাণিত হয়েছে।
এখন ব্লেন্ডেড লার্নিং’ প্লান-এ যে খসড়া মডেলের কথা বলা হচ্ছে তাও পরীক্ষামূলক বটে। কিন্তু এ মুহূর্তে কোন বিষয়ে একইসাথে অনলাইন ও অনসাইট পরীক্ষা চালানোর সময় নেই। এখন সেশনজট থেকে মুক্তি পেতে দ্রুত সবাইকে টিকা দিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে স্বল্পসংখ্যক উপ¯িথতি নিয়ে পরীক্ষাগুলো শেষ করাটা বড় কাজ।
ফ্লিপড ক্লাসরুম সব সময়ের জন্য ভাল। মুখের বক্তৃতা প্রদানের সাথে সাথে বা একটু অবকাশ দিয়ে ফ্লিপড প্রক্রিয়া (ভিডিও পডকাষ্ট, বুক রিডিং এন্ড এনালাইজিং, ওয়েবসাইট) বেশ ফলদায়ক। এতে একঘেঁয়েমি দূর হয় ও আনন্দের সাথে শিক্ষালাভে মন চাঙ্গা হয়ে উঠে। আমরা বিদেশে অধ্যয়নকালীণ বহুবছর আগে (২৫-২৬ বছর) এসকল পদ্ধতিতে ক্লাস করতাম। সারাদিন ক্লাস করতেও বোরিং লাগতো না। এ বছর করোনা চলে গেলেও আমরা এই মডেলের মাধ্যমে আগামী বছরের জন্য দ্রুতলয়ে এই পদ্ধতি কাজে লাগাতে পারবো।
তবে আমাদের ইনডিজিনাস বা দেশজ পরিস্থিতিতে ব্লেন্ডেড লার্নিং কতটুকু কার্যকরী তা গভীরভাবে ভাবতে হবে। এর যেমন কিছু ভাল দিক আছে তেমনি কিছু দুর্বল দিকও রয়েছে। ভাল দিক হলো- শিক্ষার্থীদেরকে একই সাথে বিভিন্ন ধরনের টিচিং মেটেরিয়াল দেয়া যায়। কোনটা বেশী ভাল, সেটা বাছাই করে তারা নিজেদের ব্রেনের প্লাটফরম তৈরী করে নিতে পারে ও সে অনুযায়ী উচ্চতর গবেষণা প্লট সাজাতে পারে।
মিশ্রণ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক শুধু উপায় বাতলে দেন, কাজটা সম্পন্ন করতে হয় শিক্ষার্থীকে। ব্লেন্ডেড লার্নিং হলো পাঁচমিশালী শিক্ষা। খিঁচুড়ি রান্নার পূর্বে তাতে প্রেটিন থাকে না। কিন্তু যখন অনেক কিছু একত্রে মিশ্রিত হয়ে সিদ্ধ হয়ে যায় তখন সেটা প্রোটিনে রূপান্তর হয়ে শরীরের পুষ্টি সাধন করে।
তবে ব্লেন্ডেড লার্নিং দিতে গিয়ে অখাদ্য তৈরী করে কাউকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ব্লেন্ডেড লার্নিং-এর বিদেশী উপকরণ ও  সুবিধাদি আর আমাদের দেশের সুবিধাদি মোটেও এক সমান ও মানের নয়। আমাদের দেশজ মডেল নেই। আমাদের  সকল শিক্ষক এই শিক্ষার মেটেরিয়ালস্ যোগাড় করতে জানেন না। এর খরচ বেশী, প্রযুক্তি ব্যবহারের ট্রেনিং নেই। ব্লেন্ডেড লার্নিং দিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর মানসিক চাপ বাড়ে। আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট মাত্র একটি। আরো অনেকগুলো স্থাপন করা দরকার। দোয়েল কম্পিউটারের মত দেশীয় কোম্পানী হারিয়ে গেলে আমাদের আর নিজস্ব ব্রান্ডের কম্পিউটার বলে কখনও কিছু আবিষ্কার হবে কি? বাংলা সালাদ তৈরীর জন্য দেশজ খাঁটি সরিষার তৈল খুঁজে না পেয়ে ভেজাল পামওয়েল বা নকল ঘি ব্যবহার করলে কাজ হবে না।
করোনাকালে নিরুপায় হয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র পঞ্চগড়ে পাট ধুচ্ছে, কুড়িগ্রামে অটোরিক্সা চালাচ্ছে, কুয়াকাটায় আমড়া বিক্রি করছে পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করার জন্য। তারা নিজেরা টাকার অভাবে এমবি কিনে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারেনি। তাদের ক্ষেত্রে শহরে বিশ^বিদ্যালয়ে এসে টিউশনি করে বাড়িতে টাকা পাঠানোর সাথে সাথে ক্লাসে যোগ দেয়া ও পরীক্ষা দিয়ে পাশ করাটা জরুরী। তাই দেশজ ব্লেন্ডিং মডেল বাদ দিয়ে বিদেশী মডেল নিয়ে পাঠদান শুরু করে দূরশিক্ষণের মত অদূরদর্শিতায় সেটা আবারো যেন তাল-লয়ের বেসুরো বিবেচনায় বন্ধ করতে না হয়।
আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার বর্তমান সমস্যা সমাধানের উপযোগী দেশজ ব্লেন্ডার বলতে- ১. গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীর সহজ অংশগ্রহণ করার মানসিকতা জরুরী। ২. শিক্ষকদের টিচিং ম্যটেরিয়াল সংগ্রহ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তা পাঠদানে প্রস্তুত করার ক্যাপাসিটি থাকা ৩. সব শিক্ষার্থীর সেসব তথ্য গ্রহণ করার সক্ষমতা থাকা। ৪.  ম্রেণিকক্ষে  মনোযোগ ও নির্দিষ্ট সময়ের সুষ্ঠু ব্যবহারের ব্যাপারে ব্যাপক কড়াকাড়ি আরোপ করা। ৫. নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, উচ্চগতির নেটওয়ার্ক ও শ্রেণিকক্ষের বেঞ্চে সব শিক্ষার্থীর সামনে সংযুক্ত মনিটর, ডিভাইস থাকা জরুরী, যেটা দিয়ে কেউ কারোটা না দেখে সংক্ষিপ্ত প্রোগ্রামিং ব্যবহার করে তড়িৎ পরীক্ষার উত্তর পোষ্ট করবে এবং শিক্ষক সেটা দ্রুত মূল্যায়ন করে ফলাফল প্রস্তুত করতে পারবে। দেশজ ব্লেন্ডার দিয়ে আমাদের দেশে পরীক্ষায় নকল রোধ, একাধিক কোম্পানির এ্যান্টি প্লেজারিজম সফটওয়্যার ব্যবহার করে একাডেমিক প্লেজারিজম রোধ, অনপুস্থিতি রোধ ইত্যাদি জরুরী। ব্লেন্ডেড লার্নিং প্রক্রিয়ায় সাধারণত: কোন ক্লাশের শেষে অথবা সপ্তাহান্তে মূল্যায়ন বা ফলাফল তৈরী করা হয়ে যায়। তাই আমাদের সমাজ বা দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় আরো চিন্তাভাবনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে ভাল হবে।
অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা যেহেতু এখনো আমাদের দেশজ প্রক্রিয়ায় পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে এখনও সুফল দিতে পারেনি তাই ভবিষ্যতের জন্য বিকল্প ভাবনা ভাবতে হবে। সেক্ষেত্রে টেকসই দেশজ ব্লেন্ডেড লার্নিং প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার কল্যাণে সবাইকে দ্রুত টিকা দিয়ে, হল খুলে দিয়ে, সশরীরে শ্রেণিকক্ষে আসার সুযোগ করে দিলে শিক্ষার ফটক খোলার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সহ অনেক সমস্যার সমাধান খুব দ্রুত করা সম্ভব হতে পারে।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top