নিভৃতপল্লি মুরদহ গ্রাম যেন একখন্ড বঙ্গবন্ধু
ইমাম হাসান মুক্তি, প্রতিনিধি, লালপুর (নাটোর)
বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর অমর সব কর্মযজ্ঞ। গ্রামের ছেলে মেয়েরা পড়ালেখার ফাঁকে দল বেঁধে এখানে আসে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে। ছেলেমেয়েদের বসার জন্য তৈরি করা হয়েছে ফুল-ফলে ঘেরা সবুজ ঘাসের বিছানা। বাড়ির নিচতলার পুরো অর্ধেকটা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে পাঠাগার। পাশেই রয়েছে গ্রামের মেয়েদের সেলাই শেখা ও পোশাক তৈরির কারখানা। অন্য একটি কক্ষ থেকে চলে এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, শিক্ষবৃত্তি, চাপকল (হ্যান্ডটিউবয়েল) স্থাপন ও মসজিদ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ।

এতসব কিছু হচ্ছে একটি পরিবারের সব ভাইদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। এই প্রচেষ্টার নাম দেওয়া হয়েছে হাফিজ-নাজনিন ফাউন্ডেশন। নাটোরের লালপুর উপজেলার নিভৃতগ্রাম মোরদহে ফাউন্ডেশনটির অবস্থান। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার পশ্চিম দিকের এই গ্রামটি এখন অনেকের কাছে বিষ্ময় মনে হয়। দশ বছর আগেও কাদা-পানি মাড়িয়ে এই গ্রামে যেতে হতো। এখন গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পাকা রাস্তা। গ্রামে ছিল না বিদ্যুত, এখন প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুতের আলো জ্বলে। এলাকার একমাত্র বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বসার জন্য পর্যাপ্ত কক্ষ ও বেঞ্চ ছিল না। ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সেখানে দ্বিতলভবন নির্মাণসহ বেঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই বিদ্যালয়সহ আশ পাশের বিদ্যালয়ে প্রযুক্তি শিক্ষার জন্য কম্পিউটারসহ আধুনিক সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করা হয়েছে শিক্ষাবৃত্তি। এবারও ৩০ জন শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা করে বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। শত শত শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী গ্রন্থ। এছাড়া এলাকার বেকার ছেলে মেয়েদের কর্মসংস্থানে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।

ফাউন্ডেশনের প্রচেষ্টায় একটি বিদেশি দাতা সংস্থার মাধ্যমে এলাকার ৩০০টি গ্রামে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য তিন হাজার টিউবয়েল বসানোর কাজ চলছে। এ পর্যন্ত ছয় শতাধিক টিউবয়েল বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া লালপুর ও বাগাতিপাড়া উপজেলায় ১০০টি মসজিদ নির্মাণের কাজও এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে ২১টি মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ফাউন্ডেশন চত্ত্বরে একটি দাতব্য স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এখান থেকে দেওয়া হবে বিনামুল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ। গ্রামের মেয়েদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গড়ে তোলা হয়েছে সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ১০টি আধুনিক মানের সেলাইমেশিন দিয়ে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ শেষ হলে তাঁদের বানানো পোশাক বিদেশে রপ্তানি করে তাঁদেরকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করা হবে। এ লক্ষে প্রথম পর্যায়ে সব উপকরণ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হবে। সহযোগীতা নেওয়া হবে প্রতিষ্ঠিত পোশাক কারাখানার।

করোনাকালেও গ্রামের মানুষের পাশে আছে হাফিজ-নাজনিন ফাউন্ডেশন। গ্রামের গরিব করোনা আক্রান্ত মানুষকে অক্সিজেন সরবরাহ করার লক্ষ্যে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে ১০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রদান করা হয়েছে পুলিশ অক্সিজেন ব্যাংককে। ফোন করা মাত্র সেখান থেকে তাঁদেরকে অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে এই ফাউন্ডেশন প্রতি বছর আগস্টের শেষ শুক্রবার মুরদহ গ্রামে আয়োজন করে আলোচনা সভা, মিলাদ মাহফিল ও গণভোজের আয়োজন।
শুক্রবার (২৭ আগস্ট ২০২১) ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে আয়োজন করা হয় এসব কর্মসূচি। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন, সাবেক সচিব ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের সদস্য সচিব এবং কিউরেটর মো. নজরুল ইসলাম খান।
তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ভালো করে পড়ালেখা করবে। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজেকে গড়ে তুলো। তোমরাই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়বে।
ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি আনিছুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, রংপুর রেঞ্জের অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক (এডিশনাল ডিআইজি) শাহ মিজান শাফিউর রহমান।

উপস্থিত ছিলেন, নাটোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বড়াইগ্রাম সার্কেল) খায়রুল আলম, সহকারি পুলিশ সুপার (সিংড়া সার্কেল) জামিল আখতার, লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফজলুর রহমান ও জামালপুরের ডিবির ওসি মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন, বাঘা থানার ওসি সাজ্জাদ হোসেন, আব্দুলপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ধীরেন্দ্রনাথ প্রামানিকসহ প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ সর্বস্তরের মানুষ। দুপুরে ফাউন্ডেশন চত্ত্বরে কাঙ্গালিভোজের আয়োজন করা হয়।
স্থানীয় রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধুকে শুধু কথার বুলি দিয়ে ভালবাসলে হবে না। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। সেই অর্থে হাফিজ-নাজনিন ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে জেনে ভাল লাগছে। সংগঠনটি আজীবন দুস্থ মানুষের পাশে থাকবে, শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করবে-এই প্রত্যাশা করছি।
ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বলেন, তাঁরা পাঁচ ভাই মিলে ২০১৬ সালে এই ফাউন্ডেশনটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রতিষ্ঠানটি জয়েন্ট স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত হয়েছে। তাঁরা সব ভাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাই তাঁদের স্বপ্ন ছিল, স্কুল শিক্ষক বাবা হাফিজুর রহমান ও মা নাজনিন আরা সুলতানার নামে এমন একটি ফাউন্ডেশন গড়া। সম্পূর্ণ অলাভজনক এই প্রতিষ্ঠানটি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন নিয়ে কাজ করবে। সমাজের অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়াবে। সেই লক্ষ বাস্তবায়ন হচ্ছে।
সংগঠনের সহসভাপতি আনিছুর রহমান জানান, অরাজনৈতিক এই সংগঠনটি পরিচালনায় তাঁরা নিজেদের আয়ের একটা অংশ ব্যয় করেন। এছাড়া বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগীতায় পরিচালিত হয়। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় করে রাস্তাঘাট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উন্নয়নে কাজ করে।
সাম্প্রতিক মন্তব্য