মানব ডানায় টিকা-বন্দুকের গুলি
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
২০২০ সাল থেকে বিজ্ঞানীদের উপর দায় চেপেছিল করোনার একটি কার্যকরী প্রতিশেধক আবিষ্কার করার। এজন্য সারা পৃথিবীর মানুষ জীবাণু বিজ্ঞানীদের উপর অনেক ভরসা করে কালক্ষেপণ করেছে। অনেক ধৈর্য্য, অনেক আশা আর অনেক প্রত্যাশার মাঝে কেউ কেউ হতাশাও ব্যক্ত করেছিলেন। যখন করোনার কালো সময়টা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকলো তখন হতাশার মাত্রাও বেড়ে যেতে লাগলো। বিশেষ করে মৃত্যু যখন চীন থেকে ইউরোপে তখন আমরা ভেবেছিলাম ওটা আমাদের অসুখ নয়। আর যখন আমেরিকাকে সাড়ে ছয় লক্ষ মানুষের করুণ মৃত্যু দেখতে হলো, বিশ^বাসী অবাক হয়ে বলতে লাগলো মার্কিনীদের জন্য এটা শাস্তি। মার্কিনীরা তাহলে এ যাত্রাতেও প্রথম স্থান অধিকার করে ফেললো?
২০২০ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পৃথিবীটা শান্ত হয়ে গেলো, বন্ধ হলো সব ধরনের শকট, গাড়ির হর্ণ, নির্মাণ কাজের ঝাঁকুনি, উড়োজাহাজের গোঁঙ্গানি, জাহাজের ভেঁপু, নগর-বন্দরে মানুষের হাঁকডাক। একটি ধোঁয়াহীন, শব্দহীন, ঝাঁকুনিহীন, কোলাহলহীন, নীরব, নিথর শান্ত পৃথিবীর দেখা পেল মানুষ। করোনার আক্রমণে মৃত্যুভয়ে লকডাউনের নামে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল তারা। সেই সুযোগে মানুষ বন্দী অন্দরে, আর বন্য প্রাণীরা সদরে। তারা খুশীতে ডগমগ করে শহরের নিয়ন বাতির আলোতে বিচরণ করতে লাগলো। নির্ভয়ে রাজপথে ঘোরাঘুরি শুরু করে দিল। এমন দৃশ্য নিউইয়র্ক, মাদ্রিদ, আমসটার্ডাম, কুইবেক, নয়াদিল্লী এমনকি রাজশাহী শহরেও প্রত্যক্ষ করা গেল। বন্য পশু-পাখিদের রাজপথে নির্ভয়ে চলাচল করার দৃশ্য সংবাদের শিরোনাম হতে লাগলো। বন্য প্রাণিরা নির্ভয়ে লোকালয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলে মানুষ অবাক হয়ে তাদের সদর্প বিচরণ দেখলো আর করোনাকে দোষারোপ করতে লাগলো।
এভাবে দিন যায়, রাত আসে। আবার রাত পোহায়, দিন আসে। শুধু অপেক্ষা করতে বলে সবাই। এই তো আর কিছুদিন। ক’দিন বাদেই সবকিছু ঠিক্ঠাক হয়ে যাবে বলে আশ^াসের বাণী শোনায় অনেকে।
অনলাইনের সুবাদে কত লেখা, কত গবেষণা রিপোর্ট, কত অনুসন্ধান, কত সন্দেহ, কত ছবি, কত ভিডিও বার্তা বের হয় করোনাকে নিয়ে। কত কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, কত কদর্য রাজনীতি, কত দোষারোপ চলতে থাকে চীন-মার্কিন- বৃটিশ-রুশ রাজনীতিক ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে। কার ভুলে কোন ল্যাব থেকে মানব তৈরী করোনা নাকি প্রাকৃতিক করোনা পিঞ্জর ছেড়ে বাইরের বাতাসে পাখা মেলে মানুষের পাঁজরে বসতি শুরু করে দিয়েছে- তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত ও অভিযোগ শোনা যেতে লাগলো। কেউ দোষ স্বীকার করলো না। চীনের এক ডাক্তার তাদের ল্যাবের লিক হওয়া তথ্য প্রকাশের দায়ে গ্রেপ্তার হলে চীনের উপর সন্দেহ বেড়ে গেল। পরে ওই ডাক্তার বেচারীর মৃত্যু হলে ঘটনাটির কারণ আর বেশী দূর গড়ায়নি। মার্কিনীরা চীনকে দোষারোপ করে তদন্ত টিম প্রেরণ করলেও চীন সেই টিমকে ততটা সহযোগিতা করেনি বলে নির্বাচনের পূর্বে ট্রাম্প প্রশাসন হৈ চৈ করলেও কেউ ততটা পাত্তা দেয়নি সেই ঘটনাকে।
জুলাইতে ইউরোপে সংক্রমণ শুরু হয়ে যায়। ইটালেিত সাড়ে তিন হাজার মানুষ মারা যান করোনা সংক্রমণে। এরপর ফ্রান্স, তুরস্ক, রাশিয়া, স্কান্ডিনেভিয়ান দেশসমুহ, বৃটেন সবাই আক্রান্ত হয়ে গেলে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তান্ডব শুরু হয়ে যায়। সেখানে ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩ হাজার ৭১ জন। ২০২০ সালে এপ্রিলের পর একদিনে এ সংখ্যা সর্বোচ্চ। তার আগে মার্চ মাসে ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’ উপলক্ষে কর্তৃপক্ষের ঘরে থাকার সতর্কতা উপেক্ষা করে লাখ লাখ মানুষ ভ্রমণে বের হয়েছিল। তখন থেকেই সংক্রমণ ও মৃত্যু সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা ছিল, সেটাই সত্যি হয়েছে।
এরকম সময় টিকা তৈরীর জন্য চিন্তাভাবনার খবর সংবাদের শিরোনাম হতে শুরু করে। করোনার সময় টিকার ইতিবাচক খবরে ইবলিসের বংশধররা মায়াকান্না করে একদিকে মোহনীয় বক্তব্য দেয়, অন্যদিকে খুশি হয়ে সেখান থেকে অবৈধ আয়ের স্বর্ণালি সুযোগ তৈরি করার জন্য মরিয়া হয়ে হ্যাকিংয়ে নেমে পড়ে, যা মানবতার জন্য নতুন বিপর্যয় সৃষ্টি করতে শুরু করেছিল। প্রতিেিযাগিতা করেও একটি কার্যকরী টিকা আবিষ্কার নিয়ে তেমন অগ্রগতি হয়নি।
ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট ও ভারত বায়োটেকের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন সে সময় জরুরিভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমোদন পায়নি। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চের প্রধান বলরাম ভার্গভ জানিয়েছিলেন, ‘ভ্যাকসিনের উপকার ও ঝুঁকির অনুপাত সন্তোষজনক হলে তবেই কোনো সংস্থাকে প্রতিষেধক বাজারে ছাড়ার ছাড়পত্র দেয়া হয়।’ অক্সফোর্ড, ফাইজার-বায়োএনটেক, মর্ডানা, সিনোভ্যাক, রচে, সানোফি, বঙ্গভ্যাক ইত্যাদি নানা নামের কোম্পানী নানা দেশের হয়ে একটি কার্যকরী টিকা আবিষ্কারে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। তবুও দীর্ঘদিন কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
চীন সে সময় একটি ককটেল টিকা আবিষ্কার করার প্রচেষ্ট চালায়। সেটাতেও কোন সফলতা আসেনি।
টিকা আবিষ্কার নিয়ে দেশে দেশে বিপুল প্রতিযেগিতা শুরু হয়ে যায়। ২০২০ সালের শেষে রাশিয়ার স্পুৎনিক -৫ প্রথম স্থান দখলের জন্য প্রেসিডেন্টের মেয়েকে দিয়ে সর্বপ্রথম টিকার ট্রায়ালের খবর প্রকাশ করে। ২০২১ সালের আগষ্টে এখন পর্যন্ত তার কার্যকারীতার সংবাদ জানা গেল না। ভারত একসময় রাশিয়ার স্পুৎনিক টিকা আমদানির কথা বললেও তা পরবর্তীতে কোন পর্যায়ে গিয়েছিল সেটা আর জানা যায় নি।
অন্যদিকে আবিষ্কৃত টিকার ট্রায়াল নিয়ে সমস্যা শুরু হয়। ট্রায়াল শেষ হয় না, অসুস্থ হয় পরীক্ষণপাত্র। টিকা প্রদান শুরু করা প্রথম দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা প্রদান শুরুর একদিন পর সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বিবিসি বলেছে, মারাত্মক অ্যালার্জিজনিত সমস্যা রয়েছে এমন মানুষের এ টিকা নেয়া উচিত নয়। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের দু’জন কর্মী ভ্যাকসিন গ্রহণের একদিন পর তাদের শরীরে অ্যালার্জিজনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ার পর এ সতর্কতা জারি করা হয়েছিল।
ছড়িয়ে পড়ে করোনা- মার্কিন, কানাডা হয়ে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, মেক্সিকো, পেরু, আফ্রিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ সব মহাদেশে ঢুকে পড়ে করোনা। ভারতে সংক্রমণ সবচেয়ে তীব্র আকার ধারণ করে ২০২১ সালের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত।
ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুযায়ী পৃথিবীতে আগষ্ট ১৫, ২০২১ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, ২০ কোটি ৭২ লক্ষ ২১ হাজার মানুষ। মারা গেছেন ৪৩ লক্ষ ৬২ হাজার। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত টিকাগুলোর কোনটিই ১০০% কার্যকারীতা দেখাতে পারেনি। অনেকের দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেবার পরও পুনরায় সংক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
ইন্দোনেশিয়ায় পুনরায় সংক্রমণ শুরুর কারণ নাকি সিনোফার্মার অকার্যকর টিকা! এক সংবাদে জানা গেছে ইন্দোনেশিয়ায় সংক্রমণ ঠেকাতে না পারায় চিকিৎসক সহ হাজার হাজার মাানুষ করেনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।
একজন গবেষক তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন, “ইন্দোনেশিয়ার ৯৫ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী চীনের সিনোভ্যাকের তৈরি করা কভিডের ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছিল। দেশটির হাসপাতাল অ্যাসোসিয়েশন দাবি করেছে, এইসব স্বাস্থ্যকর্মীর অনেকেই করোনা পজিটিভ হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার চিকিৎসা পরিষদ দাবি করেছে, সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন শরীরে তেমন অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারছে না। তাদের হিসেব অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সিনোভ্যাকের টিকা নেয়া অন্তত ২০ জন চিকিৎসকসহ ১৩১ স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে জুলাইয়ে মারা গেছে ৫০ জন। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো, দেশটিতে সিনোভ্যাকের টিকা আবিষ্কারে যিনি প্রধান বিজ্ঞানী হিসেবে তদারকি করছিলেন, সেই বিজ্ঞানী নোফিলিয়া কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে নানার সমালোচনার মুখে পড়েছে চীনের সিনোভ্যাক টিকা।” লেখক আরো উল্লেখ করেন,“ টু-বি অনেষ্ট আমরা সিনোভ্যাকের ডেটায় এখনো সন্তুষ্ট হতে পারিনি। গত ২৪ জুন আমাদের মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল-বিএমআরসি সিনোভ্যাক বায়োটেকের টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছিল। এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বা ক্লিনিকাল ট্রায়াল পরিচালনার কাজ করছে আইসিডিডিআর,বি। আমরা দেশে সিনোভ্যাকের প্রয়োগের আগে সেই ডেটাগুলো জানতে চাই। জনগণের সামনে সেই ডেটা প্রকাশ করা হোক। বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে, চীনের টিকা প্রয়োগের আগে আরও কিছু সময় নেয়া। ট্রায়ালের ডেটা পাওয়ার পরই সরকারকে এই বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হবে তার আগে কখনোই নয়।”(নাদিম মাহমুদ, পোস্টডক্টোরাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। (http://tistatimes24.com/07.08.2021)
২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশে সংক্রমণ শুরু হলেও এর তীব্রতা দেখা দেয় ২০২১ সালের জুন মাস থেকে । জাপান, কোরিয়া, চীন ও ইন্দোনেশিয়ায় পুনরায় সংক্রমণ শুরু হয়। আগষ্ট ০৫, ২০২১ তারিখে ইন্দোনেশিয়ায় ২৪ ঘন্টায় ১৬০০ জনের মৃত্যুর খবর জানা গেছে।
করোনায় জীবন-জীবিকার প্রশ্ন শুরু হয়। অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি সবকিছুই করোনার প্রভাবে টলটলায়মান হয়ে পড়ে। বিশ^দারিদ্র্য, গণবেকারত্ব, খাদ্য সংকট দেখা দিতে শুরু করে।
সারা দুনিয়ার মানুষ করোনা নিয়ে চরম বিপাকে দিন গুজরান করে চলেছে। করোনার কারণে জরুরী অনেক বিষয় থেকে মানুষ মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছে। ফলে প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিপাশির্^ক, মানসিক ও দৈহিক সকল বিষয়ে মহা দুর্যোগের ঘনঘটা একসংগে নাড়া দিয়ে মানুষকে বিপর্যস্ত ও বেসামাল করে তুলেছে।
সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এসকল প্রাকৃতিক মহা দুর্যোগ হলো দাবানল, ঘূর্ণিঝড়, খরা ও তাপদাহ, অগ্নিকান্ড, বজ্রপাত, বন্যা, ভূমিধ্বস, সাগরডুবি ইত্যাদি। সম্প্রতি চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে পদ্মা নদীর তীরে একটি শেডে আশ্রয় নেয়া বরযাত্রীদের ১৭ জন একসাথে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন।
এছাড়া মানবসৃষ্ট অনাচার ও সমস্যাগুলো হলো- মাদকাসক্তি, কিশোর গ্যাং, মাফিয়াদের হানা, সাইবার অপরাধ, নারী পাচার, দেহব্যবসা, মাদকাসক্তি ও মাদক ব্যবসা, ব্যাংক হ্যাকিং, সুন্দরী নারী লেলিয়ে দিয়ে ব্লাকমেইলিং, রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীদের দ্বারা অবৈধ তদ্বির, জুয়ার ক্যাসিনো, ছিনতাই, চুরি ডাকাতি, ত্রাণচুরি ইত্যাদি তো লেগেই আছে।
টিকা তৈরীর আশার বাণী শোনার পর রাজনীতির কারণে গরীব দেশের মানুষের ঘুম হারাম হয়ে যায়। অগ্রিম বায়না দিয়ে অর্থ পরিশোধ করা হলেও আমাদের দেশে অক্সফোর্ড-এস্ট্রোজেনেকার টিকা সরবরাহ চুক্তি বাতিল করে ভারত। বাংলাদেশের বন্ধুর আচরণে চোখে অন্ধকার দেখা শুরু হয় জনগণের। নিরুপায় হয়ে টিকা প্রাপ্তির ভিন্ন উৎসের সন্ধানে নেমে পড়ে সরকার।
করোনার টিকা নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়ে যায়। গরীব দেশগুলো টিকার জন্য এত বেশী অর্থ খরচ করতে অপারগ হওয়ায় সংকট তৈরী হয়ে যায়। আবার টাকা অগ্রিম দিয়েও প্রত্যাশা ও সময়ানুযায়ী টিকার সরবরাহ না পেয়ে মৃত্যুসংকট তৈরী হয়।
আসি আসি করে আমদানীকৃত টিকা আসে না। সরবরাহ কমে গিয়ে টিকা সংকট বিশ^কে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে থাকে। দেশে টিকা তৈরীর প্রচেষ্টায় বিদেশীরা তাদের সুনির্দিষ্ট র্ফমুলা সরবরাহ করতে চায় না। তাই কাজটি থমকে গেছে।
সারা দেশে ১৪০০ কেন্দ্রে টিকা দান শুরু হয় আগষ্টের ১ তারিখে। কিন্তু একটি কেন্দ্রে ৬০০ জনের টিকার ডোজ সরবরাহ করা হলে সেখানে মানুষ জড়ো হয় ৬ হাজার। ফলে টিকা প্রদান নিয়ে বিশৃংখলা ও অরাজকতা দেখা যাচ্ছে।
আমাদের ১৬ কোটি মানুষের মাত্র ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ এ পর্যন্ত টিকা নিতে পেরেছে। এসব টিকা নানা দেশের নানা কোম্পানীর। অক্সফোর্ড, ফাইজার, মডার্না, সিনোফার্মা, কোভ্যক্স, বঙ্গভ্যাক্স, স্পুৎনিক আরো কত নাম এদের। তবে অক্সফোর্ড, ফাইজার, র্র্মানা, সিনোফার্মার মধ্যে সীমাবদ্ধ আছি আমরা। একটি টিকা ‘কার্তুজের’ পাওয়ার মানব শরীরে কতদিনের জন্য বলবৎ থাকবে? টেকসই কতদিনের জন্য? এন্টিবডি কতদিন থাকবে? টিকার কার্যকারীতা কতদিন? এ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কেউ বলছেন ছয়মাস, কেউ বলছেন এক বছর। তেমন কোন ভাল গবেষণা রিপোর্ট পাওয়া যায়নি এ বিষয়ে। কোন কোন দেশ এজন্য বুষ্টার ডোজ প্রদানের কথা ভাবছে।
ঘোষণায় এসছে যে, ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার টিকা না দেয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে না। আগষ্ট ১২, ২০২১ তারিখে শোনা গেল এসএসসি পরীক্ষা আগামী নভেম্বরের ১৫ তারিখে এবং এইচএসসি পরীক্ষা ডিসেম্বরে শুরু হবে। যদি করোনা পরিস্থিতি অনুকুলে থাকে তাহেলে! আবারো দোদুল্যমান সিদ্ধান্ত জাতিকে হতাশায় নিমজ্জিত করে তুলছে। আগষ্ট ১২, ২০২১ তারিখে ঢাকার একটি টিকা প্রদান কেন্দ্রে টিকা প্রত্যাশীদের সাথে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী কর্মীদের মারামারি হয়েছে। অপ্রতুল টিকা ও তা প্রদানে অব্যবস্থাপনার ফলে শিক্ষার্থীরা সময়মত টিকা দিয়ে শ্রেণিকক্ষে যেতে পারবে কি-না তা বোধগম্য নয়।
তবুও টিকা নেয়ার জন্য মানুষের হঠাৎ আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় টিকা ব্যবস্থাপনায় চরম সংকট তৈরী হয়েছে।
সাধারণ মানুষ এতদিন অবহেলা ও অনুযোগ করে টিকার বিরুদ্ধে নানা কথা বললেও এখন চারদিকে মৃত্যুর ভয়াবহতা লক্ষ্য করে বাঁচার তাগিদে টিকা নেবার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে কেন্দ্রগুলোতে। সবার এখন টিকা দেব, টিকা চাই, টিকা কেন নাই প্রশ্ন। তারা জেনে গেছে- করোনাকাল শুধু এক-দুই বছর নয় এক-দুই যুগ স্থায়ী হতে পারে। হয়তো করোনাকে সাথে নিয়ে জীবন-জীবিকা চালাতে হবে বাকী জীবনটার জন্য।
টিকা বন্দুকের গুলি হাতের ডানায় ছিদ্র করে ঢুকিয়ে নিয়ে বাঁচতে হবে। এক ডোজ নয়, দু’মাস পরে দ্বিতীয় ডোজও নিতে হবে। তা ছাড়া আপাতত: কোন গত্যন্তর নেই বলে মনে হয়। তাই টিকা-বন্দুকের গুলিকে যারা ভয় পেত তারাও এখন ভয়-ডর ভুলে নিকটস্থ টিকা কেন্দ্রে ছুটছে নিজের ডানা ফুটো করে টিকার সামান্য ব্যথার পরশ অনুভব করতে। কারণ, জীবন সবার জন্য বড় দামী জিনিষ। এটাকে আর কোন অবহেলা নয়। কবি সেই কবেই বলেছেন তাঁর মনের কথা, ‘মরিতে চাহি না আমি এই সুন্দর ভুবনে’।
হ্যাঁ, এই মায়াবী ভুবনে মায়ার জীবন সাজিয়ে ভাল কিছু করার জন্য এখন কোভিড সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সবাইকে বেশী বেশী সচেতন হবার সময় ঘনিয়ে এসেছে। কোভিডাক্রান্তদের যত্ন নিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। আমাদের দেশ থেকে কোভিড এর ডেল্টা ভেরিয়েন্ট শীঘ্র পাততাড়ি গুটিয়ে নিরুদ্দেশে যাক সেই কামনা করি। এজন্য একটি সমন্বিত প্রক্রিয়ায়, সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কার্যকরী টিকা ক্রয়, বন্টন ও প্রদান নিশ্চিত করে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনজীবনে দ্রুত স্বস্তি ফিরে আনা যায় সেদিকে নজর বাড়াতে হবে।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd
সাম্প্রতিক মন্তব্য