logo
news image

এত কান্নায় সান্তনার ভাষা নেই

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
আগষ্ট ১০,২০২১ তারিখে পুনরায় বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মত করোনা সংক্রমণে রেকর্ড সংখ্যক মৃত্যু হয়েছে- ২৬৪ জনের। যাঁরা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তাদের সংখ্যা ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে বেশী। তাঁদের ৯৮% ডেল্টা ভেরেয়েন্ট দ্বারা সংক্রমিত বলে গণমাধ্যমে জানা গেছে। যদিও গ্রামাঞ্চলের মানুষ কুসংস্কারের ভয়ে এখনো করোনা টেষ্ট করাতে ততটা আগ্রহী নয় বলে দেশের করোনায় মৃতদের পরিসংখ্যন নিয়ে বিভ্রান্তির অবসান হচ্ছে না।
জুলাই ২০২১ মাসে দেশে গড়ে প্রতিদিন ২০০ জন করে করোনাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আগষ্টের প্রথম ০৯দিন গড়ে এই মৃত্যুসংখ্যা বেড়ে প্রতি ২৪ ঘন্টায় দাঁড়িয়েছে ২৪৮.৮ জনে। সরকারী হিসেবে দেশে প্রতি ঘন্টায় গড়ে ১২ জন রোগী মারা গেলে হাসপাতালের বারান্দায়, দরজায়, বাইরে, স্বজনেরা পরস্পরকে ধরে জড়াজড়ি, হাউমাউ, কান্নাকাটি করে পরিবেশ বিষাদ করে তুলছেন প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত তা দেখে কেউ কি স্বাভাবিক থাকতে পারেন? এ কান্নায় সান্তনা দেবার উপায় নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করেনায় মৃত্যুসংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া খুবই ভয়ংকর ব্যাপার। এই হার আগামী সেপ্টেম্বর ২৫ তারিখের দিকে বেড়ে আরো ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরী হতে পারে এবং আগামী অক্টোবর হতে পারে আমাদের দেশের জন্য করোনার তীব্রতার ‘পীক’ পয়েন্ট!
আগষ্ট ১১ তারিখে লকডাউন শিথীল করে অফিস, মার্কেট, পরিবহন সব খুলে দেয়া হচ্ছে। যে সিদ্ধান্তে বিশেষজ্ঞদের ভিন্ন মতামত ও প্রতিবাদ লিপি দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার সে কথায় কর্ণপাত না করে অর্থনীতি বাঁচানোর কথা বলে পাশ কাটিয়ে চলছেন। অথচ, বিদ্যালয় খুলে দেবার খবর নেই।
করোনা রোগী নিয়ে মানুষ ঢাকায় এসে হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে আহাজারী করলেও সরকারের টনক নড়ছে না। ভিন্ন কায়দায় মানুষের মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছেন নায়িকাদের বাসায় মদের বোতল উদ্ধার করে টিভিতে প্রদর্শন করার মাধ্যমে। এক নায়িকার বৃদ্ধ নানা কান্নাকাটি করে বলছেন, আমার নাতনি ওগুলোর সংগে মোটেও জড়িত নয়। আমি ওর সম্পর্কে যতটুকু জানি তাতে নিশ্চিত যে, সে ওসব কিছুই জানে না।
ইতোমধ্যে তাকে দ্বিতীয়বার রিমান্ডে দেয়া হয়েছে। কোর্টের সামনে পুলিশের টানা হেঁচড়ার মধ্যে সেই নায়িকা উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলছেন আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। তোলপাড় চলছে জনপ্রিয় নায়িকাকে নিয়ে। সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, বিচারের আগেই তার বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে একদল অতি উৎসাহী মানুষ। একজন দাগী পুরুষ সন্ত্রাসীর বেলায় এত পুলিশি নিরাপত্তা বলয় চোখে না পড়লেও তার বেলায় অসংখ্য নিরাপত্তা সদস্য ঘিরে রয়েছে-যা একজন নায়িকার জন্য বেমানান মনে হচ্ছে। তাকে কোর্টের সামনে টানা হেঁচড়া করা হচ্ছে- তিনি চিৎকার করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে বলছেন, আমি অপরাধী নই। আমাকে জোর করে মামলায় জড়ানো হচ্ছে। একজন বিখ্যাত লেখক তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট বিষয়টি গণমাধ্যমে তুলে ধরেছেন তাঁর লেখণীর মাধ্যমে।
একজন নয়, আরো কয়েকজন জনপ্রিয় নায়িকার বিরুদ্ধে রুচিহীন প্রচারের মাধ্যমে আত্মমর্যাদা ক্ষুন্ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন তিনি। আসলে দেশে কারো বিরুদ্ধে বিচারে অভিযোগ প্রমাণিত হবার আগে তিনি অপরাধী নন-এমন ধারণা আইনে বলবৎ থাকা সত্ত্বেও যে কাউকে ধরে এন শত শত ক্যামেরা ও মানুষের সামনে তাকে নাজেহাল করার একটি রুচিহীন ও বেআইনী প্রক্রিয়া চালু হয়ে গেছে। যেটা মানবাধিকারের সুস্পস্ট লঙ্ঘণ। এসব বেআইনী কাজ কার নির্দেশে হচ্ছে তার কথা জনগণের কাছে গোপন থাকছে কেন? সকল অন্যায় কাজে নির্দেশ দাতাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
দেশে এখন যে কঠিন ক্রাইসিস বা করোনার মুসিবত চলছে তাতে মানুষের কান্না ও আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠলেও সেদিকে কর্ণপাত না করে কয়টি ইয়াবা বা খালি মদের বোতল উদ্ধারের নামে যে ভীষণ তৎপরতা চলছে তা দেখে মনে হচ্ছে- শুধু নায়িকারা বা তাদের সহযোগীরাই মাদক সেবন করে, ব্যবসা করে। আসলে তা-তো নয়। অবৈধ মাদক ব্যবসার মহারথীদের গায়ে হাত দেয়া হচ্ছে না কেন? সীমান্তে পাহারাদারগণ সদা জাগ্রত থাকলেও মাদকদ্রব্য কীভাবে দেশে ঢুকে? বিমানবন্দরে এত নজরদারী ক্যামেরা থাকার পরও কীভাবে বিদেশী মদ, খাট, ইয়াবা, ক্রিষ্টাল মেথ, আইস, গাঁজা, চেকপোষ্ট দিয়ে বের হয়ে দালালের হাত ঘুরে মানুষের ঘরে ঘরে চলে যায়?
ডিজিটাল যুগে হাইস্পীড নেটের বিপরীতে ফায়ারওয়ালহীন অবাধ হাইস্পীড অনলাইন পর্নোগ্রাফীর ব্যবসা কারা নিয়ন্ত্রণ করছে? ঘরবন্দী ছাত্র-যুবকদেরকে অবাধ নীল ছবির নেশায় সারাক্ষণ বুঁদ করে রাখছে কারা? এজন্য সামাজিক অনাচার ও ধর্ষণ বেড়ে গেছে বহুগুণ। এগুলোর সদুত্তর কে দেবেন?
মুহূর্তে অতিমারী করোনার ডেল্টা ভেরিয়েন্টের নখের থাবায় মানুষ আক্রান্ত হয়ে থেতলে যাচ্ছে। সেদিকে সবার নজর দেয়া উচিত। যদিও মাদক কারবারীরা এই কদর্য সময়ের সুযোগ নিয়ে অপকর্মের পরিধি শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে তথাপি মানবতা বিধ্বংসী করোনা নির্মূলে সবার বেশী সময় দেয়া উচিত।
ঢাকাসহ দেশে মাদকের চাহিদা প্রবল হয়েছে বিত্তবানদের রসনা বিলাসের জন্য। সেকারণে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়া সত্ত্বেও মাদকের মত হারাম জিনিষের বিশাল বাজার তৈরী হয়েছে দেশে। এই বাজার ধ্বংস করতে হলে মানুষের নৈতিকতা পরিবর্তনে জোর দিতে হবে। দু’একজন নায়িকাকে মাদকের অভিযোগে অভিযুক্ত করে হঠাৎ টানা হেঁচড়া করলে মুক্তি মেলা সুদূর পরাহত। কারণ, মূল হোতারা সেই সুযোগে বিদেশে গিয়ে গা ঢাকা দেয়। দেশের মাদক নির্মূলে দীর্ঘমেয়াদী সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন।
আপনারা গোপন জরিপ করুন, কতজন বিত্তশালী আমলা, নেতা, ব্যবসায়ী, ছাত্রনেতা, ড্রাইভার প্রমুখের এক পেগ ভদ্কা বা বিয়ার, এক পিস ইয়াবা বা এক নস্যি গাাঁজায় টান না দিলে রাতে ঘুম হয় না। তাদেরকে চিহ্নিত করে ধরুন, বিচার বা সংশোধন করুন। মাদকের বাজার ও চাহিদা বন্ধ হলে নায়িকারা ওদের হয়ে নাচতে যাবে না।
লকডাউন বলবৎ থাকায় এতদিন গ্রামের করোনা রোগীরা ঢাকায় আসার তেমন সুযোগ পাননি। আগষ্ট ১১ তারিখের পর ট্রেন. বাস চালু হলে গ্রামের রোগীরা দলে দলে ঢাকার দিকে  এসে হাসপাতালে ভীড় করতে থাকবে। তখন উপায় কী হবে?
পাশাপাশি একই সময়ে মরণব্যাধি ডেঙ্গির প্রকোপে নাস্তানাবুদ রাজধানীবাসী। আগষ্ট ১০, ২০২১ তারিখে ডেঙ্গিতে  নতুন করে ২৪৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ১০ বছরের শিশু শাবাব সহ ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটি ডেঙ্গি ওয়ার্ডে হাসপাতালের বিছানায় শিশুর সংখ্যা বেশী। ধানমন্ডির এক হাসপাতালের বেসমেন্টে অসংখ্য এডিসের লার্ভা পাওয়া যওয়ায় ১ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আগষ্ট ১১ দূরপাল্লার ট্রেন. বাস চালু হলে ঢাকার এডিস মশা সারা দেশে ডেঙ্গি ছড়িয়ে দিয়ে আরেক মরণঘাতী মহামারী শুরু করে দেবে। তখন সেটা সামলাবে কে?
করোনার কারণে জরুরী অনেক বিষয় থেকে মানুষ মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছে। ফলে প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিপাশির্^ক, মানসিক ও দৈহিক সকল বিষয়ে মহা দুর্যোগের ঘনঘটা একসংগে নাড়া দিয়ে মানুষকে বিপর্যস্ত ও বেসামাল করে তুলেছে। একইসংগে মানুষের রোগ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে পৃথিবীতে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। টিকা বেচা-কেনা নিয়ে বড় দেশের দর কষাকষি ও ঘৃণ্য ব্যবসা মানুষকে আগামী দু-এক বছরের মধ্যে কোথায় গিয়ে ঠাঁই দেবে তা এখনই একটু আঁচ করা যায়।
দীর্ঘমেয়াদী করোনার প্রভাবে কর্মাভাব, খাদ্যাভাব, আয়অভাব ও চিকিৎসার অভাবে  মৃত, স্বজনহারা মানুষেরা দ্বিগ্ভ্রান্ত হয়ে আরকেটু বেশী ছোটাছুটি শুরু করলে কেউ কোন আইন-কানুনকে আর তোয়াক্কা করতে চাইবে না। যেমন ‘লুডিট’-দের কুৎসিত তৎপরতা শুরু হয়েছিল কালো প্লেগের সময় লন্ডন তথা গোটা ইউরোপ জুড়ে। সেরকম কিছু না হোক সেটা আমাদের কাম্য। বিশেষজ্ঞদের ধারণা যেন অমূলক হয়। তবে তার থেকে খারাপ বা ব্যতিক্রম কিছু শুরু হলে অত কান্নায় আকাশ ভারী করা গণ-আহাজারীতে সে সময় আন্তরিকভাবে কাউকে সান্তনা জানানোর জন্য কেউ স্বেচ্ছায় পাশে এসে মাথায় হাত বুলাবে বলে মনে হয় না।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। | E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top