logo
news image

সাইদুরের স্বপ্ন এখন দুয়ারে

ইমাম হাসান মুক্তি, প্রতিনিধি, লালপুর (নাটোর)
২০১৪ সালের কথা। নাটোরের লালপুরের আব্দুলপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছেন মো. সাইদুর রহমান। এসএসসিতেও জিপিএ-৫ পান তিনি।
সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। কোচিং করতে সাইদুর রহমান রাজশাহীতে যান। সপ্তাহের তিন দিন কোচিং করতে বাড়ি থেকে সকালে ট্রেনে করে রাজশাহী যান। রাতে আবার ফিরে আসেন। কোচিংয়ের ফাঁকে ও বাড়ি ফেরার আগে যে সময় পান শার্ট-প্যান্ট পরে কাঁধে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে শহরে রিকশা চালান তিনি।
মা সাগরী খাতুন বলেন, সাইদুরের ছয় মাস বয়সে তাঁর বাবা শামসুল হক ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান। এরপর ছেলেকে নিয়ে শুরু হয় জীবনসংগ্রাম। ভিটেমাটি না থাকায় অন্যের কৃপায় কোনো রকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। কখনো মানুষের বাড়িতে, কখনো নির্মাণশ্রমিকের কাজ করেন। অভাব-অনটনের মধ্যে তিনি স্বপ্ন দেখতেন ছেলেকে নিয়ে।
ক্লাস সিক্সে ওঠার পরই সে ভ্যান (রিকশা) চালাতে শুরু করে সাইদুর। স্কুল থেকে এসেই আবার ভ্যান নিয়ে বের হয়। আবার রাতে বই নিয়ে বসে।
তিনি আরো বলেন, কুপি বাতিতে পড়তে দেখে এইচএসসি পরীক্ষার আগে তার মামা বাড়ি থেকে বিদ্যুতের লাইন দিয়ে একটা বাতি লাগিয়ে দেন। অন্য মানুষের জমিতে সরকারি টিনের ঘরে থাকেন।
সাইদুর রহমান বলেন, সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কোচিং করতেন। কিন্তু ফেরার ট্রেন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। তাই ওই সময়টা রিকশা চালাতেন। এলাকার এক বড় ভাই একটি গ্যারেজ থেকে আধা বেলার জন্য রিকশা ভাড়া করে দেন। বেলা একটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত জমা ৫০ টাকা। এরপর ১০০ টাকার ওপরে থাকতো। আর বাড়িতে থাকলে ভ্যান চালাতেন।
বিষয়টি তৎকালীন নাটোরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মশিউর রহমানের নজরে আসলে ২০১৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি সাইদুরের পড়াশুনার জন্য ৫০ হাজার টাকার চেক প্রদান করেন। একই সঙ্গে বাড়ি করার জন্য একটি খাসজমি বন্দোবস্ত দেওয়ারও আশ্বাস দেন।
সাইদুর রহমান বলেন, ২০১৫ সালের ৫ এপ্রিল তার মা মোছা. সাগরী বেগমের নামে আব্দুলপুর মৌজার ১ নং খতিয়ানভূক্ত ৬১১ নং দাগে ০.১০ একর খাস জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। যার বিপক্ষে মো. সাদেক আলী নামে এক ব্যক্তি নাটোরে লালপুর সহকারী জজ আদালতে মামলা করে দখলে বাধা দেন। যার নম্বর ১৪৬/১৫। মামলার রায় না হওয়ায় জমির ভোগদখল করতে পারছেন না। আইনী প্রক্রিয়া শেষ করে জমির দখলের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন তিনি।
সাইদুর রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ২০১৫ সেশনে ভর্তি হন তিনি। ২০২০ সালে স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় ওই জিপিএ ৩.৭১ পয়েন্ট নিয়ে বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। বর্তমান তিনি রাবিতে ‘অর্থনীতি’ ও ‘ল এন্ড ল্যান্ড’ দুটি বিষয়ে এক বছরের ডিপ্লোমা করছেন। তাঁর থিসিসের বিষয় হলো, ‘রোল অফ পিপলস পার্টিসিপেশন লোকাল গভর্ণেন্স ইন বাংলাদেশ’। তিনি সম্প্রতি প্রকাশিত ৪১তম বিসিএস (প্লিলিমিনারী) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করার ইচ্ছে তাঁর। স্বপ্ন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
সোমবার (৯ আগস্ট ২০২১) নাটোরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) শামীম আহমেদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে একজন সংগ্রামী মায়ের সম্মানে মোছা. সাগরী খাতুনকে দিয়ে বর্তমান ভিটেতে একটি বসত ঘর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাম্মী আক্তারের সভাপতিত্বে এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন, লালপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. ইসাহাক আলী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফুল ইসলাম, জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা সালাউদ্দিন আল ওয়াদুদ, নাটোর পল্লী বিদ্যুৎ-২ লালপুর জোনাল অফিসের ডিজিএম রেজাউল করিম খান, উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা উমিরুল ইসলাম, একাডেমিক সুপারভাইজার সা’দ আহমাদ শিবলী, লালপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক পলাশ, নাটোর জেলা পরিষদ সদস্য মতিউর রহমান মতি, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম বাঘা প্রমুখ।
এরপর তিনি লালপুর কলোনীতে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসরত ৩৯ পরিবারের মধ্যে হস্তান্তর সনদ, খাদ্যসামগ্রী, গাছের চারা, করোনা সুরক্ষা সামগ্রী ও মিষ্টি বিতরণ করেন।
লালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাম্মী আক্তার বলেন, জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে সাইদুর রহমানের একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নাটোরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) শামীম আহমেদ বলেন, সাইদুর রহমানের মা সাগরী খাতুনের বাবার দেড় শতাংশ জমিতে একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। বন্দোবস্তকৃত জমির সমস্যা দ্রুত সমাধান করে দখল বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top