প্রহসনের তালা ও চাকুরী বাঁচাতে ঢাকামুখী আতঙ্কিত শ্রমিকেরা
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
চৌদ্দ দিনব্যাপী সারা দেশে অতি কঠোর লকডাউনের নামে আবারো অতি প্রহসন ও চরম সমন্বয়হীনতা প্রত্যক্ষ করলো দেশবাসী। করোনার সংক্রমণ গ্রামবাসীকে নাকাল করে ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি করেেছ। গ্রাম-গঞ্জে চিকিৎসা না পেয়ে তারা অনেকেই ছুটছেন রাজধানীতে। ফলত: রাজধানীর হাসপাতালেও শয্যা নেই, নেই আইসিইউ বা পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা। শুধু এম্বুলেন্স নিয়ে মুমূর্ষূ রোগী নিয়ে স্বজনেরা এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটাছুটি করে সময় পার করে রোগীর প্রাণবায়ু নি:শেষ করে ফেলছেন। শেষে আহাজারি ও কান্নাকাটি করে আকাশ-বাতাস ভারী করে তুলছেন। গত দু’সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন গড়ে ২০০-এর উপরে মৃত্যু ঘটছে শুধু হাসপাতালে আসা রোগীর মৃত্যুর পরিসংখ্যান হিসেব করে। দেশের আনাচে কানাচে সংক্রমণের তীব্রতা অনেক বেশী। কিন্তু সেসব মৃত্যুর পরিসংখ্যান নেই। কারণ, গ্রামের মানুষ টেষ্টের খরচ ও কুসংস্কারের ভয়ে করোনা টেষ্ট করাতে রাজী হচ্ছেন না।
এই অবস্থার মধ্যে পার হয়ে গেল কোরবানী ঈদের ছুটি। রাজধানী থেকে লকডাউনের মধ্যে পায়ে হেঁটে মানুষ আপন গ্রামের দিকে ছুটেছে। যারা বাড়িতে গেছেন তাদের উৎসব কেটেছে উৎকন্ঠায়। আগামী ৫ আগষ্ট পর্যন্ত সরকারী ছুটি থাকলেও তৈরী পোশাক ও কারখানা মালিকেরা ফোন করে ঈদের পরদিনেই কর্মস্থলে ফিরে আসার তাগাদা দিলে শুরু হয় হতাশা। কীভাবে ঢাকায় বা কর্মস্থলে ফিরবেন সেজন্য দু:শ্চিন্তায় অনেকের উৎসবের আনন্দ মাটি হয়ে গিয়েছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকাবস্থায় পায়ে হেঁটে, মোটর বাইক, ফেরী লঞ্চ, নৌকা, অটোরিক্সা, ট্রাকে, লরীতে চড়ে ভ্রমন করেন। এসব যানবাহন পর্যাপ্ত না থাকায় অনেক মানুষ একসংগে গাদাগাদি করে তিনগুণ বেশী ভাড়া দিয়ে ঈদের পরদিনই তারা পুনরায় কর্মস্থলে ফিরতে থাকলে শুরু হয় চরম বিপত্তি। পথে স্বাস্থ্যবিধির কোন বালাই তো নেই, আছে শুধু কষ্ট আর সংক্রমণের ভয়।
সরকারপক্ষ থেকে জানানো হয়েছে তাঁরা কারখানা মালিকপক্ষ ও সংগঠনগুলোর (বিজিএমইএ, বিকেএমইএ) নেতাদের সাথে বৈঠক করে এই প্রতিশ্রুতি আদায় করেছেন যে আগষ্টের ৫ তারিখ পর্যন্ত কাজে যোগদানের সুযোগ থাকবে। এতে কারো চাকুরী চলে যাবে না। কিন্তু শ্রমিকরা জানিয়েছে- তাদেরকে ফোনে বলা হয়েছে একদিনের মধ্যে কাজে যোগদান করতে না পারলে তাদের চাকুরী থাকবে না। সেজন্য চাকুরী হারানোর আতঙ্কে তারা তোড়জোড় করে করোনার ভয় উপেক্ষা করে ঢাকায় ফিরছে।
সরকারী ভাষ্যমতে, কারখানা মালিক ও নেতারা সরকারের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। কারখানা মালিকদের কাছে কাজ বড়। মানুষের জীবন তুচ্ছ। দেশের এই কঠিন বাস্তবতায় করোনার ভয়াবহ সংক্রমণের সংগে শুরু হয়ে আরেক বিপর্যয়। যা ডেঙ্গি নামে পরিচিত। এবছর বর্ষার শুরু থেকে করোনার করাল থাবার সাথে মানুষের জীবন হরণের জন্য রক্তচক্ষু রাঙাচ্ছে ডেঙ্গি। এবছর ডেঙ্গি রোগের প্রাদুর্ভাব বেশী প্রবল। শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা ডেঙ্গির শিকার হচ্ছে বেশী করে। করোনা ও ডেঙ্গি মিলে দেশে যে মহা-বিপর্যয় শুরু হয়েছে তাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। গ্রামের সাথে এখন শহুরে মানুষও আক্রান্ত হয়ে অতি আতঙ্কিত। কারণ, গ্রাম থেকে আসা মুমূর্ষু রোগীদের ভীড়ে শহরের হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই নাই। এর মাঝে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের ঢল নেমেছে ঢাকামুখী পথে। তারা যদি ব্যাপকহারে আক্রান্ত হতে থাকে তাহলে ঢাকা ও আশেপাশের শিল্প এলাকাগুলো শহর হয়ে যাবে মৃত্যুপুরীর ভুতুড়ে ভাগাড়।
কারণ গার্মেন্টস্ কর্মীদের কেউ কি সংক্রমিত নন? কাজে যোগদানের আগে তাদের কি করোনা ও ডেঙ্গু টেষ্ট করার ব্যবস্থা করা হয়েছে? তাদের মধ্যে কি ডায়াবেটিস, কিডনী, হার্ট বা জটিল অসুখধারী মানুষ নেই? মালিকরা কি এসবের কথা ভেবেছেন?
টিভিতে আজ (০১.০৮.২০২১) করোনা সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির একজন সদস্য জানালেন, কিছুদিন আগে ভারতে করোনা সংক্রমণে বেশী মারা গেছে দরিদ্র ও খেটে খাওয়া শ্রমিক শ্রেণির মানুষ। তারা চিকিৎসা সেবা পায়নি। তাদের লাশ দাফনের উপায় ছিল না বলে বালুচরে পুঁতে রাখা হয়েছে অথবা গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে, রাতের আঁধারে ব্রীজের উপর থেকে। আমরা কি সেই ছবি দেখেনি? তবে কেন হঠাৎ করে নিয়ম ভেঙ্গে আগষ্টের ১ তারিখে শ্রমিকদেরকে কাজে যোগ দিতে বলা হলো? এর দায় কে নেবে? টাকাই কি সব? আমেরিকা কি টাকা দিয়ে করোনামৃত্যু ঠেকাতে পেরেছে?
আমরা কঠোর লকডাউনের সুফল আশা করেছিলাম। কিন্তু কিছু অতি লোভী কারখানা মালিকের বিবেকহীন ও অমানবিক কাজের কারণে সবকিছু ভেস্তে গেল। আরেকজন জানিয়েছেন, সরকার জিম্মি হয়েছে কারখানা মালিকদের ফাঁদে অথবা কারখানা মালিকরা লোভ দেখিয়ে সরকারকে জিম্মি করে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। সরকার বার বার সমন্বয়হীন সিদ্ধান্ত নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। সকাল ৮টায় গাড়ি চালু করে ১২টায় বন্ধ করলে একজন ড্রাইভার গাবতলী থেকে সদরঘাটে গিয়ে ফিরে আসবে কিভাবে? পথে ৪ ঘন্টার জ্যাম লাগলে উপায় কী হবে তারা ভেবে দেখেছেন কী? কঠোর লকডাউনে সব চলছে-বাস ছাড়া! এটা কি বাস শ্রমিক ও দরিদ্র যাত্রীদের প্রতি চরম অমানবিক নয়? এত বেসামাল না হয়ে ধৈর্য্য ধরে, শান্ত হয়ে অতিমারী পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন। মহান আল্লাহতায়া’লার উপর তাওয়াক্কুল করে নিজ নিজ কাজে নিবিষ্ট হোন। তাঁর কাছে বরকতের প্রত্যাশা না করে শুধু খাটুনিতে কোন রহমত আসতে পারে না। করোনাকাল সেটা সবাইকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
গার্মেন্টস্ এখন চতুর্থ সারির আয়ের উৎস। বেশ কয়েক বছর থেকে প্রথম আয়ের উৎস হলো বৈদেশিক রেমিটেন্স। যা, বিদেশে কর্মরত শ্রমিকরা কাজ করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজে না খেয়ে কষ্ট করে দেশে পাঠায়। দ্বিতীয় উৎস হলো ওষুধ ও সিমেন্ট। চতুর্থ কৃষির পর পোশাক শিল্প নিচে নেমে গেছে নানা দুর্বলতার কারণে। সুতরাং করোনা ও ডেঙ্গির এই জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে তাদেরকে এতটা গুরুত্ব দিয়ে আমাদের জনশক্তিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়াটা ওদের ধৃষ্টতা আর সরকারের চরম বোকামি।
তাই এখন করণীয় হলো- সবার টিকা নিশ্চিত করা। সবার করোনা ও ডেঙ্গি টেষ্ট করে কাজে ফিরতে দেয়া। সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে। সেটার দিকে নজর দিয়ে দ্রুত টিকা দিয়ে স্কুল-কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়, মাদ্রাসাগুলো খুলে দিতে হবে। তা না হলে আমরা গহীন অন্ধকারে ডুবে যাব এবং কিছু লোভী মানুষেরা মানুষের প্রাণের বিনিময়ে শুধু টাকা আয়ের জন্য উন্মুখ হয়ে আমাদের জাতিসত্ত্বাকে বিনাশ করতে তৎপর হয়ে উঠবে। এমন বাজে সময়ে পরিস্থিতিকে হঠাৎ আরো অনিয়ন্ত্রিত করে তুলবেন না। লোভী মানুষগুলো সামান্য ধৈর্য্য ধরে একটু মানবিক হলে সকল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব নয়।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd
সাম্প্রতিক মন্তব্য