logo
news image

আবদ্ধ সময়ের আর্তনাদেও অম্লান ঈদ

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম:
প্রায় দু’বছর ধরে সময়টা যে কোনদিকে শেষ হয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে অনেকের অভিযোগ রয়েছে। কেউ বলেন করোনাকালীন সময়টা বেশ ভাল, আরামে ঘুমুতে পারছি, ঘুম না এলে এন্তারজালে ঢুঁউ মেরে জগতের নানা খবর নিচ্ছি। কেউ বলছেন এই সময়টা বড্ড খারাপ, সব সময় আবদ্ধ পরিবেশে থেকে বিগড়ে উঠছে মন। কোন কাজ ভাল লাগে না। চারদিকে দু:সংবাদ। রোগ-শোক, অভাব, মৃত্যু, হতাশা আর ভাল্লাগে না। গোটা বিশ্বের মানুষগুলো এখন সারাবেলা শুধু আর্তনাদের সুরে কথা বলছে। পৃথিবী নামক শখের ছাদবাগানে এখন শুধু দু:খের লার্ভা কিলবিল করছে! এই দু:খের সুনামী থামবে কবে? আক্রান্ত বিশ্বের এই ভয়ানক ব্যারাম কি ভাল হবে না?
খারাপ বা ভাল যে সময়ই হোক না কেন সে গড়িয়ে চলতেই থাকবে। ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণ শুরু হবার প্রথমদিকে বাইরে থেকে ঘরে ফিরে পোশাক পরিবর্তন, হাত ধোয়া বা গোসল করাকে একটা বোঝা মনে করতো অনেকে। চীনে যখন সাড়ে তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হলো তখন সংবাদটা শুনে মনে হতো, চীন সে তো অনেক দূরের দেশ। আমাদের ওসব কথা না ভাবলেও চলবে। এরপর ইউরোপে লক্ষ মানুষের প্রাণহনির খবরগুলোকেও অনেকে পাত্তা দেননি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত দেশে করোনামৃতের সংখ্যায় প্রথম স্থান অধিকার করলে অনেকে বলেছেন ওদের সময় এখন কিছু হারাবার। সারা বিশে^ তারা এরচেয়ে বেশী প্রাণনাশ করেছে আধুনিক অস্ত্রবিক্রি ও যুদ্ধবাজি করে।
এরপর আমরা করোনা মোকাবেলায় সফলতা দেখিয়েছি বলে আত্মতুষ্টিতে ডিগবাজি খেয়ে যখন আত্মহারা ঠিক তখনই শুরু হয়েছে ব্রাজিলে মারাত্মক সংক্রমণ ও উচ্চমৃত্যুহার। ২০২১ সালের মার্চ মাসে ভারতে ডেল্টা ভেরিয়েন্টের ভয়াবহ আক্রমণ শুরু হলে শহর পেরিয়ে ওদের গ্রাম-গঞ্জে মরণ কামড় বসাতে থাকে করোনা। চারদিকে ছড়াতে থাকে মৃত্যুর করাল থাবা, আক্রান্ত মানুষের কান্নার চিৎকার, প্রাণ বাঁচানোর আঁকুতি ও আর্তনাদ শোনা যেতে থাকলে আমাদের দেশে সবার টনক নড়ে। ভারতের সাথে স্থলসীমান্ত বন্ধ করে দিলেও শেষ রক্ষা হয়নি। নদী ও সমুদ্রপথে রাতের আঁধারে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট সংগে নিয়ে সীমান্ত পথ পাড়ি দিয়ে ফেলে অসচেতন মানুষ। বিশেষ করে ডেল্টা সংক্রমিত চোরাচালানী, নাবিক, নৌকার মাঝি, অবৈধ গরু ব্যবসায়ী ও চোরাচালান হয়ে আসা কাপড়, মশলা ও মনোহরী দ্রব্যের ফেরীওয়ালারা সবার চোখের সামনে গ্রাম-গঞ্জে ঘুরে মূলত করোনার ভাইরাস ফেরী করে সীমান্তের জেলাগুলোতে ছড়িয়ে দেয়। এরপর সেটা সারা বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করে। ধারণা ছিল গ্রামে করোনা নেই, ওতে আমাদের কিচ্ছু হবে না। কিন্তু সময় আমাদের কাউকে ক্ষমা করেনি। সময়ের আবর্তে আমরা সংক্রমণের বেড়াজালে আটকা পড়ে এখন মৃত্যুর স্রোতে হাবুডুবু খাচ্ছি।
সামান্য কয়েকদিন ঘরবন্দী থেকে হাঁপিয়ে উঠে স্কুলে যেতে না পেরে ২০২০ সালে এক শিশু খেলনা বন্দুক তাক করে তার মাকে বলেছিল, ‘করোনাকে গুলি করে মারা যায় না?’ সে জানতো না যে করোনাকে খালি চোখে দেখা যায় না। এই জীবাণু নিজেই এক মারাত্মক অস্ত্র। করোনাকে গুলি করে মেরে ফেলার মত বন্দুক নেই। করোনার টিকা তখনও বের হয়নি।
২০২১ সালে আমাদের দেশে ডেল্টার সংক্রমণ রোধে মানুষের ঘরের বাইরে বের হওয়া ঠেকাতে আধুনিক অস্ত্র হাতে পুলিশ, আনসার, বিজিবির সাথে সেনাবাহিনী রাস্তায় নেমে পড়লে আবার শিশুর মুখে প্রশ্ন শোনা যায়- মা ওসব আসল বন্দুক দিয়ে কাকে গুলি করা হবে? করোনাকে না মানুষকে? শিশুটি এবার কঠোর লকডাউনের মধ্যে ঘরে বসে শুধু ইন্টারনেই নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। আর ভাবছে যদিও ওরা সংখ্যায় অনেক কিন্তু করোনাকে চোখে দেখা যায় না। তাই ওই আসল বন্দুক দিয়েও ডেল্টা ভেরিয়েন্টকে গুলি করা যাবে না।
এখন চলছে করোনায় কর্মহারানো স্বল্প আয়ের মানুষের জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর আর্তনাদ। সেসব দরিদ্র মানুষের আর্তনাদ শোনার মত মানুষ কম। ব্যবসায়ীরা নিজেদের কারখানা টিকে রেখে বিত্ত বাঁচানোর জন্য তৎপর। এই কঠিন সময়ে তাঁরা নিজ নিজ ব্যবসা হারানোর ভয়ে আর্তনাদ করছেন। সেজন্য সরকার বেশ সচেতন। কারণ, এসব ব্যবসা টিকে থাকতে না পারলে সরকারের অর্থনীতি বাঁচানোর আর্তনাদ আরো গভীর হবে।
এভাবে অর্থনীতি বাঁচানোর সুযোগ দিতে গিয়ে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া শিশু শ্রমিকদের মা-বাবা ও স্বজনদের আহাজারি ও আর্তনাদের মেয়াদ কতদিন টিকে থাকবে তা বলাই বাহুল্য। করোনায় বিপর্যস্ত নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর হাসপাতালে সেবা নেয়ার সুযোগ খুব কম। গ্রাম পর্যায়ে প্রাণবায়ু সম্বলিত করোনার চিকিৎসা সেবা নেই। গ্রাম-গঞ্জে করোনাক্রান্ত হয়ে অক্সিজেনের অভাবে নিরুপায় হয়ে যখন কেউ শহরের হাসপাতালে আসার সুযোগ পাচ্ছে তখন অনেকের সময় শেষ- অর্থাৎ শহরের হাসপাতালের পরিবেশ বুঝে উঠার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে বেশীরভাগ রোগী। সেসময় তারে অবুঝ পোষ্য বাচ্চা বা স্বজনদের আহাজারি ও আর্তনাদের দৃশ্য যারা টিভিতে দেখেছেন তারা কি বলবেন?
করোনার বয়াবহ সময় শিশু শ্রমিক-কর্মচারী চালিত কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অমূলক দোহাই দিয়ে খোলা হয়নি। অন্যদিকে দায়সারা অনলাইন ক্লাশ সম্পন্ন করলেও পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি তাদের। ফলে সনদও পায়নি তারা। ইতোমধ্যে চাকুরীর বয়সসীমা পেরিয়ে গেছে অনেক সম্ভাবনাময় তরুণদের। এদের কষ্ট ও আর্তনাদের শব্দ ভিতরে ভিতরে গুমরে কেঁদে-কেটে নিস্তব্ধ রুপ ধারণ করলেও কেউ তা শোনার প্রয়োজন মনে করছে না। কে বাঁচাবে তাদের ভবিষ্যৎ ও তাদের উপর নির্ভরশীলদেরকে?
শত শত করুণ আর্তনাদের মধ্যে এখন চিন্তা শুধু ‘কেমনে মারবো করোনা ও কেমনে মরবে করোনা’ নিয়ে দিন গুজরান চলছে। মেঘে মেঘে বেলা বেড়ে সূর্য পশ্চিমে হেলতে শুরু করছে। এত সংকটের মধ্যে সবাই জীবন বাঁচানোর জন্য একটি টিকার জন্য এখন মরিয়া। কারণ, সবাই জেনে গেছে করোনাকে গুলি করে মারতে হলে একটি কার্যকরী ‘টিকা-বন্দুক’-এর সফল প্রয়োগ ছাড়া গত্যন্তর নেই। তাই টিকার চাহিদা প্রবল হতে থাকবে সামনের দিনগুলোতে।
এই চরম আবদ্ধ সময়ে একটু আনন্দের ছোঁয়া পেতে মানুষ ঈদের ছুটিতে ছুটে গেছে শেকড়ের কাছে নিজ ভিটেমাটির সোঁদা গন্ধ পেতে, ফেলে আসা বাবা-মা ও স্বজনদের কাছে মন খুলে নিজের সুখ-দু:খের কথা ব্যক্ত করে একটু শান্তি পেতে। তাইতো বৃষ্টি, বন্যা, করোনা ও যানবাহনের অভাব উপেক্ষা করে মানুষ হয়েছিল ঘরমুখী। কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে সামান্য শিথীলতা  পেয়ে নিজেদের খোদাভীরুতাকে প্রমাণ করে ম্লান হয়ে যাওয়া কোরবানীর ঈদকে তারা কিছুটা অম্লান করে আবার ফিরে আসবে নিজ নিজ ডেরায়। তবে তাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য সবাইকে খুব দ্রুত টিকা দিতে না পারলে অচিরেই মহা-আর্তনাদ শুরু হয়ে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে যেতে পারে। সবার জন্য দ্রুত টিকা প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি হলে এই ভয়ংকর আবদ্ধ পরিবেশে ম্লান হয়ে যাওয়া মুখগুলোতে অম্লান হাসি ফুটতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top