logo
news image

অযথা ঘুরোনা হবে করোনা-জরিমানা

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম :
গত দু’সপ্তাহ ধরে সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া বাড়ির বাইরে অযথা বের হলে বিভিন্ন ধরনের জরিমানা করার নিয়ম চলছে। জরিমানা করা হচ্ছে রাস্তায়। জরিমানা আদায় করা হচ্ছে বাড়িতে। কঠোর লকডাউন অমান্য করে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে অযথা বাইরে বের হয়ে কারণ ভালভাবে বুঝাতে না পারলে আইন-শৃংখলা বাহিনীর লোকজন নানা অঙ্কের জরিমানার স্লিপ ধরিয়ে দিচ্ছেন। নগদ অর্থের জরিমানাও নিচ্ছেন। ব্যক্তিগত গাড়িতে অনিয়ম দেখলে মামলা দেয়া হচ্ছে। তবে মোটরবাইক ওয়ালাদের প্রতি অভিযোগ বেশী।
বাসা-বাড়ি, নির্মাণাধীন ভবন, মার্কেট ইত্যাদিতেও অভিযান চলছে। তবে সেটা ডেঙ্গু রোধকল্পে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য। ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোসা, মাটির চাড়ি, ভাঙ্গা এলুমিনিয়াম বা প্লাষ্টিকের তৈরী তৈজষপত্রে (যেগুলোতে বৃষ্টি অথবা ময়লা পানি জমে থাকে) সামান্য পানি পেলেই এডিস মশা ডিম পাড়ে। বংশ বিস্তার করে এবং মানুষকে কামড়িয়ে ডেঙ্গু রোগ ছড়ায়। বর্ষাকালে এডিসের বংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং করোনাকালে ডেঙ্গুর বিস্তারও বৃদ্ধি পেয়ে ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। তাই একইসংগে এই দুই রোগের প্রাদুর্ভাবে জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি হয়ে পড়েছে। এসব প্রাণসংহারী রোগ রোধকল্পে জরিমানা করে মানুষকে সতর্ক করার কাজে নেমে পড়েছে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীগণ।
কিন্তু জনগণ মোটেও সজাগ নন। তারা দুটো মারাত্মক রোগের একটিকেও ভয়-ডর করতে নারাজ। রাস্তায় মানুষ, গাড়ি, রিক্সা, ভ্যান, ট্রাক সবকিছুই গিজ্ গিজ্ করছে। এতদিন পরেও মাস্ক পরতে ভুলে যাচ্ছে। সেজন্য অজুহাতের ধরন শুনে হাসি বা কান্না কোনটাই চেপে রাখার উপায় নেই।
বিশেষ করে ব্যক্তিগত গাড়ির দাপটে কঠোর লকডাউন অকর্যকর হয়ে পড়েছে। সবাই স্টিকার ছাপিয়ে গাড়ির সামনে-পিছনে লাগিয়ে চলাচল করছে। এসময় গণমাধ্যম বা সংবাদকর্মীর পরিচয়পত্র বেশী নিরাপদ। কারো কোন গণমাধ্যমে পরিচিত কেউ থাকলে তার ফোন নম্বর দিয়ে পুলিশকে বলা হচ্ছে- ফোন করে যাচাই করে দেখুন। একশ’ দ’ুশ নয়। রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি। নতুন মডেলের হাল-ফ্যাশনের ঝক্ঝকে গাড়ি, মাইক্রোবাস, মোটরবাইক সারি সারি গড় গড় করে সামনে আসছে। উত্তর আগেই প্রস্তুত করা রয়েছে। গলায় কার্ড ঝুলানো, গাড়ির কাঁচে ষ্টিকার লাগানো দেখে যাত্রীরা সত্য না মিথ্যা কথা বলছেন তা বুঝতে ভিমরি খাবার যোগাড় রাস্তায় চেকপোষ্টে দাঁড়ানো কর্মীগণের। ওদেরকে জেরা করে জরিমানা করতে করতে পেছনে জ্যাম লেগে যাচ্ছে মাইলব্যাপী। সুতরাং কঠোর লকডাউন অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
কঠোর লকডাউনেও রাস্তায় এত ব্যক্তিগত গাড়ি। বিধিনিষেধের সময়ে এত গাড়ির মধ্যে আসলে কারা চলাচল করছে? ওদিকে মোড়ের মধ্যে কোদাল-টুকরি নিয়ে এত মানুষের জটলা কেন? কঠোর লকডাউন চলছে তা হয়তো জানে না ওই মানুষগুলো।
কোরবানী ঈদ উপলক্ষে হাটে-বাজারে জাল টাকা ছাড়া হয়েছে কোটি কোটি। জাল টাকার কারিগর জালিয়াতরা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। টিভিতে তাদের টাকা তৈরী করার মেশিন, কৌশল, চকচকে কোটি টাকার বান্ডিল দেখানো হচ্ছে। একটি দু’টি জালিয়াত চক্র বন্দী। কিন্তু এই জনবহুল পায়রার খুঁপড়ির মত হাজার দালানের বস্তিগুলোর কোন ঘুপচির আর কোথায় কোথায় জালিয়তদের সহযোদ্ধারা সক্রিয় থেকে জাল টাকা ছাপাচ্ছে তা তো এত সহজে অনুমেয় নয়। আর সেখানেই ভয়টা।
কারণ, আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে কালো টাকা সাদা করার অনুমতি দিয়ে দুর্নীতিবাজ, জালিয়াতচক্রকে আরো বেশী আস্কারা দিয়ে ফেলেছি। কালো টাকা সাদা করা অন্যায়, এটা পাপ কাজের শামিল। বিত্তশালী শিক্ষিত মানুষগুলো যদি কালো টাকা সাদা করে নিতে পারে তাহলে যাদের সে সুযোগ নেই, চাকুরীও নেই তারা তো গোপনে নকল টাকা বানাতে তৎপর হবে! এ দু’য়ের মধ্যে অনৈতিকতার কোন পার্থক্য নেই। পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে টাকা আয়ের তাগিদ দেয়া আছে কিন্তু সেটার রং সাদা না কালো হবে তা তো বলা নেই। মানুষের মনকে সাদা করার শিক্ষা না দিয়ে কালো টাকাকে সাদা করার শিক্ষা দিলে কিছু মানুষ যে কোন উপায়ে টাকা অর্জনে তৎপর হয়ে পড়বে। আমাদের সমাজে এর দুটোই কার্যকরী হয়ে গেছে।
মানুষ সাদা হলে মন সাদা হবে এমন নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু মানুষের মনকে উদার, ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত, পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত করতে হলে সেরকম পারিপাশি^ক শিক্ষা তো থাকতে হবে সমাজের প্রতিটি জানালায়, প্রতিটি পর্দায়। আমাদের এই নৈতিকতাবোধ হারিয়ে যেতে যেতে এখন ঘরে ঘরে টাকশাল তৈরী করে ফেলেছি। রাস্তায় জরিমানা করছি তারে গাড়িগুলোকে। সেখানেও জরিমানা আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছি। কারণ, আমাদের রাস্তায় এখনও আটো সিগন্যাল বাতির পরিবর্তে হাতের ইশারায় গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করাকে ভালবেসে উৎসাহিত করার মানুষ বেশী।
অথচ, জাপানে একজন ড্রাইভারকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি ফাঁকা রাস্তা পেলে লাল সিগন্যালের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে যাবেন। সেদেশে রাস্তায় যদি একটিমাত্র গাড়ি থাকে এবং লাল বাতি জ¦লে উঠে তাহলে সে একাই নির্বিকারভাবে সেটা সবুজ না হওয়া পর্যন্ত একাই দাঁড়িয়ে থাকবে। মানব ট্রফিকের কোন প্রয়োজন নেই সেখানে। কারণ, চলাচলকারী মানুষগুলো সবাই নিজ নিজ জ্ঞানে একেকজন ট্রাফিক। তারা মিথ্যে বা ফাঁকি দিতে শিখেনি, জালিয়াতি করতেও জানে না। যদিও ওদের কিছু মন্ত্রী ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটিয়েছিল।
তবে হ্যা, সর্বক্ষেত্রে আধুনিক সিস্টেম তাদেরকে আরো বেশী সতর্ক হবার শিক্ষা দিয়েছে। কেউ জরুরী কাজে দু’একবার আইন অমান্য করে ক্ষমা পেলেও যদি বার বার আইন ভঙ্গ করতে থাকে তাহলে তার শাস্তি হবেই। কোন ড্রাইভার যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বার বার লাল বাতি ডিঙ্গিয়ে চলতে থাকে তাহলে মাস শেষে তার বেতনের পরিমাণ কমে যাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। ট্রফিক অফিস কম্পিউটারের তথ্য পর্যবেক্ষণ ও যাচাই করে তার নির্দিষ্ট জরিমানার অঙ্ক কেটে নিয়ে তার বসের অফিসে সুপারিশ করলে তার আয় কমে যাবে। এভাবে সেখানে রাস্তার বেপরোয়া গাড়িকে জরিমানা করা হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে চোরাই গাড়ি, ভুয়া সনদী গাড়ি, সনদ বিহীন গাড়িকে এই পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। সেজন্য কম্পিউটারের তথ্য পর্যবেক্ষণ ও যাচাইকারীর জন্য ডিজিটাল ঘুষের দৌরাত্ম্য থেকে মুক্ত থাকা বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ, সাদা মানুষ তৈরীর কাজটি সর্বাগ্রে করতে হবে।
মানুষগুলো নৈতিকভাবে পরিচ্ছন্ন হলে আইন অমান্য করে অযথা কৌতহুলবশত: রাস্তায় বের হয়ে করোনা সংক্রমণ বাড়াবে না। এজন্য কাউকে জরিমানার অর্থ দিতে হবে না, কাউকে জরিমানা আদায় করতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হবে না। জরিমানার মত আর্থিক শাস্তিকে জালিয়াতরা মোটেই গ্রাহ্য করে না। কারণ, তাদের কাছে অর্থ বানানোর যন্ত্র ও কৌশল দুটোই কুক্ষিগত হয়ে গেছে। তারা ‘অযথা বাইরে ঘুরোনা হবে করোনা হবে জরিমানা’এসব নীতিকথায় কর্ণপাত করে না।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top