logo
news image

দেশের ফুটবলের জন্য আবেগী উন্মাদনা কি অধরাই থাকবে?

মোঃ কামরুল ইসলাম :
উন্মাদনা। ফুটবল উন্মাদনা। সারাবিশ্বের সব দেশের ন্যায় আমরাও জাতি হিসেবে ফুটবল প্রিয় এক দেশ। শিশু কিশোর থেকে যুবক বৃদ্ধ সবাই ফুটবল পছন্দ করে। বিশ্বকাপ, ইউরো কিংবা কোপা আমেরিকা সব কিছুতেই যেন উন্মাদনা কমতি নেই। রাত জেগে খেলা দেখা ফুটবল প্রিয় দর্শকদের জন্য অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে ইউরোপ আমেরিকার খেলা মানেই আমাদের রাতের ঘুম শেষ।
এই উন্মাদনার পিছনে কি কোনো কারন আছে? একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যেসব দেশের বিশ্বকাপ, ইউরো, কোপা আমেরিকা কিংবা এশিয়া কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার কোনো সম্ভাবনা নেই সেসব দেশের সমর্থকদের মধ্যেই উন্মাদনা অনেক বেশী। আমরা কি রাত জেগে নিজের দেশের খেলা দেখি? কিংবা এশিয়া কাপের বাছাই পর্বের খেলা দেখার জন্য কি সময় বের করি টেলিভিশনের সামনে? এমনকি সাফ চ্যাম্পিয়ন এর খেলাও আমাদের দেখা হয়ে উঠে না? আমরা আমাদের জাতীয় ফুটবল দলের খেলা দেখার জন্যই আগ্রহই তৈরী করতে পারিনি। এ ব্যর্থতা আসলে কাদের ফুটবল প্রিয় দর্শকদের নাকি ফুটবলের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের?
আজ বিশ্ব ফুটবলের আমাদের অবস্থান কোথায়? ফিফা র‌্যাংকিং-এ ২১০ টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১৮৪ (২৭ মে ২০২১)। ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে ফুটবল যেখানে জনপ্রিয়তার দিক থেকে শীর্ষে সেখানে বিশ্ব ফুটবলে আমাদের অবস্থান সত্যিই হতাশার জন্ম দেয়। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ১৯৭৬ সালে ফিফায়, ১৯৭৪ সালে এএফসি আর ১৯৯৭ সালে সাফে অন্তর্ভূক্ত হয়। স্বাধীনতার পর আমাদের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি ২০০৩ সালে একবার সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন। তাতেই আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি। ফিফা র‌্যাংকিং-এ আমরা ১৯৯৬ সালে ১১০তম স্থানে পৌঁছাতে পেরেছিলাম। এর পর থেকে অধঃনমন শুরু হয়েছে।  একপরযায়ে ২০১৮ সালে ১৯৭ তম স্থানেও পৌঁছে গিয়েছিলাম। যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জাজনক অবস্থান, তারপর নীতি নির্ধারকরা গর্ব করেন, ফুটবল ফেডারেশনের পদপদবীর জন্য রাজনীতি করেন। দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের আবেগের কোনো স্থান নেই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের ক্রীড়া উন্নয়নের জন্য সব রকমের সহযোগিতা দিয়ে আসছেন। কিন্তু ফেডারেশনের কর্তাব্যক্তিরা কি তাঁর আবেগের কোনো মুল্যায়ন করছেন? ক্রীড়া পাগল প্রধানমন্ত্রী সুযোগ পেলেই মাঠে যান হোক সেটা ক্রিকেট কিংবা ফুটবল। স্বাধীনতার পর এদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় ফুটবলার যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে তিনি কাজী মো সালাহউদ্দিন । যার হাত ধরে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন এগিয়ে যাচ্ছে। আসেলেই কি এগিয়ে যাচ্ছে? তিনি ২০০৩ সালের ফেডারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৮ সাল থেকে পরপর চারবার ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হোন। একজন সংগঠক হিসেবে গর্ব করার ব্যাপার। আজ অবধি এটা একটা রেকর্ড। কিন্তু আমরাও তো ফুটবলের অধঃপতনের রেকর্ড দেখতে পাচ্ছি, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এর দায়দায়িত্ব তো বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের উপরই বর্তায়।
বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়েছিলো ১৯৭৩ সালে থাইল্যান্ডের সাথে, যার রেজাল্ট ছিলো ২-২। ১৯৮৫ সালে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশ সবেচেয়ে বড় জয় দেখতে পেয়েছিলো মালদ্বীপের সাথে, যা ছিলো ৮-০। সেই মালদ্বীপের বর্তমান ফিফা র‌্যাংকিং ১৫৮। যা আমাদের থেকে ২৬ ধাপ এগিয়ে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ফিফার বর্তমান র‌্যাংকিং ১০৫ অথচ ৯৬-৯৭ সালে আমাদের কাছাকাছি ছিলো। এই অধঃপতনের জন্য কে দায়ী। আবাহনী-মোহমেডানের ম্যাচ দেখার জন্য ভোর থেকেই স্টেডিয়ামে ভীর জমে যেত, উন্মাদনা আর উত্তেজনা ঠাশা ছিলো সেই সব ম্যাচগুলোতে। ঢাকা লীগে খেলার জন্য বিশ্বের অনেক তারকা ফুটবলারদের ভীর লক্ষনীয় ছিলো। সেই দিনগুলো ছিলো বাংলাদেশের স্বর্ণ যুগ। আজ আমরা প্রতিবেশী ফুটবলের দূর্বল শক্তি ভূটানের কাছেও হেরে যাই, নেপালের কাছে হারি হরহামাশাই যাতে আমরা দর্শক হিসেবে ব্যথিত হই। সার্ক দেশগুলোর মধ্যে পঞ্চম স্থানে অবস্থান করছি। এভাবে অগ্রসর হতে থাকলে ২০০ স্থান পেরিয়ে যেতে সময় লাগবে না। ব্যর্থতার লাগাম টেনে ধরুন নতুবা বাংলাদেশের ফুটবল যে একটা খেলা তা ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে।
আজ অন্যের খেলা দেখে উৎসাহিত হই, চায়ের টেবিলে ঝড় তুলি, সেটাই আনন্দ, সেটাই ভালোবাসা। আজ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইতালি, স্পেন কিংবা ইংল্যান্ডের অনেক খেলোয়াড়ের নাম জানি। তাদের রেকর্ড নিয়ে উত্তেজিত হই। শুধু দেশ হিসেবে কেনো স্পেনিশ, ইংলিশ, ফ্রান্স কিংবা জার্মান লীগ নিয়েও আমাদের ফুটবল প্রিয় দর্শকদের দারুন আগ্রহ। এখনকার জাতীয়দলে জামাল ভূইয়া ছাড়া কি এমন কোনো খেলোয়াড় আছে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেরা আদর্শ হিসেবে নিতে পারবে? সেই স্বর্ণ যুগের কাজী সালাউদ্দিন, আসলাম, বাদল রায়, সাব্বির, কায়সার হামিদ, সালাম মুর্শেদী, মুন্নাসহ অনেক আইকন খেলোয়াড়ের নাম মুখস্ত বলে দিতে পারে সবাই। একজন কাজী সালাউদ্দিন কিংবা সালাম মুর্শেদীর মতো একজন খেলোয়াড় ও যদি তৈরী হতো গত এক দশকে তাতেও তৃপ্তি পেতাম একজন দর্শক হিসেবে।
একসময় স্বপ্ন দেখতাম বাংলাদেশ বিশ্ব ফুটবলে রাজত্ব করবে। কারন স্বপ্ন দেখতে সহায়তা করেছিলো ঐতিহাসিক ডানা কাপ, গোথিয়া কাপ বিজয়। সব স্বপ্নেই গুড়েবালি। এখন আর স্বপ্ন দেখি নাই। কেউ নেই যে স্বপ্ন দেখাবে। সবাই পদপদবী নিয়ে ব্যস্ত ফেডারেশনে, দর্শকদের আবেগ থাকলেই কি আর না থাকলেই কি? ব্রাজিল পাঁচবার, জার্মানি চারবার কিংবা আর্জেন্টিনা দুই বার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো তাই নিয়ে আমরা কথায় আর সোস্যাল মিডিয়া যুদ্ধ চলিয়ে চাই সেখানেই আমাদের স্বাধীনতা। নিজের দেশের পতাকা ছাড়া সারাদেশের আকাশে অন্য দেশের পতাকা শোভিত হবে এটাই তো ফুটবলের প্রতি আবেগ। ফেডারেশনের সৌন্দরয বৃদ্ধি কিংবা প্রতিবছর ফুটবলের জন্য বাজেট বৃদ্ধি না করে, আবেগী জাতি হিসেবে নিজের দেশের ফুটবল নিয়ে গর্ব করার পরিবেশ তৈরী করুন।
ছেলেদের ফুটবলে অধঃনমনের সাথে মেয়েদের ফুটবলেও অধঃনমন অব্যাহত আছে। ২০০৯ সালে যেখানে ছিলো ৯১ তম স্থানে সেখানে ২০২০ সালে এসে তা দাড়িয়েছে ১৪২ তম স্থানে। সত্যিই দুঃখজনক।
স্কুল, কলেজ ফাকি দিয়ে দীর্ঘসময় লাইনে দাড়িয়ে নিজের ক্লাবের প্রতি, দেশের প্রতি সমর্থন দেয়ার জন্য স্টেডিয়ামে হাজির হওয়া, আবেগ উচ্ছাসের কাছে সবকিছু পরাজিত হওয়া কি বর্তমান বাংলাদেশ ফুটবলের এই চিত্র দেখার জন্য? আমরা ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা কিংবা জার্মানীকে সমর্থন দিবো কিন্তু নিজের দেশের চেয়ে বেশী না। সেই দিনগুলো ফিরিয়ে দিন, আমরা স্টেডিয়ামে যেতে চাই, ফুটবল খেলা দেখতে চাই। সব আবেগ, উচ্ছাস আর উত্তেজনা যেন থাকে নিজের দেশের জন্য। সেই দিনের অপেক্ষায় থাকলাম আমরা ফুটবল প্রিয় পুরো জাতি।
               
* মোঃ কামরুল ইসলাম: মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। 

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top