logo
news image

বর্ষাকালে বিষধর সাপ থেকে সতর্কতা

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম:
এবারের বর্ষাকালে ভারী বর্ষণের পরিমাণ বেশী। প্রায় প্রতিদিন মুষলধারে বৃষ্টিতে মাটির স্বাভাবিক পানিচার্জ নেবার ক্ষমতা উছলে গেছে। কোলা ব্যাঙ ছাড়াও বিশেষ প্রজাতির ব্যাঙের ডাকে সারারাত কলরব শোনা যাচ্ছে। জুলাই ১ থেকে সাত দিনের কঠোর লকডাউনের মাঝে ২১ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এরপর ১৪ জুলাই পর্যন্ত আরো সাত দিনের ঘরবন্দীত্ব বাড়ানো হলো। তাই ঘরে বসে মানুষ সময় পার করছে। বর্ষায় দিনের বেলায় টুপটাপ বৃষ্টির শব্দের সাথে ঝিমুনি নিয়ে বই পড়ার দিন তো শেষ। এখন অনলাইনে সারা দিনরাত জুমে এত এত মিটিং। কথা বলা শুরু হলে সময়ের কোন আগামাথা কেউ খেয়াল করে না। তাই দিবানিদ্রার সময়েও হাঁটুতে নেটবুক অন রেখে কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। চারদিক থেকে বিভিন্ন মেসেজ আসে। সবার মন জোগাতে উত্তর দিতে হয়। কারণ, সে দেখতে পায় আমি অনলাইনে আছি, মানে জেগে আছি। উত্তর পেতে দেরী হলেই ফোন বেজে উঠে।
সেদিন দুপুরবেলা গ্রামের বাড়ি থেকে কলেজ পড়ুয়া ভাতিজা মেসেঞ্জারে দুটি ছবি পাঠিয়েছে। সে দুটো সাপ মেরেছে। বাড়ির পাশের গাছে আম পাড়তে গিয়ে একটি দ্রুতগামী সাপ সাঁ সাঁ করে পালিয়ে গেলে সে বিষয়টা তার মাকে জানায়। সেদিন সে পর্যন্তই ঘটনার শেষ। এর দু’দিন পর এক দুপুরে পুকুর পাড়ে টং ঘরের নিকট আতা গাছের ডাল নড়তে দেখে সে। তাকাতেই একটি দাঁড়াশ সাপকে সেখানে পাখি ধরার জন্য ঝুলতে দেখে অন্যদেরকে জানায় ও মেবাইল ফোনে পড়শী সাহসী জহুরুলকে কোঁচা নিয়ে দ্রুত আসতে বলে। সাপটি গাছ থেকে দ্রুত লাফিয়ে পালানোর সময় কোঁচার ফলায় বিদ্ধ হয়। আরেকটি কম বিষাক্ত রঙীন ভেন্ডি সাপকে খড়িঘরের ভেতর মেরেছে সে। এই বীরত্বের কথা শহুরে চাচাকে না জানালে কেমন হয়? তাই সাপের ছবিসহ মেসেজ পাঠিয়েছে আমার প্রিয় ভাতিজা!
করোনার জন্য শহরের কলেজের হোষ্টেল বন্ধ। দীর্ঘদিন বাড়িতে অবস্থান করছে সে। গ্রামের বাড়িতে কি আর এত পড়াশুনা করতে ভাল লাগে? চারদিকে সময় কাটানোর জন্য কত কাজ। বর্ষার সময় মাছ ধরা, আম পাড়া, জাম গাছে চড়ে মগডালে বসে রঙীন জাম দিয়ে মুখ রাঙানোর, মাঠে জমে থাকা পানি-কাদার মধ্যে ফুটবল, হা-ডু-ডু কত কিছু করার অবকাশ তো আছে। কিন্তু এখনকার গ্রামের ছেলেদের কি আর সেসব করার ফুরসৎ আছে? এ যুগে তাদের হাতেও নানা ধরনের ডিভাইস। গ্রামে যারা শিক্ষার্থী তাদেরকে নিয়মিত অনলাইনে ক্লাশ করতে হচ্ছে, পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। আবার সংসারের কৃষিকাজে সাহায্য করতে হচ্ছে।
ভাতিজার পাঠানো সাপের ছবি দেখতে দেখতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় একটি গ্রুপের মেসেজে ভেসে উঠলো একটি করুণ সংবাদ। আমাদের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থীর মা ওইদিন সকালবেলা বিষধর সাপের ছোবলে মৃত্যুবরণ করেছেন। শিক্ষার্থীর বন্ধুদের কাছে জানা গেল ওর বাড়ি রহনপুরের একটি গ্রামে। বাড়ির সন্নিকটে বিষাক্ত সাপের ছোবলে আহত হলে ওনাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে নেয়ার পথে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। করোনাকলে এই হৃদয় বিদারক ঘটনা সবাইকে খুব মর্মাহত করেছে। আমি সবাইকে ওনার বিদেহী আত্মার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করার অনুরোধ করেছি।
ভয়ানক ডেল্টা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় এমনিতে চৌদ্দ দিনের কঠোর লকডাউন চলছে। রাস্তায় জরুরী কারণ ছাড়া বের হতে গেলে বাধা দিচ্ছে সেনাবহিনী, বিজিবি, আনসার ও পুলিশ সবাই। এই সময় ওই শিক্ষার্থীর বিপদে ওর পরিবারের সবাইকে মহান আল্ল্হ্ রাব্বুল আলামীন ধৈর্য্য ধরার শক্তি দান করুন।
এখন বর্ষাকাল, তাই অনেক জেলায় বন্যায় বাড়ির আনাচকানাচে কিংবা বাড়ির উঠানেও পানি এসেছে। ফলে নানা রকম বিষধর সাপের আনাগোনা  বেড়ে গেছে। ফলে সাপে কাটা রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিষধর গোখরা সাপের প্রাদুর্ভাব ঘটছে। বসতবাড়ির খড়ের গাদা, খড়িঘর, গোয়াল ঘর ইত্যাদিতে ডিম পেড়ে বাচ্চা ফুটানোর জন্য বিষধর সাপ বর্ষাকালে আস্তানা খুঁজে নেয়। সাপেরা যখন তখন মানুষের সামনে এসে পড়ে এবং নিজের অবস্থা বেগতিক দেখলে ছোবল দিয়ে ফেলে।
বর্ষাকালে আমাদের গ্রামগুলোতে সাপের কামড় একটি মারাত্মক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। প্রতিবছর সাপের কামড়ে অনেক মানুষ মারা যায়। অজ্ঞতা ও হাতের কাছে চিকিৎসা না থাকায় মৃত্যুর হার বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদন বলছে, “বাংলাদেশে প্রতিবছর সাত লাখের মতো মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন। তাদের মধ্যে মারা যান ৬ হাজার।”
বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে প্রতি বছর গ্রামে-গঞ্জে আরো অগণিত মানুষ সাপের দংশনের শিকার হন, যার সঠিক খবর গণমাধ্যমে আসে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত সর্বশেষ রিপোর্টে এ তথ্য দেখা গেছে। দেখা গেছে, প্রতি বছর বন্যার সময় অর্থাৎ মে, জুন এবং জুলাই--এই তিন মাস সাপের দংশন এবং তার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে (বিবিসি বাংলা ২৭.৭.২০২০)।
বাংলাদেশে ৮০টি প্রজাতির সাপ রয়েছে। তার মধ্যে ২৩ ধরনের সাপ সামুদ্রিক। সামুদ্রিক সাপও অত্যন্ত বিষাক্ত হয়। সাপ ও সাপের বিষ নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির প্রধান অধ্যাপক এমএ ফায়েজ বলেছেন, দেশে যেসব সাপ রয়েছে, তার মধ্যে সাত থেকে আট প্রজাতির অত্যন্ত বিষধর সাপের কামড়ে মানুষ বেশি মারা যায়। সাপে কাটার ঘটনা গ্রামাঞ্চলে, এবং কৃষি সংশ্লিষ্ট এলাকায় বেশি ঘটে থাকে। স্থলভূমিতে থাকা সাপ পায়ে বেশি দংশন করে। অধ্যাপক এমএ ফায়েজ জানিয়েছেন, “বাংলাদেশে যত মানুষ সাপের দংশনে মারা যায়, তার চারগুণ মানুষের নানা রকম অঙ্গহানি ঘটে, কেউ শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে যান, এবং কেউ দীর্ঘদিন মানসিক ট্রমা ভোগ করেন।” (বিবিসি বাংলা ২৭.৭.২০২০)।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ আহসান বলেছেন, “‘বাংলাদেশে ৯৪ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এদের মধ্যে ২৬টি প্রজাতি বিষধর। যার ১২ প্রজাতির অবস্থান সাগরে। বাকিগুলো গহীন জঙ্গলে এবং লোকালয়ে বসবাস করে।”নিজের একটি গবেষণায় উদ্বৃতি দিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা পড়ে কালকেউটের কামড়ে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ সাপে কাটার পর ওঝার কাছে যান। তখন বিপদ হয়ে যায়। শেষমুহুর্তে ওঝা হাল ছেড়ে দেয়। একসময় রোগীর মৃত্যু হয়।”
ড. ফরিদ বলেন, “২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে রাজশাহীতে একটি এলাকায় একই প্রজাতির সাপে কাটার কারণে ২০ জন মানুষ মারা গেছে। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তারমধ্যে একটি কারণ অ্যান্টিভেনম যথাযথ কাজ না করা। অঞ্চলভেদে সাপ যেমন ভিন্ন হয়, তেমনি বিষের মাত্রায় তারতম্য থাকে। তাই প্রতিষেধকের কার্যকারিতা নিশ্চিতের জন্য স্থানীয় সাপের বিষ দিয়ে অ্যান্টিভেনম তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা।”
একজন সাপে কাটা রোগীকে কমপক্ষে ৫টি ইনজেকশন দেওয়া হলে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বিষধর সাপেকাটা রোগীদের জন্য সরকারিভাবে অ্যান্টি স্নেক ভেনম নামের ইনজেকশন বা ভ্যাকসিন সরকারিভাবেই সরবরাহ করা হয়ে থাকে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সমূহ ও জেলা সদর হাসপাতালগুলোতেও এ ইনজেকশন সরবরাহ করা হয়ে থাকে (Orthosuchok.com; Oct 31 2017)।
এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০২২ সালে আমাদের দেশেই তৈরি হবে সাপে কাটার প্রতিষেধক। এজন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ৯ প্রজাতির ১২০টি সাপ পোষা হচ্ছে। ফলে দেশে প্রতিষেধক তৈরি হলে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রতিবছর ১০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। বিজনেস স্টান্ডার্ড বাংলা ২৯ জানুয়ারী ২০২০ জানায়, “২০২২ সালের মধ্যে দেশেই সাপে কাটার প্রতিষেধক (অ্যান্টিভেনম) তৈরির লক্ষ্যে পোষা হচ্ছে এসব সাপ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ৫ বছর মেয়াদী এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ৮০ মিলিয়ন টাকা।”
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সাপে কাটা একজন রোগীকে শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী অ্যান্টিভেনম দিতে হয়। “অনেকসময় একজন রোগীকে আট থেকে ১০ ভায়াল (১ ভায়াল=১০ এমএল) অ্যান্টিভেনমও দিতে হয়।বাংলাদেশে সাপে কাটার পর যে অ্যান্টিভেনম ব্যবহার করা হয়, সেটি ভারত থেকে আনা। ভারতের ছয়টি প্রতিষ্ঠান অ্যান্টিভেনম তৈরি করে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত অ্যান্টিভেনম তৈরি সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশে শুধু একটি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান দেশে অ্যান্টিভেনম বিপনন করে। তাদের এক ভায়াল অ্যান্টিভেনমের দাম প্রায় এক হাজার টাকা।” (বিজনেস স্টান্ডার্ড বাংলা ২৯.০১.২০২০)।
সাপ একদিকে ভয়ংকর প্রাণি অন্যদিকে উপকারীও বটে। কারণ, সব সাপ শাপ নয়- সব সাপ বিষধর নয়। সাপ ইঁদুর খেয়ে ফসলের উপকার করে। দাঁড়াশ সাপ মানুষের বসতবাড়ির আশেপাশে থাকে কিন্তু কাউকে কামড়াতে দেখা যায় না। দাঁড়াশ সাপ অন্যান্য ছোট বিষাক্ত সাপ ও পোকামাকড় খেয়ে ফেলে। সাপের বিষ দিয়ে অনেক মূল্যবান ওষুধ তৈরী হয়। গুঁইসাপ সহ সকল সাপের চামড়া দামী পণ্য। অজগর ও অ্যানাকোন্ডা সাপের মাংস খুব বিখ্যাত । অনেক দেশের মানুষ সাপের স্যুপ ও মাংস খায়। বিদেশে রেষ্টুরেন্টে সাপের মাংসের তৈরী ডিস খুব দামী কাবার। এজন্য সাপের খামার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
সাপে কাটার একটি বাস্তব ঘটনা দিয়ে লেখাটি শেষ করা যাক্। একবার এক বাড়িতে মা তার ছোট ছেলেটিকে বকাঝকা করেছিল। বাাচ্চা ছেলেটি অভিমান করে বাড়ির পুরনো প্রাচীর ঘেঁষে কান্নাকাটি করছিল। সে অভিমানে বেশী বেশী কাঁদছিল আর প্রাচীরের পুরনো ইটের ফুটোর মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। সেখানে থাকা বিষধর সাপ তার আঙুলে কামড় দিলে সে ব্যাথা পেয়ে আরো বেশী ডুকরে কেঁদে উঠে। কিন্তু তার মা তার কান্না থামানোর জন্য তার সাথে আরো বেশী রাগান্বিত হয়ে বকাঝকা করতে থাকে। ছেলেটি বিষের জ্বালায় আরো বেশী কাঁদতে থাকলে তাকে মারধর করা হয়। এভাবে কোন কিছু বোঝার আগেই সে মারা যায়। পরে তার হাতের আঙুলে সাপের দাঁতের দুটি বড় দাগ ও রক্ত ও তার শরীর নীল হওয়া দেখে নিশ্চিত করা গেলেও চিকিৎসা করার সময় পাওয়া যায়নি। এটি একটি সাপে কাটার করুন কাহিনী। বাচ্চার প্রতি পরিবারের অবহেলা এখানে বেশী দায়ী ছিল।
তবে যাই হোক না কেন, বিষধর সাপ আমাদের দেশে প্রতিবছর অনেক মূল্যবান জীবন কেড়ে নেয়। বিশেষ করে বর্ষাকালে আমাদেরকে অতি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। বসতবাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। কোথাও সাপের আনাগোনা পরিলক্ষিত হলে সেখানে বাচ্চাদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top