logo
news image

ভাতাভোগীদের অজ্ঞতায় দালালদের ডিজিটাল দৌরাত্ম্য

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম:
করোনাকালে স্মরণকালের সবকিছুর পরিবর্তন ঘটে চলেছে। এখন ঘরবন্দী মানুষের হাতে হাতে ডিজিটাল ডিভাইস। বলা হচ্ছে, মানুষের হাতের মুঠোয় পৃথিবীটা চলে এসেছে। কিন্তু বিশ্বের মোট প্রায় ৮ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে কতভাগ মানুষ সেটাতে অংশগ্রহণ করার সক্ষমতা অর্জন করেছে? এই প্রশ্নের উত্তর সবার জানা নেই, সহজে জানার উপায়ও নেই। কারণ, দেশে দেশে তথ্যের বিষয়ে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা রয়েছে।
উন্নত বিশ্ব সুকৌশলে ডিজিটাল সক্ষমতা অর্জন করে তার মাধ্যমে প্রায় সব ধরনের সেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছে বহু আগে। আমরা এখন সেটার চিন্তাভাবনা করছি। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পূর্বে স্কান্ডিনেভিয়ান কোন দেশের অবসরপ্রাপ্ত একজন বয়স্ক অক্ষম ব্যাক্তি সে দেশের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের অধীনে পেনশন পেতেন, বাড়িতে একাই থাকতেন, সপ্তাহান্তে তার রেফ্রিজারেটরের দুধের বোতল, ফলমূল, রুটি না ফুরালে বাসি হয়েছে বিধায় সেগুলো ফেলে দিয়ে নতুন তাজা খাবার ভরিয়ে দিয়ে যেতেন সরকারী সেবকর্মীরা। এখনও সেরূপ ব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে। তাদের অনুকরণে অনেক ধনী দেশে এই ধরনের সেবাদান প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। আমাদের কাছে সেগুলো গল্পের মত মনে হয়।
আমরা একবিংশ শতাব্দীর একুশ বছর পেরিয়ে সমাজের ভূমিহীন, গৃহহীন, ঠিকানাহীন, ভিক্ষুক, ভাসমান মানুষদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কথা ভাবছি। যারা কোন সরকারী চাকুরী করেননি, পেনশন পান না, যাদের অনেকের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরী হয়নি, অথবা যাদের অনেকেই স্বাক্ষর দিতে জানেন না, শুধু টিপসই দেন- তাদের জন্য ডিজিটাল সেবা চালু হয়েছে, হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে ভাতার টাকা প্রদানের ব্যবস্থা। এটুআই সেবা পরিকল্পনার অধীনে সরকারী সাহায্য পাবার জন্য জিটুপি (গভর্মেন্ট টু পারসন) ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় আটটি উইংয়ের মাধ্যমে নানা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। এগুলো বেশ আশাব্যঞ্জক নীতি ও জনকল্যাণের নিমিত্তে বড় সুখবর।
কিন্তু সেদিন অনেকগুলো জাতীয় দৈনিকের বড় খবর ছিল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়ে। কোথাও লাল হেডলাইনের বিবৃতি দেখে মাথা ঘুরে যাবার যোগাড় হয়ে গেল। লেখা হয়েছে, “ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ৭০ হাজার ভাতাভোগীর তথ্য নেই।”(দৈনিক যুগান্তর ২৫.০৬.২০২১)।
একজন সেবাগ্রহীতার নিজের নামে রেজিস্ট্রিকৃত ফোন বা ডিভাইস ছাড়া ডিজিটাল সেবা চালু হয় কীভাবে? এছাড়া একই ফোন নম্বরে বহুজনের টাকা পাঠানো হয়েছে। এখন তাদের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। যাদের নামে টাকা দেয়া হয়েছে তারা অজ্ঞ, অশিক্ষিত ভাতাভোগী। তাদের নিজের মোবাইল ফোন নেই। যার আছে সে ঠিকমত চালাতে জানে না, মেসেজ খুলতে জানে না, কদাচিৎ কেউ কেউ খুললেও নিজে পড়তে জানে না।
আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- অনেকের আইডি কার্ডে ভুল তথ্য আছে। অনেকে নিরুদ্দেশ, বা বাস্তভিটা হারিয়ে অভিবাসন করে অন্যত্র চলে গেছে। অনেকে মৃত্যুবরণ করলেও সেগুলো আপডেট করা হয়নি, অথচ তার নামে ভাতার টাকা ছাড় করা হয়েছে।
এছাড়া নিজের ডিভাইস ব্যতিরেকে অন্যের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা অনেক অজ্ঞ সেবাগ্রহীতার জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক তথ্যে জানা গেছে, ২০২৯-২০ অর্থবছরে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা খাতে ৫,৮৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। জিটুপি প্রকল্পের আওতায় ৭৬ লাখ মানুষের জন্য ডিজিটাল সেবা দিতে বিকাশ ও নগদ নামক দুটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। বিকাশ ২৩টি জেলায় ১৯৩,২২৭ জনের নামে হিসাব খুলে এবং নগদ ৩৯টি জেলায় ৫৭৯,৮৬১ জনের নামে হিসাব খুলে। কিন্তু নগদ ৯৯,৭৮১ জনের ডাটা খুঁজে পায়নি। এছাড়া যে ৭০ হাজার ভাতাভোগীর হদিস নেই, তাদের নামে টাকা পাঠানো হয়েছে এবং সে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
নিয়মানুযায়ী মাসিক ৫০০ টাকা হারে বয়স্কভাতা প্রদান করে সেবাভোগীদের দেয়া হয়েছে মোট ২,৯৪০ কোটি টাকা। ৫০০ টাকা হারে বিধবা ভাতা প্রদান করে সেবাভোগীদের দেয়া হয়েছে মোট ১,২৩০ কোটি টাকা। অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধীদেরকে ৭৫০ টাকা হারে প্রদান করে সেবাভোগীদের দেয়া হয়েছে মোট ১,৬২০ এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি হিসেবে ৭৫০ টাকা হারে সেবাভোগীদের দেয়া হয়েছে মোট ৯৫ কোটি টাকা।
এ সবকিছুর হিসেব রাখার জন্য তথ্যভান্ডার রয়েছে। টিআইবি বলেছে, একজন ভাতাভোগীর তথ্যভান্ডারে নাম এন্ট্রি করতে ১০০ থেকে ২০০ টাকা ঘুষ লাগে। দরিদ্র প্রতিবন্ধীর জন্য এন্ট্রি করতে লাগে ৪০০-৫০০ টাকা। ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিদেরকে এই সূবর্ণ কার্ড পেতে ৩,০০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়। এছাড়া জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল পর্যবেক্ষণ (এনএসএসএস) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভাতাগ্রহণের যোগ্য না হয়ে ভাতা নিচ্ছেন ৪৬%, বয়স্কভাতার শর্ত পূরণ করেননি ৫৯%, বিধবা ও স্বামী নিগৃহিত ভাতায় অনিয়ম হয়েছে ২৩%। তাহলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আসলে কী ঘটে চলেছে তা গভীরভাবে অনুসন্ধানের দাবী রাখে।
দেশের দারিদ্র্য হ্রাস না করে দিনের পর দিন হতদরিদ্রাবস্থা জিঁইয়ে রাখতে এসকল প্রকল্প দিয়ে উপকার কী? চাটুকার ও বাটপারদের দৌরাত্ম্যকে তো এই ডিজিটাল যুগে আর কোনভাবে প্রশ্রয় দেয়া যায় না। এদেরকে এখনই চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে না পারলে আর কখন ঠেকাবেন? পরে এরা আরো বড় হ্যাকার হয়ে ডিজিটাল গ্যাং নিয়ে অপরাধে নেমে পড়বে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০০৮ সাল থেকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীনে এক কোটি মানুষকে ভাতা দেয়। ২০১৮ সালে বিশ^ব্যাংকের অধীনে ক্যাশ ট্রান্সফার মর্ডানাইজেশন (সিটিএম) প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়। কিন্তু ২০২১ সালে দেখা যাচ্ছে, ৭০ হাজার সুবিধাভোগীর হদিস নেই!
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীনে অনেক আধুনিক সফট্ওয়্যার চালুর কথা বলা হচ্ছে। সেবাভোগীরা কি সেসব সফটওয়্যার চালাতে জানেন? তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া বা নেয়ার মত শারিরীক ও মানসিক যোগ্যতা ও সামথ্যের্র জরিপ বা যাচাই করা হয়েছে কী?
গত ১৪ জানুয়ারী ২০২১ জিটুপি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি মহৎ উদ্যেগ নিয়েছেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রকল্পগুলো থেকে আউটপুট পাবার জন্য যেসকল কাজ আগেই করা দরকার তা না করে অর্থ প্রদান করতে থাকলে সে অর্থ ভাতাভোগীর হাতে এই ডিজিটাল পদ্ধতিতেও পৌছাবে না বলে মনে হয়। এজন্য যেনতেন বা দায়সারা লিস্ট তৈরী না করে দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি নিতে হবে।
ভাতাভোগীর নিজের ডিভাইস নিজে চালানোর ক্ষমতা ছাড়া ডিজিটাল সেবা অবান্তর। তা শুধু ডিজিটাল দুর্নীতির ব্যাপক ডালপালা গজাতে সাহায্য করবে। এজন্য পক্ষপাতহীন জরিপের মাধ্যমে ভাতা পেতে উপযুক্ত ও ইচ্ছুকদেরকে নির্বাচন করে ডিজিটাল সেবা গ্রহণের দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অর্ন্তভূক্ত করে তাদেরকেই ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা নিতে হবে। অংশগ্রহণকারীরা ধীরে ধীরে স্থায়ীভাবে ভাতার জন্য যোগ্যতা অর্জন করবে। ভূয়া, অযোগ্য ভাতা গ্রহনেচ্ছুদেরকে শনাক্ত করার মাধ্যমে বাদ দিতে হবে।
মোদ্দাকথা, ডিজিটাল সেবাদান প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্তভোগী ডিজিটাল টাউট-বাটপারদের চরম দৌরাত্ম্য শুরু হয়েছে। সেটা ভূমি, কোর্ট, পাসপোর্ট, ট্রান্সপোর্ট, হাসপাতাল সব জায়গায়। এসব জায়গায় ডিজিটাল চোর ঠেকাতে জাতীয় পপুলেশন ডাটা ব্যাংকের সরকারী মূল তালিকার তথ্য নিয়ে ভাতাভোগীর স্বার্থ রক্ষার জন্য সুরক্ষা সফটওয়্যার বানাতে হবে এবং  ‘এক্সপার্ট রি-চেকিং ও ফায়ারওয়াল’ ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে হবে। এটা দিয়ে একদিকে মোবাইল ব্যাংকিং-এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও অন্যদিকে রোহিঙ্গা অন্তর্ভূক্তির মত ভূয়া বিষয়গুলো ঠেকানো সম্ভব। তা না হলে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার ডিজিটাল দুর্নীতির দৌরাত্ম্য ভয়ংকর করে তুলতে পারে।
কারণ, দরিদ্র, অজ্ঞ মানুষ এসব ক্ষেত্রে সেবা পেতে গিয়ে ডিজিটাল ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হয়ে আরো বেশী অসহায় ও নিগৃহীত হয়ে পড়ছে। তাই নব্য ডিজিটাল ঘুষখোর, টাউট-বাটপারদেরকে নির্মূল করতে না পারলে অসংখ্য সহজ-সরল দরিদ্র ও অজ্ঞ মানুষ সব জায়গায় বাধা ও অবিচার পেতে পেতে অচিরেই ধুলোয় মিশে যেতে পারে।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top