logo
news image

ভ্রান্তির শিকারে সংক্রমিত নিম্ন আয়ের মানুষ এখন ছুটছেন হাসপাতালে

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম:
ওনারা এতদিন বলে বেড়াতেন করোনা বড়লোকের রোগ। ওগুলো আমাদের ধরে না। আমাদের করোনা হয় না, হবেও না। আমরা গ্রামে থাকি। ক্ষেতে খামারে কাজ করি, সারাদিন রোদ-জলে ঘুরে বেড়াই। সাইকেল, রিক্সা চালাই। আমাদের ঘামের গন্ধে করোনা কাছে ঘেঁষে না।
মে ২০২১-এর শুরুতে ভারতের গ্রাম-গঞ্জে ও শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে টালমাটাল করে তুলেছিল। অদ্যাবধি তার ভয়ংকর রেশ চলছে। এর একমাস পার না হতেই জুনের শুরু থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় সংক্রমণ ছড়াতে থাকে। জুনের দ্বিতীয সপ্তাহে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের ২২টি জেলাশহর ও গ্রামাঞ্চলে ভয়াবহ ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়েন্টের রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হতে থাকেন। গত দু'সপ্তাহ ধরে চাঁপাই নবাবগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, সুন্দরবনের দাকোপ ইত্যাদি এলাকায় ভয়াবহ সংক্রমণ লক্ষ্য করা গেছে। তৃতীয় সপ্তাহ শুরু হবার সাথে সাথে দিনাজপুর, নওগাঁ, কুড়িগ্রাম, নোয়াখালী, সিলেট প্রভৃতি জেলায় সংক্রমণ বেড়েছে। জুন ১৭ তারিখে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনাক্রান্ত হয়ে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই দিনে সারা দেশে মারা গেছেন ৬৩ জন।
উপজেলা সদরের হাসপাতালগুলোতে করোনার তেমন কোন চিকিৎসা নেই। জেলা শহরের হাসপাতালেও গুরুতর কোভিড রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় হাইফ্লো নোজাল ক্যানুলা, অক্সিজেন সিলিন্ডার, ভেন্টিলেটর, আইসিইউ ইত্যাদি সরঞ্জাম নেই। দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, থুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গ্রামাঞ্চলের মুমূর্ষূ রোগীদেরকে রেফার্ করে পাঠানো হচ্ছে। তাই এসব মেডিকেল কলেজে করোনা রোগীদের উপচে পড়া ভীড়। বারান্দাতেও বিছানা পাতার উপায় নেই। চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। গত এক সপ্তাহ ধরে রাজশাহী ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন ১২ জন করে করোনা রোগী ও উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। লকড্উানের কারণে রোগী নিয়ে  ঢাকা যাওয়াও কঠিন। গরীব রোগীদের আর কোথাওভাল চিকিৎসা নিতে যাবার উপায় নেই।
এসকল রোগীর সিংহভাগ খেটে খাওয়া দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষ। যারা এতদিন মনে করতেন তাদের করোনা হবে না। তারা ভাবতেন করোনা শহুরে রোগ, ওগুলো টাকাওয়ালাদের অসুখ। দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষেরা অনেকেই কুসংস্কার ও অজ্ঞাতাবশত: নানা গুজব ছড়িয়ে দিতেন হাটে বাজারে। গ্রামের বাজারে কেউ মুখে মাস্ক দিলে তাচ্ছিল্য করে তাকে উপহাস করতে দেখা গেছে। কেউ বলে, গরীবের আবার ঘোড়া রোগ!
এছাড়া অনেক শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও করোনা ছড়ানোর প্রবণতা নিয়ে উন্নাসিকতা লক্ষ্য করা গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেনে যেখানে হার্ড ইমিউনিটি বিফল হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেছেন সেখানে বাংলাদেশেও এই তত্ত্বের সফলতা নিয়ে সন্দেহ ছিল। ভারতেও এটা বিফল হয়েছে। কারণ, করোনার ভেরিয়েন্ট একটিমাত্র নয়। নিত্যনতুন শত শত নাম না জানা ভেরিয়েন্টের কাছে হার্ড ইমিউনিটির ধারণা তেমন কার্যকরী নয়। করোনার এত প্রকারভেদ এবং আক্রান্ত এলাকার মানুষ ও পরিবেশের মধ্যে এত পার্থ্ক্য থাকায় সহজাত এন্টিবডি তৈরীর হিসেব মেলানো দুষ্কর।
অপরদিকে কিছু মানবতাবাদী ও ধার্মিক মানুষও দরিদ্র মানুষের মত অবৈজ্ঞানিক কথা বলেছেন্ কুম্ভ মেলা, জানাজা, ওয়াজ, ইত্যাদিতে যোগদান না করার ক্ষেত্রেও নানা কারণে চরম উদাসীনতা লক্ষ্য করা গেছে। ভারতে কুম্ভ মেলায় লক্ষ লক্ষ ভুয়া করোনা সনদ ইস্যু করে বিক্রি করা হয়েছে। যার বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে হাইকোর্টে রীটও হয়েছে বলে জানা গেছে। করোনার উৎপত্তি তত্ত্ব নিয়ে এখনও সন্দেহ ও বাকযুদ্ধ চলছে চীন ওযুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। পুরো ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে মনে হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে সম্ভাবনাময় মানুষের প্রিয় জীবনের।
সেই ২০২০ সালের শুরুতে বলা হতো পুঁজিবাদের জীয়নকাঠি করোনা। নীলাঞ্জন দত্ত লিখেছিলেন ২০২০ সালের ৮ এপ্রিল গ্রাউন্ডজিরোডট.কম-এ। তিনি বলেন, Òঅনেকে যেমন বলছেন, করোনা আসলে একটা চক্রান্ত বই কিছু নয়, তেমন বলার সাহস আমার নেই। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে সন্দেহ যে মনে জাগেনি তা নয়। কেনই বা আগে আমেরিকা বলছিল এটা চিনের জীবাণু-যুদ্ধের সামরিক পরীক্ষাগার থেকে বেরিয়েছে, তারপর চিন বলল মার্কিন সেনারা তাদেরই নিজেদের দেশের সামরিক গবেষণাগার থেকে লিক হওয়া এই ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে চিনে যৌথ মহড়া দিতে এসে অসচেতনভাবে হলেও ছড়িয়ে গেছে, আর তারও পর আবার রাশিয়া দুষলো ব্রিটেনের গোপন পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে, জানি না। তবে এইসব দোষাদুষির মধ্যে একটা কমন জিনিস তো রয়েছে, তা হল, যে দেশেরই হোক না কেন, কোনও এক সামরিক গবেষণাগার থেকেই এর উৎপত্তি। সেটা সত্যি কিনা, তা জানবার কোনও উপায় নেই যদিও।”
তবে যারা বলতেন করোনা 'রেসিস্ট’অসুখ। এটা গরীবের রক্ত চুষে খাওয়া মানুষদের ধরাশায়ী করার জন্য আবির্ভূত হয়েছে-তাদেরও এখন বাকযুদ্ধ বন্ধ। কারণ, ভারতের নিম্ন আয়ের করেনাক্রান্ত অসহায় মানুষ অথবা আমাদের গ্রামের নিষ্পাপ মানুষদেরকে তারা কীভাবে সান্তনা দেবেন?
যুগান্তর-ডিসেম্বর ২০, ২০২০ ড. ইসলামের এক লেখায় জানা যায়,  'গ্রামের মানুষ বলছেন- করোনা আমাদের অসুখ নয়। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। আমাদের সারা দিন কাটে রোদে, জলে, ঘামে ভিজে। আমরা ঘুমাই ভাঙা বেড়ার ঘরে। প্রতিদিন আমরা কাশি দিই, হুঁক্কা খাই। সকাল হলেই কাজে যাই। রাতে নাক ডেকে ঘুমাই। যারা পায়রার খুপরির মতো বন্ধ দালান ঘরে ঘুমায়, জানালা বন্ধ গাড়িতে চড়ে আর গায়ের ঘাম বের করে না- সেসব বড়লোকের অসুখ ওটা! আমাদের গ্রামে কতজনের জ্বর-কাশি হল। ওসব অসুখে এখনও কেউ মরেছে বলে শুনিনি।” আক্রান্ত হবার পরও গ্রামের মানুষের বিশ্বাস এখনও একই রকম রয়ে গেছে।
তাঁদের কেউ কেউ মনে করেন আল্লাহ্ মৃত্যু রাখলে করার কী আছে? ধর্মীয় বিশ্বাসে বলীয়ান লোকজন মনে করেন, আগুনে ফুঁ দিলে যদি আগুন নিভে যায় তবে করোনার জন্য শক্তিশালী দোয়া করে ফুঁ দিলে তা আমাদেরকে আক্রমণ করবে কেন? তবে সেই গভীর বিশ্বাসধারী ঈমানদার মুমিন লোক আজকাল কয়জন আছেন? তাই আজকাল দুর্নীতির টাকা খাওয়া শরীর-মনের ভেজাল ঈমান নিয়ে দোয়া করেও কাজ হয় না -সেজন্য তওবা করে দোয়া করার কথাও বলেছেন কেউ কেউ।
বিচিত্র মানুষের বিচিত্র ধারণার মধ্যে করোনার আলোচনা নিয়ে দিন পার হয়ে যায়, সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে গিয়ে আলোচনার খোরাকও ভারী হয়। মোদ্দাকথা- শহরে করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বাস্থ্যবিধির কথা সহজেই টিভি, ইন্টারনেটের মাধ্যমে সবার কানে পৌঁছানো গেলেও গ্রামের মানুষের মধ্যে তা পৌঁছানো যাচ্ছে না। কারণ, গ্রামাঞ্চলে অনেকের বাড়িতে বিদ্যুৎ, টিভি, ইন্টারনেট কিছুই নেই। সাধারনত: তারা বাজারে গিয়ে চায়ের দোকানে বসে সে তথ্যগুলো শোনেন।
তাদের কারো জ্বর হলে একটি আলাদা কক্ষে কোয়ারেন্টাইন করে রাখার মত ঘর নেই। বাজার বা কাজের পর জনসমাগম থেকে ফিরে গোসল না করে অনেকেই একটি ঘরে পরিবার নিয়ে ৫-৬ জন একসাথে বড় চৌকিতে বা মেঝেতে ঘুমায়। বাড়িতে একটা শৌচাগার সবাই ব্যবহার করে। কারো বাড়িতে কোন শৌচাগার নেই। বাঁশঝাড়, খোলা মাঠেই নিত্যপ্রাত:কর্ম করতে তারা অভ্যস্ত। ই-লাইকের গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা পজিটিভ ব্যক্তির এক গ্রাম মলে রয়েছে ১০০ মিলিয়ন আরএনএ। সংক্রমিত ব্যক্তি খোলা মাঠে মলত্যাগ করলে তা থেকে পশু-পাখি এবং বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে পারে করোনা ভাইরাস।
অনেক গ্রামে একটা টিউবওলের পানি ১০-১২টি পরিবার নিতে আসে। সবাই একটি টিউবওয়েলের হাতল বার বার স্পর্শ করে। বার বার হাত ধোয়ার জন্য ওদের অত সাবান, সেনিটাইজার কেনার টাকা নেই।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top