logo
news image

রোগ যুদ্ধ গজব সবাই চোখ রাঙাচ্ছে

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এসে রোগ-শোক, যুদ্ধ, গজব সবকিছু একসংগে চোখ রাঙাচ্ছে । করোনার দাউ দাউ করা জ¦লন্ত প্রভাবে টগবগ করে ফুটছে সারা বিশ্বের সব প্রান্তের মানবকুল। দেড় বছর ধরে এই আগুন নেভার কোন নামগন্ধ নেই, বরং বেড়েই চলেছে দিন দিন। ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুযায়ী মে ১৬ ২০২১ পর্যন্ত কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৬২,৯৯১,৫৪৭ জন এবং প্রাণ হারিয়েছেন ৩,৩৭৮,৬৫২ জন মানুষ। অশান্ত পৃথিবীতে কমছে না সংক্রমণের গতি ও মোট মৃত্যুহার। সেই সংগে মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হয়েছে যুদ্ধের ভয়ংকর ডামাডোল। কেউ জানে না ক্রমাগত কোথায় গিয়ে ঠেকবো আমরা।
আমাদের দেশে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সরকারী হিসেব মতে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুসংখ্যা নিম্নগামী। বড় শহর কেন্দ্রিক হাসপাতাল ও পরীক্ষাগারে আগত করোনা রোগীদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই হিসেব করা হয়ে থাকে। সংক্রমিত হয়ে যারা বাড়িতে অবস্থান করছেন ও মারা যাচ্ছেন তাদের ব্যাপারে কোন সঠিক পরিসংখ্যান জানা যাচ্ছে না। কারণ অনেকেই সংক্রমিত হবার পর কুসংস্কারের ভয়ে তথ্য গোপন করছেন আবার অনেকে আরো বেশী খারাপ হতে পারে এই ভেবে হাসপাতালে যেতে ভয় পাচ্ছেন। প্রতিবেশী ভারতে করোনা পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়ায় আমাদের আশঙ্কা বেড়ে গেছে। সীমান্ত পথে আমদানী-রপ্তানী চলছে। সীমান্তে হাট-বাজারে লোকজন নানা কায়দায় গরু ও পণ্য নিয়ে হরদম আসা যাওয়া করছে। এত বিশাল সীমান্ত পথে চোরাচালানীতে অভ্যস্ত লোকজন কে কখন গোপনে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে তা নিরুপণ করা মোটেও সহজ কাজ নয়। ঈদের ছুটিতে আমাদের লোকজন গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে গিয়ে সবার সাথে উন্মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করে চলেছে। তাই ঈদের ছুটি শেষে এসব মানুষ যাতে খুব শীগগীর রাজধানী ঢাকা বা বড় শহরে ফিরে না যান সেজন্য বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। কিন্তু রিমোট এলাকায় বেড়াতে যাওয়া লোকজন এসব সতর্কবাণীর নির্দেশনা কি শুনতে পেরেছেন?
ভারতের উত্তর প্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ উভয়ই করোনার ঢেউয়ের আঘাতে পর্যুদস্ত। উপযুক্ত সৎকার করতে না পেরে ভারতে লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে গঙ্গায়। উভয় প্রদেশের ২৭ জেলার গঙ্গাতীরে ১১৪ কি.মি যাত্রাপথে দুই হাজারেরও বেশী মৃতদেহ কবর দেয়া হয়েছে। গঙ্গাতীরের বালুতে যেনতেনভাবে পুতে রাখা কবর থেকে লাশ টেনে বের করে খাচ্ছে শেয়াল-কুকুর এবং সেগুলোতে ভাগ বসাচ্ছে কাক, চিল, শকুন। এছাড়া নদীতে ভাসিয়ে দেয়া সংক্রমিত মৃতদেহ সংক্রমণ ছড়াচ্ছে পানি বাতাস ও আশপাশের পরিবেশে। সেগুলো থেকে আমাদের দেশে নদীতীবর্তী এলাকায় নদীবাহিত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ নিয়ে আমাদের দেশের কর্তৃপক্ষগুলো খুব চিন্তিত। এজন্য ভারতের সাথে সীমান্ত বন্ধসহ ঈদের ছুটির মধ্যেও দুরপাল্লার বাস ও ট্রেন বন্ধ রাখা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার তারিখ আবারো পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।
তবে জীবন-জীবিকা বাঁচানোর কথা ভেবে কোনটা এক্ষুনি করা উচিত বা করা উচিত নয় এ ব্যাপারে তাৎক্ষনিক কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খাচ্ছে সেবাদানকারী কর্তৃপক্ষগুলো। লকডাউনের মধ্যে পরিবহন নিয়ে উল্টেপাল্টা সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষকে বেশী করে ভোগান্তিতে ফেলে দিয়েছে। তাই মানুষকে বেশী ভাড়া দিয়ে ঢাকায় চলাচলকারী লোকাল বাসে চড়ে ঈদ যাত্রায় দুরের পথে পাড়ি দিতে বাধ্য হতে হয়েছে। ঈদে যানবাহন চলাচলের উপর ভুল সিদ্ধান্ত ও চরম নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং পথে পথে চাঁদা, বখশিশ আদায় নিয়ে যাত্রী ও ড্রাইভার উভয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। একজন যাত্রী টেকনাফ থেকে সিরাজগঞ্জে গেছেন আটবার গাড়ি বদল (হাইএস মাইক্রো, কার, অটোরিক্সা, ট্রাক, লেগুনা, রিক্সা, বাস, মিনিট্রাক ও রিক্সাভ্যান) করে। যাত্রাপথে তিনগুনেরও বেশী ভাড়া গুনতে গিয়ে কয়েক হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে তাঁকে। ছোট চাকুরীর সামান্য কয়টা টাকার সিংহভাগ পথে খরচ করে ফেলায় তাঁর ঈদের কেনাকাটা সংকোচন করতে হয়েছে। পরিবারের কাছে এসেও এবারের ঈদ তার কাছে পান্সে মনে হয়েছে। তার মত অন্য কারো জীবনে এইরকম ভোগান্তি যেন আর না আসে সেজন্য তিনি খুবই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
চারদিকে এত বিপর্যয়ের মাঝে ভারতে হানা দিতে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘তাওকত’। এজন্য ঝড়ের গতিপথ পর্যালোচনা করে সম্ভাব্য আঘাত হানতে পারে এমন প্রদেশগুলোতে জরুরী উদ্ধারকারী টিম মোতায়েন করার কথা জানা গেছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি ইসরাইলী মানুষরুপী হায়েনারা নিরস্ত্র, দুর্বল মানুষেদের বসতভিটা কেড়ে নেয়ার জন্য ফিলিস্তিনী জনগণের ওপর আক্রমণ করে চলেছে।
ভয়ংকর যুদ্ধ শুরু করেছে ইসরাইল। আল-আকসা মসজিদে পবিত্র জুমাতুল বিদা পালন করার সময় ইবাদতরত মুসলিমদের ওপর হঠাৎ হামলা করার মাধ্যমে এর সূত্রপাত। মে ১৬ পর্যন্ত ইসরাইলী সেনাবাহিনী ১৪৯ জন নিরস্ত্র ফিলিস্তিনীকে হত্যা করেছে। যার মধ্যে গর্ভবতী নারী ও ৪১ জন শিশুও রয়েছে।
ইসরাইলী সেনাবাহিনী ইসরাইলী সেনাবাহিনী বিমান আক্রমণ করে পশ্চিম তেিরর আলজাজিরা টিভি সম্প্রচার কেন্দ্র ও এপি-র অফিস গুঁড়িয়ে দিছে। সেখানকার তের তলা বিশিষ্ট ‘জালা টাওয়ার’ বোমা মেরে ধ্বংস করে দিয়েছে। যেখানে অনেকগুলো ফ্লাটে সাধারণ পরিবার বসবাস করতো। হাজার বার বিমান দিয়ে বোমা বর্ষণ করে ও স্থল আক্রমণ করে নিরীহ নারী পুরুষকে হত্যা করে চলেছে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত অশিপ্ত ইসরাইলীরা। মহান আল্ল্াহ্ তা’য়ালা ইসরাইলীদেরকে অনেক প্রাচুর্য্য দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা বার বার আল্লাহ্র আদেশ অমান্য করায় শাস্তিস্বরুপ দুনিয়াতে ভূমিহারা ও গৃহহারা হয়ে যাযাবর জীবন যাপন করে আসছিল। তবুও তাদের আস্ফালন কমেনি। এখনও তারা নিজেদেরকে বড় মনে করে ও দুর্বলদের ওপর নির্মমভাবে হত্যযজ্ঞ চালিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নিতে চায়। আর তাদেরকে আস্কারা দেয় পশ্চিমা মানুষরুপী বহুরুপী কিছু জাতিগোষ্ঠী। তারা সবসময় ‘ডানের গরু বামে খেদায়।’ যারা যুগ যুগ ধরে সারা পৃথিবী লুন্ঠন করে মানুষের অধিকার হরণ করে আসছে। অস্ত্রব্যবসা ও নিরীহ মানুষকে হত্যা-নিপীড়ন করা যাদের মজ্জাগত অভ্যাস, তারাই তাদের বন্ধু। তাদের অঙ্গুলি ইশারায় চলে ইসরাইলীরা।
‘ফিলিস্তিনীদের অধিকার কি? দুর্বলদের ওপর আক্রমণ কেন?’ বর্বর, দখলদার ইসরাইলীদেরকে বছরে চারশ’ কোটি ডলার সহায়তা দেবার বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার-  ইত্যাদি নানা কথা বলে তাদের দেশেরই কিছু সিনেটর পদবীধারী হৃদয়বান মানুষ। কিন্তু সেসব নীতিকথা হালে পানি পায় না।
মুসলিম বিশ্বের সংগঠন ওআইসি এই বর্বরতার বিরুদ্ধে কি করছে? তারা এমন নিষ্ঠুরতাকে সমর্থন দেয় কেন? এতে তাদের কি লাভ? বিশ্ব কি অন্যায়কে চেয়ে চেয়ে দেখতেই থাকবে নাকি মুখ বুঁেজ নীরবে সহ্য করে যাবে? এমন হাজারো প্রশ্ন সেই জন্ম থেকেই শুনে আসছি। কিন্তু কারো কোন বিকার দেখিনি কোনদিন। কারণ, সেই জ্ঞান হবার পর থেকে দেখে আসছি ইসরাইলীরা বিমান দিয়ে বোমা বর্ষণ করে ফিলিস্তিনীদেরকে হত্যা করে আর ফিলিস্তিনী শিশুরা গুলতি হাতে নুড়ি-পাথর ছুঁড়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেয়! এ অবস্থার অবসানকল্পে এবারে নতুন এক শক্তি দেখা গেল ফিলিস্তিনীদের মাঝে। ফিলিস্তিনীরা এখন পাঁচ মিনিটে তেলআবিবের দিকে দেড়শ’ রকেট ছুঁড়ে প্রতিবাদ করতে পারে। ফিলিস্তিনীদের এই ক্ষুদ্র শক্তি অর্জন করাতেই ইসরাইলীরা চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করেছে। আমরা আশা করি,  প্রতিবাদের ভাষা রপ্ত করুক পৃথিবীর সকল নির্যাতিত মানুষ, গর্জে উঠুক তারা সকল বর্বর-নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে আপন শক্তি ও মহিমায়।
সকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে এই প্রবণতা তৈরী হওয়া জরুরী। তা না হলে ক্রমাগত উথলে উঠা লোনা জলের সুনামীর প্রভাবে হারিয়ে যেতে পারে প্রেম-প্রীতি ভালবাসা। মিইয়ে যেতে পারে অবশিষ্ট মানবতাটুকু।
দীর্ঘদিন করোনাজলের তিক্ততায় সিক্ত হয়ে ইসরাইলের মত দেশে দেশে অনেক শাসক করুণা হারিয়ে নিষ্ঠুরতার হোলিখেলায় মেতে উঠেছে। রোগ-শোক, যুদ্ধ মিলে ভয়ংকর এক ‘ভয়’ বিরাজ করছে চারদিকে। এই ভয় কিভাবে দুর হবে আপাতত: উপায় জানা নেই কারুরই।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top