logo
news image

চেয়ার

ইলিয়াস উদ্দীন বিশ্বাস।।
চেয়ার শব্দের বাংলা অর্থ কেদারা যা একটি বিশেষ্য পদ। কিন্তু কেদারা শব্দটির বাংলা ভাষায় ব্যবহার নেই বললেই চলে। অথচ চেয়ার শব্দের ব্যবহার ও গুরুত্ব অত্যন্ত ব্যপক। চেয়ার থেকেই এসেছে খুব গুরুত্বপূর্ণ পদ চেয়ারম্যান বা চেয়ারপারসন। চেয়ারের মর্যাদা বলে একটা কথা সমাজে প্রচলিত আছে। একটা নির্দিষ্ট পদের চেয়ারে বসে যদি কোনো ব্যক্তি ন্যায়-নীতি মেনে পদ অনুযায়ী যথোপযুক্ত কার্যক্রম গ্রহণে সক্ষম হন তবে বলা হয় তিনি চেয়ারের মর্যাদা রক্ষা করছেন। অন্যথায় বলা হয় তিনি চেয়ারের মর্যাদার হানি করছেন। সত্যি কথা বলতে শেষোক্তটিই বেশি ঘটে থাকে আমাদের সমাজে। এথেকে মুক্তি পেতে হলে চেয়ারধারী ব্যক্তিকেই অধিক সচেতন হতে হবে।মনে রাখতে হবে পদ মানুষের চিরদিন থাকে না, কৃতকর্মই থাকে। অযাচিত চাপের মুখে কোনক্রমেই নতী স্বীকার করা যাবে না। এ পদের উর্ধতন কর্তৃপক্ষকেও সদা সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। তবেই চেয়ারের মর্যাদা রক্ষা পাবে। এছাড়া চেয়ারের অপব্যবহার এমন কথাও বেশ প্রচলিত। এক কথায় এর অর্থ ক্ষমতার অপব্যবহার। এতে দেশ ও সমাজে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি ঘটে। চেয়ারধারীর চাওয়া-পাওয়ার শেষ থাকে না। মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। তাই বহু আগেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'দুই বিঘা জমি' কবিতায় লিখেছেন -
এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি।
চেয়ার শব্দটি ব্যবহার করে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের চিন্তা-চেতনা ও দর্শন সম্পর্কে বিশদভাবে গবেষণার জন্য দেশে-বিদেশে সৃষ্টি হয়ে থাকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-ইনস্টিটিউটে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ পদ। যেমন- আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধু চেয়ার, রবীন্দ্র চেয়ার, নজরুল চেয়ার, বোস চেয়ার ইত্যাদি। বিশেষ পান্ডিত্য সম্পন্ন অধ্যাপকগণের গবেষণার বিষয়বস্তু ও সেটার মান বিবেচনায় নিয়ে এ সব পদ প্রদান করে তাঁদেরকে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয়ে থাকে। এ পদ অলংকৃত করেন যাঁরা, তাঁরা আরো গবেষণা করেন সেই সব বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের জীবন ও কর্মের উপর।
চেয়ার নিয়ে এক স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার স্কুল জীবনে। সেই স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে আমার সেই স্কুলটির প্রতিষ্ঠা ও গ্রামের ইতিহাস সংক্ষেপে তুলে ধরা অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলেই আমার ধারণা। স্কুলটি ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত। তবে প্রতিষ্ঠাকাল কাগজে-কলমে আরো আগে দেখানো হয়েছে। সে বছরই এ স্কুলে ভর্তি হই তৃতীয় শ্রেণিতে। এটি রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার অন্তর্গত পাকড়ী ইউনিয়নের নবী নগর প্রাইমারি স্কুল। গ্রামের কৃতি সন্তান আমার মামা অধ্যাপক আলতাফ হোসেন (বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ফজলুর রহমান (দর্শন বিভাগ, রাজশাহী কলেজ), আমার আব্বা তৈমুর রহমান বিশ্বাস, জনাব আলম হোসেন, জনাব মমতাজ হোসেন ও জনাব ইসরাইল হোসেন সর্বসম্মতিক্রমে স্কুলের এই নামকরণ করেন। ফলে গ্রামের নামও হয় নবী নগর। আগে এই নামে এলাকায় কোনো গ্রাম ছিল না। যেটি ছিল সেটির নাম বারহাটি। অবশ্য এই নামটা এখনও বেশ প্রচলিত। সেখানে ছিল সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর বাস আর আমাদের পরিবারসহ বহু পরিবারের বাথান (খামার) বাড়ি। তবে ১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাসে জমি চাষাবাদের সুবিধার্থে কয়েকটি মুসলিম পরিবার বসত বাড়ি স্থাপন করে। আমাদের পরিবার আসে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে। তারপর বহু পরিবার আসে এই গ্রামে। তবে বাথান বাড়ি থেকেই আমাদের পূর্ব পুরুষেরা শত শত বছর ধরে বরেন্দ্র ভূমির জমি চাষাবাদ করে ফসল ফলিয়েছে। তখন ফসল ফলাতে বৃষ্টির উপরই নির্ভর করতে হতো কৃষককে। ফলে বর্ষাকালে রোপন করা আমন ধানই ছিল প্রধান ফসল যা অগ্রহায়ণ মাসে মানুষের ঘরে উঠত। তবে আউশ ধানও ছিল অল্পবিস্তর। এখন মানুষ প্রায় জমিতে ইরিগেশনের মাধ্যমে তিনটি ফসল উৎপাদন করছে। গ্রামের ভিতর দিয়ে গেছে আঠারো ফুট চওড়া ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পাকা রাস্তা রাজশাহী ভায়া কাকনহাট হয়ে আমনুরা। গ্রামে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের বেশ দোকান-পাট। সময়ের ব্যবধানে নবী নগর গ্রাম আজ প্রকৃতই নগরে পরিণত হয়েছে । স্বাধীনতার আগে আমাদের বসবাস ছিল গোদাগাড়ী উপজেলার কাশিমপুর গ্রামের পশ্চিম পাশে চরকাশিমপুর গ্রামে। সে গ্রামে তখন ছিল দুটি প্রাইমারী স্কুল ও একটি মাদ্রাসা। গ্রামটি ছিল তৎকালীন নবাবগঞ্জ মহকুমার সদর থানার অন্তর্গত। গ্রামটি বহু আগেই মহানন্দা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
 নবীনগর প্রাইমারি স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পরপরই আমার আব্বা তৈমুর রহমান বিশ্বাস, আমার মামা অধ্যাপক আলতাফ হোসেন, অধ্যাপক ফজলুর রহমান জোর চেষ্টা চালান সেটি জাতীয়করণের। বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭৩ সালে প্রায় সাঁইত্রিশ হাজার প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ করে তার মধ্যে এটি একটি। সে সময়ে আমাদের তানোর-গোদাগাড়ী আসনের এমপি ছিলেন জাতীয় নেতা ও মন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান। এত অল্প সময়ে স্কুলটি জাতীয়করণে তাঁর ছিল কৃপাদৃষ্টি। স্কুলটি জাতীয়করণের পর আমার যে চারজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের চাকরি স্থায়ী হয় তাঁরা হলেন সর্বজনাব মো. ইসরাইল হোসেন, মো. রস্তুম আলী, মো. ইসমাইল হোসেন ও মোসা. মারজিনা বেগম।
১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসে প্রধান শিক্ষক হিসেবে অন্য স্কুল থেকে বদলি হয়ে আসেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আমাদের গ্রামেরই জনাব আলম হোসেন। তিনি সম্পর্কে আমার ভাই। তখন আমি ৫ম শ্রেণিতে পড়ি। ক্লাসে ছাত্র মাত্র ৫ জন। এর মধ্যে আমার সহপাঠী মো. আমিরুল ইসলাম (বর্তমানে শিক্ষক) ও আমাকে বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার ভাবনা তাঁর মাথায় আসে। তিনি বললেন, 'বাড়িতে যখন কুটুম আসে তখন মাছ বা মুরগি রান্না হয়। অর্থাৎ সেদিন খাবারটা ভালো হয়। তেমনি তোদের বৃত্তি দেয়ার প্রস্তুতি নিলে এতে পড়াশোনাও ভালো হবে।' যেই কথা সেই কাজ। আমাদেরকে বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য বিশেষ যত্ন সহকারে পড়াতে লাগলেন। তখন বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ছাত্রসখা নামে একটা বই পাওয়া যেত। সেটি আব্বা কিনে দিলেন। সামনে মাত্র কয়েক মাস পরেই পরীক্ষা। স্কুল ছুটির পর স্যার তীব্র গরম এড়াতে বিকেলে স্কুল ঘরের সামনে ঘরের ছায়ায় আমাদেরকে বসিয়ে লেখাপড়া করাতেন। আমরা টেবিলের এক পাশে দুজন চেয়ারে বসতাম। টেবিলের অন্য পাশের চেয়ারে বসতেন আমদের শিক্ষক। আমরা দুজনে স্কুল ঘর থেকে চেয়ার-টেবিল নিয়ে গিয়ে এভাবে সাজাতাম।
আব্বা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি। তিনি স্কুল ঘরের মেরামত কাজ দেখতে গিয়ে দেখলেন, আমরা যে ধরনের চেয়ারে বসে আমাদের শিক্ষকও একই ধরনের চেয়ারে বসে। এটা তখন আব্বার ভালো লাগেনি। তাই আব্বা শিক্ষকের উদ্দেশ্যে বললেন-‌আলম, এটা ভালো দেখাচ্ছে না।  
‌শিক্ষক বললেন ‌বাপু (চাচা), তাদের অভ্যাস করাচ্ছি।
‌আব্বা তখন বললেন -‌এতে তাদের আকাঙ্খা নষ্ট হচ্ছে।
সেদিন এসব কথার অর্থ বুঝিনি। পরের দিন আমাদের শিক্ষক একটি চেয়ার একটি বেঞ্চ টেবিলের পাশে রাখতে বললেন। আমাদের আসন হলো এবার বেঞ্চে। তখন বুঝতে পারলাম আগের দিনের আব্বার ও শিক্ষকের কথোপকথনের তাৎপর্য। সেদিনই আমার মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক চেয়ারে বসার আকাঙ্খাটা বেশ ভালোভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল বলে মনে হয়।
আমাদের প্রধান শিক্ষক জনাব আলম হোসেন ছিলেন সত্যিকারের মানুষ গড়ার কারিগর। তিনি ১৯৮৭ সালে রাজশাহী জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হন। তাঁর বড় ছেলে ড. এ এস এম কামারুজ্জামান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের প্রফেসর। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, হেড, ডাইরেক্টর, ডিন, ট্রেজারার, ভিসি পদের চেয়ারে বসলাম। মহামান্য রাষ্ট্রপতির ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেশে-বিদেশের সভায় চেয়ারে বসার সুযোগ পেলাম। কিন্তু আফসোস আমার আব্বা এসব দেখে যেতে পারেননি। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রভাষক পদে যোগদানের পর তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। তার কিছুদিন পরেই তিনি অকালে ইহকাল ত্যাগ করেন। আব্বাকে শেষ বিদায়টাও দিতে পারিনি। আমি তখন ইতালির আইসিটিপিতে ছিলাম। শিক্ষকের মর্যাদা ও ছেলের বড় হবার আকাঙ্খা সৃষ্টির আব্বার সেই ভাবনা আজও আমার সকল কাজে বড় প্রেরণা জোগায়।
এখানে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের অনেকেই পরকালে চলে গেছেন। আমি সবার কাছেই ঋণী। এ ঋণ স্বীকার করা যায় তবে শোধ করা যায় না। আল্লাহ তুমি সবাইকে তোমার বেহেশতের বাগিচায় স্থান করে দাও। আর যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদের নেক হায়াত দান কর।

* প্রফেসর ড. মো. ইলিয়াস উদ্দীন বিশ্বাস: উপাচার্য, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top