logo
news image

পরীক্ষা ছাড়া আর পাশ করতে চাই না

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
করোনার নতুন ঢেউ এসেছে তৃতীয় ভেরিয়েন্টের মারাত্মক ভয়াবহতা নিয়ে। সারা পৃথিবীর সাথে ভয়ে কাঁপছে উপমহাদেশের মানুষ। বাংলাদেশেও করোনার কালো ছোবল এনে দিয়েছে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতন ও চতুর্মুখী অনিশ্চয়তা। এর সবচেয়ে বড় আঘাত লেগেছে শিক্ষা ক্ষেত্রে। সব কিছু এলামেলোভাবে বন্ধ ও খোলার মধ্যে চললেও গত একবছর চার মাসেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়নি। কিছু বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইন পড়াশুনা ও পরীক্ষার ব্যবস্থা করা গেলেও সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তেমন কিছুই করা সম্ভব হয়নি। দেশের পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোর ফটক কবে খুলবে তা এখনও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।
এইচএসসি-র মত পাবলিক পরীক্ষা কোন রকমে গত এসএসসি ও অষ্টম শ্রেণির জেএসসি-র ফলাফল দিয়ে জোড়াতালির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। সেই ফলাফল দিয়ে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির জন্য জোর প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু এপ্রিলে করোনার তৃতীয় ভেরিয়েন্টের আক্রমণে মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে চিন্তার উদ্রেক শুরু হয়েছে।
সবকিছু খোলা রেখে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরজায় তালা দিয়ে রাখা হয়েছিল জীবনের প্রতি মায়া-মমতার কথা বলে বলে। বলা হয়েছিল- আগে জীবন পরে অন্যকিছু। কিন্তু অন্য সবকিছু উদারভাবে খুলে-মেলে দিয়ে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুয়ার বন্ধ রেখে কি সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকানো গেছে?
অনলাইন শিক্ষার নামে গত একবছর শুধু অহেতুক কালক্ষেপণ করা হয়েছে। এই দায়সারা অনলাইন পড়াশুনার নামে শিক্ষার ক্ষতি হয়েছে মারাত্মক। এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে মাত্র ৩০ ভাগ শিক্ষার্থী অনলাইন পাঠদানে অংশগ্রহণে সমর্থ হয়েছে। অন্যদের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নানা কারণে অনলইনে ক্লাশে অংশগ্রহণ করা সম্ভবপর হয়ে উঠেনি। এতে তাদের জ্ঞানের ক্ষতি, মানসিক ক্ষতি হয়েছে। যারা অংশ নিয়েছে তারাও নানা কারণে মনযোগ হারিয়ে ফেলেছে। পরীক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় তাদের মধ্যে চেতনাবোধ ও প্রতিযোগিতাবোধ নষ্ট হয়ে সঠিক জ্ঞানের বিকাশ হয়নি। পরীক্ষা হবে না এই চেতনাতে তারা অনলাইনে লগইন করে পাঠে যুক্ত হবার পর সিরিয়াস থাকেনি। অনেকে হেলাফেলা করে একই সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুকে সময় পার করে দিয়েছে। ফাঁকিবাজ শিক্ষার্থীদের মাধমে অনলাইন ক্লাসে যুক্ত থাকার পরও এটা এক ধরণের প্রহসন তৈরী করেছে। কারণ অনেক শিক্ষক নিজেরাই অনলাইন ক্লাশ নেবার ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ। তাই তারা শিক্ষার্থীদের এই চালাকি ধরতে পারেননি।
অন্যদিকে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা সহায়তা ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস প্রদানের কথা বলা হলেও সেটা বহুলাংশে কাগুজে কথা হিসেবে থেকে গেছে। কারণ শত শত দরিদ্র শিক্ষার্থী সম্বলিত একটি বিভাগে মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকার অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেটা অনেক বিভাগ বছর পেরিয়ে গেলেও কিভাবে ব্যবহার করবে তা নির্ধারণ করতেই হিমশিম খেয়েছে। এছাড়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা সহায়তা ঋণ প্রদানের জন্য কিছু বিশ^বিদ্যালয় ঘোষণা করলেও নানা জটিলতায় অনেককে তা গ্রহণ করতে পারেনি। যেমন, ঋণের জন্য ব্যাংক হিসেব খুলতে একজন শিক্ষকের গ্যারান্টর হবার নিয়ম থাকায় অনেকে করোনাকালীন সময়ে বিভাগে গিয়ে কোন শিক্ষককে খুঁজে পাননি অথবা দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর কেউ কেউ পেলেও ভাল পরিচয় না থাকায় অনেকের ফরমে শিক্ষকগণ সই দিতে অনীহা প্রকাশ করেছেন এমন রিপোর্ট পাওয়া গেছে।
তাই উন্নত বিশে^ অনলাইন শিক্ষায় সকল শিক্ষার্থী অ্যাকসেস্ পেলেও আমাদের দেশ নানা জটিলতায় শুধু সামর্থ্যবানদের শিক্ষা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। শহুরে বসবাসরত সামর্থ্যবানদের অথবা চাকুরীজীবিদের সন্তানরা অনেকে বিনে পয়সায় অনলাইনে পড়াশুনা করে যাচ্ছে কিন্তু গ্রামের শিক্ষার্থীরা বাড়িতে নেটওয়ার্ক না পেয়ে হাটে-বাজারে গিয়ে সাইবার সার্ভিসের দোকানে পয়সা খরচ করেও কাঙ্খিত অনলাইন পড়াশুনায় অংশগ্রহণ করতে বঞ্চিত হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। গ্রামের মেয়ে শিক্ষার্থীরা রাতের বেলায় অনলাইন ক্লাশে অংশ নেয়ার জন্য খোলা মাঠের আবাদি জমিতে, পুকুর পাড়ে বা বাজারে যেতে পারেনি। তারাও বেশ হতাশা ব্যক্ত করেছে। সুতরাং আমাদের মত বৈষম্যপূর্ন সমাজে অনলাইন শিক্ষা সবার জন্য নয়।
অন্যদিকে সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরকে দ্রুত টিকা প্রদান করে স্বাস্থ্য বিধি মেনে ক্লাসে যোগদানের কথা বলা হয়েছিল। এজন্য বিদ্যালগুলোতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয় হয়েছিল এবং সেসকল ব্যবস্থা পরিদর্শন করে রিপোর্ট প্রদানের কথা ছিল। কোথাও কোথাও পরিদর্শন সম্পন্ন করা হয়েছে। কিন্তু তারপর আর কোন অগ্রগতি হয়নি। এরপর করোনার দ্বিতীয় ও কোথাও তৃতীয় ঢেউ শুরু হলে সবকিছু ওলটপালট হয়ে পড়েছে।
কথা হলো- ভবিষ্যতে আমাদেরকে করোনাকে সঙ্গী করেই লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হবে। এটাকে জুজুবুড়ির মত ভয়-ডর করে গৃহবন্দী থাকলে চলবে না। করোনাকালীন সময়ে স্কুলে পড়ালেখার জন্য এনসিটিবি ও ন্যাশনাল একাডেমি ফর প্রাইমারী এডুকেশন (ন্যাপ) যেসব নিয়ম-কানুন চালু করার চিন্তাভাবনা করেছেন তা অনলাইন শিক্ষায় ভাল হতে পারতো। কিন্তু যেখানে গ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন অ্যাকসেস্ পাওয়াটাই দুষ্কর সেখানে এই ব্যবস্থা সুফলদায়ক হতে পারে না। আবার প্রতিসপ্তাহে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওয়ার্কশিট, এসাইনমেন্ট ইত্যাদি দিয়ে পরের সপ্তাতে সংগ্রহ করে আনার জন্য এত লোকবল কি তাদের আছে? বিশেষত: করোনাকালীণ সময়ে সেরূপ ভাবনাও বেশ অবান্তর।
বলাই বাহুল্য আমাদের দেশের বাস্তব প্রেক্ষাপটে সবার জন্য অনলাইন শিক্ষা এই মুহূর্তে সম্ভবপর নয়। সবার জন্য এর সুফল প্রদানের কৌশল ও ক্ষমতা খুবই সীমাবদ্ধ।
তাই একটি উপায় হলো- করোনার প্রকোপ কিছুটা কমে গেলে ভয় না করে দ্রুত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। করোনার বিরুদ্ধে প্রধান প্রস্তুতি হলো, সবাইকে দ্রুত টিকা দিতে হবে। সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে দ্রুত টিকা প্রদান করে স্বাস্থ্য বিধি মেনে ক্লাসে যোগদানের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেবার ঘোষণা দিতে হবে। টিকার জন্য শুধু একমাত্র ভারতের সেরাম ইন্সিটিউটের উপর ভরসা করে কালক্ষেপণ না করে চীন, রাশিয়া বা অন্য যে কোন দেশ থেকে টিকা আমদানি করতে হবে। আমরা নিজেরা যাতে কোন প্রতিষ্ঠিত ব্রান্ডের টিকা আমাদের দেশেই তৈরী করার অনুমতি পেতে পারি সেজন্য দ্রত ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, সুসময়ে অনেকে বন্ধু হলেও দু:সময়ে কেই কারো নয়। বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতের উপর নির্ভরশীলতা আমাদের অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না পাবার বেদনার মত ফিবছর কাঁদাতে পারে।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরকে দ্রুত টিকা প্রদান করতে পারলে আমরা দ্রুত শ্রেণিকক্ষে ফিরে যেতে পারবো। দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্লাশ ও পরীক্ষাগুলো নিতে পারবো। পরীক্ষা ছাড়া কোন প্রতিযোগিতা জমে না। প্রতিযোগিতা ছাড়া কোন কিছু অর্জিত হলে সেটা অনার্জনের শামিল, সেখানে কোন গৌরব নেই বরং আছে ঘৃণা ও অপবাদ। এর উদাহরণ, যেমন আমাদের ভোটার বিহীন জাতীয় নির্বাচন। জাতীয় নির্বাাচনে প্রতিযোগিতার ব্যাপার না থাকায় সেটা আজও দেশে-বিদেশে অনেকের কাছে একটা পানসে বিষয়।
এছাড়া ভাল বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। কারণ, অনলাইন পড়াশুনার মাধ্যমে দেশের সত্তরভাগ শিক্ষার্থীদেরকে বঞ্চনার মধ্যে নিপতিত করে আমরা জাতির মধ্যে আরো বেশী বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারি না।
করোনা দিন দিন আমাদেরকে অন্ধ করে দিচ্ছে। আমরা সেই অন্ধত্ব ঘুচাতে চাই। কারখানা শ্রমিকরা যেমন প্রতিদিন সংক্রমণের ভয়কে উপেক্ষা করে জীবন-জীবিকা বাঁচাতে তৎপর হয়ে কাজ করছে আবার বাড়িতে তাদের শিশুদের কাছে ফিরে হাসিমাখা মুখ বজায় রাখছে তেমনি করে আমাদের শিক্ষাকে বাঁচাতে হবে ও শিক্ষাপরিবার গুলোকেও বাঁচাতে তৎপর হতে হবে। ব্যাংকার, ডাক্তার, পুলিশ, শ্রমিক সবাই নিজ নিজ কর্মশেষে পরিবারে ফেরে। তাদের যদি ভয় না থাকে তবে শিক্ষাক্ষেত্রে জুজুবুড়ির ভয় কেন? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলুক। ভয় নেই। আমরা শ্রেণিকক্ষে যেতে চাই, পড়াতে চাই পরীক্ষা নিতে চাই। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে নিজের গৌরব বজায় রাখতে চায়, জাতির মুখ উজ্জল করতে চ্য়া। পরীক্ষা ছাড়া পাশ করে ওজনহীন গণসনদ নিয়ে জীবনভর অপবাদ বইতে চায় না।
অধিকিন্তু অযথা আরো কিছু অজানা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা শুধু আমাদের জাতিগত জ্ঞানের কুপমুন্ডুকতা বাড়াতে সাহায্য করবে বৈ কি?

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top