logo
news image

তিস্তা চুক্তির আশ্বাস কতযুগ হিমঘরে থাকবে?

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
সম্প্রতি তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে মমতা ব্যানার্জী বলেছেন- “আগে নিজে খাব, পরে তো দেব” (দৈনিক ইত্তেফাক ৮.৩.২০২১)। কথাটি  এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরের সময় উভয় দেশের অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য  চুক্তি সই করার বিষয় সম্পর্কে মমতা ব্যানার্জীর সামনে তিস্তা প্রসঙ্গ উত্থাপন করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে।
এর আগে ২০১৭ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘তিস্তায় তো পানি নেই-চুক্তি হবে কিভাবে’? তাঁর কথা ছিল তিস্তা নয়- তোরসা, জলঢাকা, মানসাই, ধানসাই ইত্যাদি নদীতে পানি আছে। সেগুলো থেকে বাংলাদেশের জন্য পানি দেয়া যাবে। তিনি বলেছিলেন-বাংলাদেশের তিস্তা চুক্তি নয়, দরকার তো জলের! তবে এসব ক্ষীণ জলধারাকে বর্ষাকালে নদী মনে হলেও এগুলো সারা বছর প্রবাহমান কোন নদী নয়। এসব নদীর কোন অস্তিত্ব বা প্রবাহ কি বাংলাদেশে আছে? তিনি তিস্তা পানি বন্টনের কথা অন্যখাতে নিয়ে গেছেন। কিন্তু তিস্তা সমস্যার সমাধান তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি দিয়েই করতে হবে। তার আপাতত: কোন বিকল্প নেই। কারণ, চীনের সংগে তিস্তা পুন:র্জীবন ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত প্রকল্পের একটি সফল বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতের বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন।
মমতা ব্যানার্জী এধরনের কথা বহুদিন যাবত শোনাচ্ছেন। সেটা নিজেদের কারণে আমাদেরকে বাধ্য হয়ে শুনতে হচ্ছে। কিন্তু শুধু বল্লেই হলো? তিস্তার পানি কে সিকিমে আটকালো বা কে মহানন্দা দিয়ে সরিয়ে নিল? কোথায় গেল? কোথায় যাচ্ছে? কোথায় কে ব্যবহার করছে বা কে কোথায় আটকে রেখে, কে খাচ্ছে? মমতা ব্যানার্জীর মুখে তিস্তায় পানি নেই উক্তিটি শোনার পর এপ্রশ্নগুলো নিয়ে মুখে ও মিডিয়ায় এখন হৈ হৈ ব্যাপার চলেছে। শুনতে খারাপ লাগলেও এটা ওপেন সিক্রেট। প্রযুক্তির বহুধা ব্যবহারের এ যুগে অনেকেই তা জানেন। এপ্রিলে উপরের বরফ গলা পানিও তিস্তা দিয়ে নেমে আসে। মমতার কথা যে সঠিক নয় তা সবাই স্বীকার করবেন। এবার বললেন নিজে আগে খাওয়ার কথা!
বহু বছর পূর্বেই বলেছিলাম, প্রকাশিতও হয়েছিল- মমতার একাই খাব নীতি তিস্তা চুক্তির অন্তরায়। এবারও টিভিতে তাঁর বাচনভঙ্গি ও অবহেলাসূচক কথাবার্তা দেখে তাই মনে হলো। এখন মার্চ মাসের ঝাঁ ঝাঁ রোদেজ¦লা খরার সময়। আমরা বাংলাদেশে প্রবল তৃষ্ণার্ত ও উৎকন্ঠিত। এমন সময় মমতার মমত্বহীন কন্ঠ আমাদেরকে আবারো হতাশ করেছে- করেছে ক্ষোভে ভারাক্রান্ত।
সাবেক একজন পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, “ভারত সবই পেয়েছে.. এবারের বৈঠকে তিস্তা নদীর পানি বন্টন প্রসঙ্গে কোন ইঙ্গিত নেই।” শুধু সভার পর সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন ক্যাটাগরীতে। সব সময় শুধু আশ^াস দিয়ে সভা শেষ করা হয়েছে। এতবড় আন্তর্জাতিক দ্বি-পাক্ষিক সমস্যা হওয়া সত্বেও তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি কোন কার্যকর সমাধানের দিকে গড়ায়নি।
তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার এজেন্ডা নিয়ে মোট কতবার মিটিং-বৈঠক হয়েছে মনে আছে কী? বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সভা করার হিসেব অনুযায়ী ছিয়ানব্বইবার বসা পূরণ হয়েছিল কয়েক বছর আগেই! সেই ১৯৯৮ সালে ডালিয়ার ‘অবসর’, ঢাকার সচিবালয়, নানা জায়গায় বহুবার অতীতের বহু প্রেসিডেন্ট-মন্ত্রী-সচিব কমিটি, টেকনিকাল কমিটি, সংসদীয় কমিটির প্রচেষ্টা ভন্ডুল করে ২০১৭ সালে দিল্লীর রাজপ্রাসাদের ঝলমলে আলোয় বন্ধুত্বের উষ্ণতার মধ্যে আলোচনার ফলাফলে অনেক ইতিবাচক আশা ছিল।
তখন আমাদের আশার ওপর ’বাড়া ভাতে ছাই’ দেয়ার কাজটি করেছিলেন মমতা ব্যানার্জী। সেবার ৩৬টি চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরিত হলেও তিস্তাকে সুকৌশলে বাদ রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি  বলেছিলেন মমতার কথা, আর মমতা বলেছিলেন ভিন্ন কথা-যেখানে বাংলাদেশের মানুষের অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি অক্টোবর ৫, ২০১৯ সালে  বলেছেন দ্রুততম সময়ে তিস্তা চুক্তি করা হবে। ইন্টারনেটের এই যুগে দ্রুততম সময় বলতে চোখের পলক বুঝানো হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদি কি এ বিষয়ে মমতার সাথে পরামর্শ করে বলেছেন? কারন ২০১৭ সালে আমরা দেখেছি কেন্দ্রকে মমতা ব্যানাজী তোয়াক্কা করেন না। আজ ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরের সময় উভয় দেশের অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য একটি বড় সুযোগ এসেছে। কিন্তু তিস্তা প্রসঙ্গ নিয়ে ইতোমধ্যে সেখানেও নানা বাগ্ড়া বসানো হয়েছে।
আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বচ্চো কর্তৃপক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে- ওগুলো বাদ, এটা আনন্দ উৎসব। তিস্তা সমস্যা নিয়ে চিন্তা পরে হবে! পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেছেন, ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সই হয়ে গেছে ১০ বছর আগেই। তবে বাস্তবায়ন হয়নি। তিস্তা চুক্তি নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তিস্তা তো অলরেডি ১০ বছর আগে চুক্তি হয়ে গেছে। বাস্তবায়ন হয় নাই (দৈনিক যুগান্তর ১৩.৩.২০২১)।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে দুই দেশের পানিসম্পদ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তার পানিবন্টন চুক্তির বিষয়ে দুইপক্ষ একমত পোষণ করে এবং মনমোহন সিংয়ের সফরেই চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতায় সেটি আটকে যায়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বলেছেন, “তিস্তা চুক্তি ১০ বছর আগে পাতায় পাতায় সই হয়েছে। ডকুমেন্টও উভয়পক্ষ। ভারত সরকার আমাদের বলেছে, আগে যে চুক্তি হয়েছে সেটা স্ট্যান্ডবাই। তারা এটা গ্রহণ করে এবং তার থেকে কোনো ব্যত্যয় হয়নি। কী কারণে যে বাস্তবায়ন হয় নাই, আমরা তো সেটা জানি” (দৈনিক যুগান্তর ১৩.৩.২০২১)।
কথা হলো, কি কারণে দশ বছর আগে সই করা চুক্তি অদ্যাবধি বাস্তবায়িত হয়নি তা সরকারের জানা থাকলেও ভুক্তভোগীরা জানার জন্য বেশ কৌতুহল নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তাহলে সেটা কি একটা ডামি ছিল? পরে কি আর সেটার অগ্রগতি হবে না? বাস্তবত: যুগ যুগ ধরে তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি সই করার আশ^াস দিয়ে সেটা সুকৌশলে হিমঘরে রাখা হয়েছে। মানুষের দেহে প্রবল পানির নিয়ে তৃষ্ণা নিয়ে মনে কোন উৎসবে আনন্দ করার কোন উপায় থাকে কি? তিস্তার একটি ন্যায্য পানিবন্টন চুক্তির আশ^াস আর কতযুগ হিমঘরে পড়ে থাকবে? তিস্তা চুক্তি পরে আর কবে কোন সময় হবে সেটার আশ^াস শুনতে শুনতে মানুষ বড্ড ক্লান্ত। সেটা কবে কীভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে তা ভুক্তভোগীদের কাছে মোটেও বোধগম্য নয়!
আগেই উল্লেখ করেছি, চীনের সংগে তিস্তা পুন:র্জীবন ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত প্রকল্পের একটি সফল বাস্তবায়ন করতে গেলেও ভারতের বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন। বাংলাদেশের এই সুবর্ণ সময়ে যদি সেটা আদায় করা না যায় তাহলে ‘‘বাংলাদেশের মানুষ খুবই ভাগ্যবান’’ হয় কীভাবে?

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top