logo
news image

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ স্বীকৃতি এবং রোকেয়া খাতুন

নিজস্ব প্রতিবেদক।।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বের ‘গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে ইউনেস্কোর দেওয়া স্বীকৃতির নেপথ্যে ছিলেন ইডেন কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রোকেয়া খাতুন। তিনি নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার কৃতী সন্তান ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমানের স্ত্রী এবং দৈনিক প্রাপ্তি প্রসঙ্গ পত্রিকার উপদেষ্টা।
অধ্যাপক রোকেয়া খাতুন ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে তিনিই প্রথম ইউনেস্কোয় তুলে ধরেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কি করে একটি দেশ স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারে।
একটিমাত্র ভাষণে উদ্বেলিত সাতকোটি মানুষ। এরপর রক্তস্নাত পথ পেরিয়ে একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব বিশ্বদরবারে বাঙালির স্বাতন্ত্র্য পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করেছিলো।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ভাষণকে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি বাঙালির আত্মগরিমার মুকুটে নিশ্চয় এক উজ্জ্বল পালক। তবে এ স্বীকৃতির নেপথ্যে রয়েছে এক বাঙালি নারীর বিশেষ অবদান। বিভিন্ন পর্যায়ে অনুঘটক হিসেবে ছিলো তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা।
ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেই ভাষণে স্বাধীনতাকামী সাত কোটি বাঙালিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
জয়পুরহাটের মেয়ে রোকেয়া খাতুন ২০০৩ সালে তিনি ২২তম বিসিএসএসে যোগ দেন শিক্ষা ক্যাডারে। স্বামী ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান। স্বামীর কর্মসূত্রের সুবাদে ছিলেন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের প্রভাষক। তার বদলির সুবাদে চলে আসেন ঢাকায়। প্রথমে গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে।
পরে ২০০৭ সালে প্রেষণে বদলি হয়ে প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কোয়। ২০১১ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় কোরিয়ান ইউনেস্কো আয়োজিত ‘সেকেন্ড রিজিওনাল ট্রেনিং ওয়ার্কশপে অন দ্য ইউনেস্কো ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডে’ বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন রোকেয়া খাতুন।
তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ঐতিহ্যগত গুরুত্ব আছে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে বাংলাদেশের এমন গুরুত্বপূর্ণ নথি বা প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপনের। প্রথম দিকে স্থানীয় পর্যায়ে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম কাব্য তথা সাহিত্য নিদর্শন হিসেবে ‘চর্যাপদ’ তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরিবর্তে তিনি এমন কিছু তুলে ধরার পরিকল্পনা করেন যা সত্যিকারভাবেই বিশ্বে ভিন্ন এক স্বীকৃতি লাভ করতে পারে।
তাঁর স্বামী পুলিশ কর্মকর্তা শাহ মিজান শাফিউর রহমান অসাধারণ অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। তিনিই পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, পৃথিবীর বুকে একমাত্র একজন নেতার একটি ভাষণই গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলো। সেটা বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। যে ভাষণ পুরো জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিল। শক্তি যুগিয়েছিল প্রতিরোধ যুদ্ধের। নয় মাসের সেই সশস্ত্র সংগ্রামের পর আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ইউনেস্কোর তালিকায় ঠাঁই পেতেও যে ভাষণের রয়েছে পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহাসিক প্রভাব।
নিয়ে তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কোর তৎকালীন সচিব আব্দুল খালেকের সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি যথেষ্ঠ উৎসাহ দেন। ঐতিহাসিক সেই ভাষণের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আর প্রভাব বিশ্বের ফোরামে তুলে ধরতে শুরু হয় গবেষণা। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ন্যাশনাল আরকাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তরে ছোটাছুটি  করেন। নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে আমাকে যথেষ্ঠ সহযোগিতা করেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম প্রতিনিধি হিসেবে তিনি যোগ দেন ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় কোরিয়ান ইউনেস্কো আয়োজিত ‘সেকেন্ড রিজিওনাল ট্রেনিং ওয়ার্কশপ অন দ্য ইউনেস্কো মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডে’।
২০১১ সালের ১১ থেকে ১৪ মার্চ অনুষ্ঠিত ওই কর্মশালায় বাংলাদেশ ছাড়াও অংশ নেয় ভুটান, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মিয়ানমার, পালাও, পাপুয়া নিউগিনি, ফিজি, সলেমন দ্বীপপুঞ্জ, পূর্ব তিমুরসহ ১১ দেশের প্রতিনিধিরা। উপস্থিত ছিলেন, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ইউনেস্কার মেমোরি অব রোকেয়া খাতুনের হাতে ঐতিহাসিক স্বীকৃতির দলিল। দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ) এর তৎকালীন চেয়ারপারসন রোজলেন রাসেল, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের চেয়ারপারসন রে অ্যাডমন্ড সনসহ পাঁচজন বিশেষজ্ঞ।
সেখানে বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ৭ মার্চের ভাষণের ওপর তাঁর উপস্থাপনা প্রশংসা পায়। এর মধ্যে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের চেয়ারপারসন রে অ্যাডমন্ডসন আমার উপস্থাপনের ভূয়সী প্রশংসা করে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই অবিস্মরণীয় ভাষণের গুরুত্ব উপস্থানে বেশকিছু মতামত ও পর্যবেক্ষণ দেন। থাইল্যান্ডের আবহাকর্ন মনোনয়ন আরও শক্তিশালী করতে ভাষণের পিছনের ব্যক্তি-ক্যামেরা, শব্দগ্রহণ প্রভৃতি কাজে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের যুক্ত করার পরামর্শ দেন।
বিশ্বব্যাপী আর্থ-সামাজিক অস্থিরতা, যুদ্ধের হুংকার, প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানে ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে এমন সম্পদ যখন বিনষ্টের পথে, গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক অনেক দলিল যখন নষ্টের ঝুঁকিতে, সেই প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রাম চালু করে ইউনেস্কো। সেই ফোরামে বিষয়টি প্রথম উপস্থাপনের ছয় বছর পর সেই ভাষণের বিশ্বস্বীকৃতিতে সত্যিই গর্বে বুক ভরে যায়।
দীর্ঘদিন পর হলেও বঙ্গবন্ধুর সেই যাদুকরী ভাষণের বিশ্বস্বীকৃতি বাংলাদেশকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিলো। সেই প্রয়াসের ক্ষুদ্র অংশ হতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করেন। যখন প্রথম এই আনন্দ ঘোষণা শুনেন, তখনই আনন্দে আত্মহারা হন।
জয়পুরহাট জেলার নতুনহাট সরদারপাড়ার সরদার মমতাজুস সামাদের মেয়ে রোকেয়া খাতুন। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় রোকেয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ থেকে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। স্বামী ২০তম বিসিএস’র পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শাহ মিজান শাফিউর রহমান। ব্যক্তিগত জীবনে এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জননী।
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ) কর্মসূচির অধীনে আন্তর্জাতিক তালিকায় (ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার) মোট ৭৮টি দলিলকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। যে তালিকায় ৪৮ নম্বর স্থানে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। ইউনেস্কো মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top