logo
news image

একজন উচ্চশিক্ষামন্ত্রী দরকার

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
জাতীয স্মৃতিসৌধের পাশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক ভবনগুলোর দরজায় তালা ঝুলেছিল ২০১৯ সালে। মেইন গেইট ছিল বন্ধ। কেউ ভিতরে ঢুকতে না পারায় টেবিল চেয়া বেঞ্চে ধুলোবালির আস্তরণ জমে ছিল। করোনার কারণে ২০২০ সালটা নানা বিষের জ¦ালার মধ্যে কোনদিক দিয়ে যেন নিমিষেই পার হয়ে গেছে। এখন ২০২১ সালের দুটো মাস চলে যাবার সময় হয়ে আসতেই শিক্ষার্থীদের ধৈর্য্যরে বাঁধ যেন ভেঙে গেছে। গ্রাম-গঞ্জের মধ্যে নেট সুবিধাবিহীন অবস্থায় থেকে অনেকের অনলাইন ক্লাসগুলোতেও অংশ নেয়া যায়নি। বাড়ির কৃষিকাজেও মন বসে না। সারাদিন ভবঘুরের মত এদিক-সেদিক ঘুরেফিরে আর কতদিন বাড়িতে বসে কাটানো যায?
দেশে করোনার মধ্যেও সব কিছুই খোলা আছে। শুধু শিক্ষার মত অপরিহার্য প্রতিষ্ঠানের ফটক তালা মেরে রাখা হয়েছে। সাথে আবাসিক হলগুলোতেও তালা। এদিকে বিভিন্ন বিভাগে পরীক্ষা শুরু হযেছে। তাই ক্যাম্পাসের আশেপাশে বন্ধুদের মেস, বাসাবাড়িতে ঠাঁই নিয়ে কোনরকমে পরীক্ষার কাজ চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। অনলাইন ক্লাসের জন্য ডিভাইস দেবার কথা থাকলেও কেউ সেটা পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। এখন প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক হল খোলার জন্য টালবাহানা চলছে। তার মধ্যে শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণায় জানানো হলো আরো প্রায় তিনমাস পর হল (মে ১৭ ২০২১) খোলা হবে, ক্লাশ-পরীক্ষা নেয়া হবে। অথচ, অনেক বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষিত হয়েছে। বিভিন্ন বিভাগে ভাইভাসহ নানা পরীক্ষা চলছে। হঠাৎ এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাস্ত্য়া নেমে পড়েছে শিক্ষার্থীগণ। অনেক হলে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তালা ভাঙতে দেখা গেল। শুধু ছেলেরা নয়- মেয়েদেরকেও তালা ভেঙে হলে ঢুকতে দেখা গেল।  তারা শিক্ষালাভের জন্য ক্লাশে যেতে চায়, পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে কাজ পেয়ে  দ্রুত স্বাবলম্বী হতে চায়।
বহু বিশ^াবদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের ভিসির বাসার সামনে বসে জটলা করে হৈ চৈ করছে। কেউবা সুর করে শ্লোগান তুলে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কেউ বলছেন প্রভোষ্টের পদত্যাগ চাই। কেউবা বহিস্কার চাইছেন। কেউ আবার বলছেন, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সবকিছু খোলা রাখা হলেও শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কারণ দেশে করোনায় কজন মানুষ মরছে? তার চেয়ে হার্ট এটাক ও আত্মহত্যা করে প্রতিদির দ্বিগুন-তিনগুন বেশী মানুষ মারা যাচ্ছে। তবে যে যেভাবেই বলুক না কেন- সবগুলোই তাদের শিক্ষালাভের জন্য প্রতিষ্ঠান, হল খুলে দেয়া, দ্রৃত পরীক্ষা নেয়াকে কেন্দ্র করেই বলা।
এদিকে করোনর জন্য সামনে কবে কখন কি হবে কেউ তা জানে না। সবাই হতাশ। কারণ, বলা হচ্ছে- টিকা প্রদান শুরু হরেও সেটা এখনও গবেষণা পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া নতুন করোনার জন্য অনেক দেশে নতুন ভীতি তৈরী হয়েছে। করোনাকে ছাপিয়ে আমাদের দেশে শিক্ষাবদ্ধতা এখন ক্লাশ-পরীক্ষা নেবার আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। এজন্য আমাদের দেশের বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে অনেক সময় সেখানকার দুর্নীতিবাজ প্রশাসনের বিরুদ্ধে পদত্যাগের দাবী তুলে রাস্তায় নেমে পুলিশের গুতো খেতে হচ্ছে আর সরকারী দলের সহপাঠী দের সাথে মারামারি করে সময় পার করতে হচ্ছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার পড়াশুনা-গবেষণা লাটে উঠে ভেংচি কেটে সবাইকে পরিহাস করে চলছে কোথাও কোথাও। আমরা সবাই লাজ-লজ্জা ফেলে যেন এসবের মজা দেখি! এ কেমন শিক্ষাপরিবেশে বাস করছি আমরা? কারো যেন কোন দায় নেই! সব কিছু যেন চোখ বুজে সয়ে যেতে হয়! কর্তৃপক্ষগুলো এ- ওকে দায় চাপিয়ে দিয়ে পার পাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অনেক সময় এসব সংবাদ দেখে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করে এই উচ্চ শিক্ষাব্যস্থার অনিয়মগুলোকে।
খোলা থাকলে সুবিধাপ্রাপ্ত একদল ছাত্র নামধারী দুবৃত্তদের চাঁদাবাজি ও বখরা পেতে লাগামহীন দৌরাত্ম্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে চরম অশান্ত করে তুলে। খোলা না থাকলেও নির্মাণ কাজ তো আর বন্ধ নেই। সম্প্রতি দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থানীয় রাজনীতির ধারক ও বহিরাগত শিক্ষার্থীদের একটি সেকশন খুব বেপরোয়া। তারা সামান্য স্বার্থের জন্য শিক্ষক ও অফিসারদের প্রতি খারাপ আচরণ করতে মোটেও কুন্ঠিত হয় না। দু’বছর আগে রাজশাহী পলিটেকনিকের প্রিন্সিপাল সাহেবকে সবার সামনে মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে চ্যাংদোলা করে পুকুরে নিক্ষেপ করেছিল ছাত্রলীগ নামধারী কিছু দুবৃত্ত। ভাগ্যিস তিনি সাঁতার জানতেন। তা নাহলে ২০-২৫ ফুট পানিতে তলিয়ে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হতো! আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের এই নৈতিক অধ:পতন কেন হলো-তা ভেবে দেখার বিষয়। রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ন ও অপরাজনীতি আজ সব নীতিকে ধূলিস্মাৎ করে দিয়ে অট্টহাসি হেসে বেড়াচ্ছে।
এজন্য অরাজনীতিবিদ ও স্বার্থপর ব্যবসায়ীদেরকে ক্ষমতা দিয়ে বড় বড় দায়িত্ব দিলে চলবে না। পাশাপাশি শিক্ষা ও গবেষণার সাথে সম্পর্কহীন, পেশার সাথে নৈতিকতার সম্পর্কহীন দলকানা চাটুকারদেরকে ভিসি, প্রিন্সিপালের দয়িত্ব দিলে চলবে না।
আমাদের দেশের জন্য চিন্তাশীল ব্যক্তির দরকার। জাতির উন্নতির প্রয়োজনে নীতিবান গবেষক দরকার। চিন্তা ও গবেষণা ব্যতিরেকে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রগুলো তাইতো অসাড় হয়ে পড়েছে। এদের ছাত্ররা স্ট্রেস নিতে শিখবে কীভাবে?
বর্তমান সময়ের বাস্তবতায় করোনার দীর্ঘ ছুটির একঘেঁয়েমিতে নাজেহাল হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। এই নাজুক প্রেক্ষাপটে পাবলিক-প্রাইভেট সকল বিশ^বিদ্যালয়গুলোকে বাঁচাতে হলে দল-মত হিসেব না করে হীন রাজনীতির উর্দ্ধে উঠতে হবে। দেশের সবকিছু খোলা রেখে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাটাকে অনেকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। পথে-ঘাটে অফিস-আদালতে মানুষ কোথাও স্বাস্থ্যবিধির তোয়ক্কা না করে ঘেঁষাঘেষি করে চলাফেরা করছে, কাজ করছে দীর্ঘদিন যাবৎ। তদুপরি, দেশে করোনার প্রকোপ তেমন ভয়ংকর হয়ে উঠেনি। এরপরও করোনার দোহাই দিয়ে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাটা দুর্ভাগ্যজনক। ফেব্রুয়ারী ২৪ তারিখে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের এক কর্মসূচিতে অভিযোগ শোনা গেল- ওদের কোন এক ব্যাচের মাস্টার্সের সকল পরীক্ষা শেয হয়েছে শুধু একটিমাত্র পরীক্ষা বাকী আছে। তারা গণমাধ্যমকে বলছে- এমন অবস্থায় পুনরায় তিনমাসের জন্য ছুটি বাড়িয়ে হঠাৎ সকল ক্লাশ-পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়াটা চরম হঠকারী সিদ্ধান্ত। এমন খামখেয়ালীপূর্ণ ঘোষণার জন্য ওই শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়ে দলবেঁধে রাস্তায় নেমে পড়েছে। অন্যদিকে আবাসিক হল খোলা না থাকায় তারা বাড়ি ছেড়ে মেসে গাদাগাদি করে সময় পার করছে-যেখানে কোন স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই!
দেশে এখন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেকে বেড়ে গেছে। বেড়েছে শিক্ষার্থীসংখ্যা। এদের শিক্ষাপ্রয়োজনীয় চাহিদা বেশী, যোগান অনেক কম। তাই তাদের দাবী-দাওয়া বেশী এবং তা বহুলাংশে অপূরিত। আমাদের এত বেশীসংখ্যক উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য যে বৈশি^ক মানের উন্নত ব্যবস্থাপনা দরকার তা মোটেও চোখে পড়ে না। বরং বিশ^বিদ্যালয় বানিয়ে সেখানে প্রাচীন ধারণার ব্যবস্থাপনা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এখনও সেগুলো দলীয় রাজনৈতিক গ্যাঁড়াকলে আবদ্ধ। একটি স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দাবী ও জরুরী প্রয়োজনকে রাজনৈতিক শিকলের দোহাই দিয়ে তাদের অপরিহার্য শিক্ষা অধিকারকে প্রতিনিয়ত  ক্ষুন্ন করা হচ্ছে। এসব বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রধানগণ সেখানে নতজানু। কারণ তারা অনেকেই একটি অভিন্ন প্রতিযোগিতাপূর্ণ একাডেমিক প্রতিভার দাবীতে নিয়োগপ্রাপ্ত না হয়ে ব্যক্তিগত দৌড়ঝাঁপ করে ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে ভিন্ননীতিতে নিয়োগ পেয়েছেন। তাই এখন তারা শিক্ষার্থীদের মৌলিক প্রয়োজনগুলো না ভেবে তাদের নিয়োগদাতার ঘাড়ে দায় চাপিয়ে ক্ষ্যন্ত দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। ফলে কোথাও দেখা যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ কড়া নির্দেশ দিলেও শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে জ্যাম তৈরী করছেন, কোথাও আবাসনের অভাবে হাতুড়ি দিয়ে হলের তালা ভেঙ্গে ফেলছেন! সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এই হাল শুধু দেশবাসী নয়- সারাবিশে^র বিবেকবান মানুষ হতাশ হয়ে প্রত্যক্ষ করছেন।
উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এই নাজুক অবস্থা তৈরী করার জন্য শুধু আমাদের দুর্বল নীতি ও ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করলে চলবে না। বরং সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বিজ্ঞ বিবেচনাপ্রসূত শিক্ষানেতার অভাবটাই যেন বেশী প্রকট। কারণ তারা কেউই হঠাৎ কোন সরকারী সিদ্ধান্তের ওপরে নিজেদের মতকে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পান না। সবাই একজায়গায় নতজানু। এটা তাদের একটি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রকৃতি বিরোধী অবস্থান।
 এই হীন অবস্থা নিরসনে আশু ঢেলে সাজাতে হবে উচ্চশিক্ষার নীতিমালাকে। আ্র এজন্য ভালো মানের শিক্ষানেতা নিয়োগ দিতে যে সার্চ কমিটির প্রয়োজন সেটাকে নেৃতত্ব দিতে একজন ‘বিশ^বিদ্যালয় মন্ত্রী বা উচ্চশিক্ষামন্ত্রী- র’ নিয়োগদান করা আশু প্রয়োজন। যিনি শুধু উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভালমন্দ দেখ্্ভাল করবেন।
বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষার পাশাপাশি ও গবেষণা করা হয়ে থাকে। উন্নত বিশে^ বিশববিদ্যালয়গুলো থেকে যে গবেষণা হয় বা দেশে যেসকল উন্নয়নকর্মসূচি গ্রহণ করা হয় সেগুলোর সাথে তাদের পারস্পরিক যাগাযোগ, সমন্বয় ও দায়বদ্ধতা থাকে। ফলে তাদের উন্নয়ন কাজে জবাবদিহিতা তৈরী হয় ও অপচয় কম হয়। আর আমাদের দেশের দেশজ উন্নয়নে (ইনডিজিনাস ডেভেলপমেন্ট)-এ এ্ই যোগসূত্রতা অদ্যাবধি তৈরী হয়নি। তাই এই যোগসূত্র তৈরী করাটা বেশ জরুরী। তবে একজন ‘বিশ^বিদ্যালয় মন্ত্রী বা উচ্চশিক্ষামন্ত্রী- র’ গুণ হবে উপরে বর্ণিত সবযোগ্যতা ছাড়িয়ে, যিনি কোনদিন দলকানা রোগে ভুগেননি ও লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করেননি, যার অনেক নৈতিক যোগ্যতা ও বিশ^মানের গবেষণামূলক পাবলিকেশন্স আছে। তা না হলে আমাদের উচ্চশিক্ষাঙ্গনে যে চরম পর্যদুস্থাবস্থা তৈরী হয়েছে তা সারা দেশের সব অঙ্গনে ছড়িয়ে যেতে পারে অচিরেই। সেটার ঢেউ সামলানো দায় হতে পারে।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top