একুশের দরদ শুধু একমাসে সীমাবদ্ধ চাই না
প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
ফিবছর ফেব্রুয়ারী মাস এলেই বাংলাভাষার ওপর নানা চিন্তাভাবনা শুরু হয়ে যায়। বিভিন্ন সেমিনার, বইমেলা, আলোচনা সভায় বাংলাভাষার ভাল-মন্দের ওপর ব্যবচ্ছেদ চলে। অনেকের একুশের প্রতি দরদের মাত্রা যেন উথলে উঠে। তাঁরা বাংলা ভাষার ওপর নানা পরামর্শ ও প্রতিশ্রুতি দেন। কেউ কেউ সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দ্রুত তাগিদও দেন। তবে ফেব্রূয়ারী মাসটি শেষ হলেই যেন সবাই সবকিছু বেমালুম ভুলে যেতে বসেন। এভাবে প্রতিবছর একুশের প্রতি দরদ-তাগিদ শুধু একমাসে মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা যায়। এ অবস্থাদৃষ্টে অনেকে এটাকে বাংলাভাষার প্রতি প্রতারণা ও অমর্যাদাকর বিষয় বলে মনে করেন।
কারণ, আমরা অনেকে দায়িত্বশীল পদে থেকে নানা প্রতিশ্রুতির কথা জনসম্মুখে বলে ফেললেও কার্যত: সেগুলো বাস্তবায়ন করতে অনীহা ও অপারগতা দেখাই। ফলে ইতিবাচক কোন নীতিমালা অদ্যাবধি গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এর প্রভাব আমাদের প্রিয় মাতৃভাষাকে ব্যবহারিক দিক দিয়ে ভীষণ নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। আমরা এর প্রতিকার করার উপায় খুঁজে পাচ্ছি না বরং উল্টো এই নাজুক অবস্থাকে লাইসেন্স ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে লালন করছি।
সেদিন পার্কে এক বিদেশিনীকে চমৎকারভাবে বাংলাভাষায় কথা বলতে দেখে কিছুটা আবেগাপ্লুত স্বরে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- তাঁর দেশ কোথায়? কীভাবে বাংলাভাষা শিখলেন? তিনি জানালেন, ‘আমেরিকা। পরিবারের কাছে বাংলা শিখেছি।’
বাংলাভাষার ভবিষ্যৎ কেমন? জানতে চাইলে তিনি উত্তরে যা বললেন তা শুনে আমি কিছুটা বিব্রত হলাম। তিনি শোনলেন- আপনারা কথা বলার সময় ইংরেজী-বাংলা মিশিয়ে কথা বলেন। তাতে বিদেশীদের সহজে বোঝার উপায় নেই যে আপনি আসলে কোন ভাষায় কথা বলছেন।
ধরুন আপনি একটি সেমিনারে বক্তার উত্তরে বললেন-‘আপনার কমেন্টস্ গুলোক স্ট্রংলি সাপোর্ট করছি।’ এই বাক্যে তিনটি বাংলা ও তিনটি ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করলেন। এতে বোঝা গেল না -এটা আসলে কোন ভাষা ! এভাবে এফ.এম রেডিও, টিভি- সবখানেই মিশ্রভাষা ব্যবহার করা হয়। যেটা বাংলাভাষার নিজস্ব ব্যবহার বিধি ও মর্যাদাকে নষ্ট করছে। বিদেশিনীকে যুক্তি দিয়ে আমাদের ভাষার দুর্বল ব্যবহারবিধি চিহ্নিত করতে দেখে লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে গেল। বাংলাভাষায় এভাবে মিশ্রণ করতে গিয়ে ইংরেজি শব্দগুলোকেও আমরা বিকৃতভাবে উচ্চারণ করে থাকি। সেটাও বিদেশীদের জন্য বোঝা মুষ্কিল হয়ে দাঁড়ায়।
অবাধ ইন্টারনেটের যুগে ভিনদেশী কৃষ্টি-সংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদেরকে বাংলাভাষার নিজস্ব ব্যবহার বিধি ও স্বকীয়তা থেকে অনেক দুরে ঠেলে দিয়েছে। বাচ্চারা হিন্দি কার্টুন দেখে হিন্দিতে কথা বলছে।
সেদিন এক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে বিদেশীদের উপস্থিতিতে একজন বলতে লাগলেন- এটা ভাষার মাস তাই বাংলায় কথা বলতে হচ্ছে। বিদেশীদের উপস্থিতিতে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে এগুলো বলাটা আমার কাছে মনে হলো ন্যাকামী। এখানে তিনি তাঁর দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন। ফেফ্রুয়ারী মাস বলে এভাবে বাংলাভাষাকে মর্যাাদা দেয়াটা ভাল দেখায় না। একজন তো মন্তব্য করেই বসলেন- ‘বাকী ১১ মাস কোন তাগিদ নেই আর একমাসের জন্য দরদ উথ্লে উঠলো?’
একুশের সেমিনারে বাঙলাভাষার প্রতি দরদ দেখাই, ইংরেজির তুলোধুনো করি, আর সেমিনার শেষে বাসায় ফিরেই ড্যাডি, মাম্মি, গুড মর্নিং বলার চর্চা করি। এই আমাদের মাতৃভাষার প্রতি দরদের নমুনা।
এদিকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করার জন্য বায়না ধরি। অপরকে পরামর্শ দিই। এটাও মাতৃভাষার প্রতি কপটতা করার শামিল।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কৃত্রিম মেধা ও বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ইংরেজি ও অঙ্ককে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেলেও ডিজিটাল মানদন্ডে মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকে এখনও বেশী দূর এগিয়ে নিতে পারিনি। এখনও বাংলায় কেউ ই-মেইল করতে আগ্রহ দেখায় না। মোবাইল ফোনের মেসেজটাও বাংলা হরফে না লিখে ইংরেজি হরফে লিখে থাকে।
এছাড়া বাংলাভাষায় প্লেজারিজম পরীক্ষা করার মত এন্টি-প্লেজারিজম সফট্ওয়্যার এখনও তৈরী হয়নি বিধায় বাংলা পান্ডুলিাপি ও বাংলায়কৃত গবেষণা রিপোর্টের ওপর একাডেমিক নকল ও চৌর্যবৃত্তি ধরার বা পরীক্ষা করার ক্ষেত্র তৈরী হয়নি। যুগের প্রয়োজনে এটা তৈরীতে মনোনিবেশ করা জরুরী।
বাংলা একােিডমির অধীনে সেই ১৯৫৫ সালে অনুবাদ শাখা খোলা হলেও এখনও বলা হয় বরাদ্দ কম। আমরা জানি অনুবাদ হলো একটি দেশের গোপন দূত। অনূদিত বই-পুস্তকের মাধ্যমে আমরা বিদেশকে জানতে পারি, বিদেশ আমাদেরকে চিনতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনূদিত বই দিয়ে নোবেল পুরস্কার মনোনয়ন দেয়া হয়ে থাকে। অথচ এখনও আমারা নিজেদের মধ্যে ইংরেজি প্রীতি পুষে চলি। আমরা এটাও জানি যে, যিনি তাঁর মাতৃভাষায় ভাল দখল রাখেন তিনি সহজেই যে কোন বিদেশী ভাষাকেও আয়ত্বে নিতে পারঙ্গম।
তাই এখন সময়ের দাবী- বাংলাভাষার বিৃকত উচ্চারণ বন্ধ করুন। এফএম রেডিও-র নামে বিৃকত বাংলা উচ্চারণ বলে আমাদের মাতৃভাষাকে আর অমর্যাদা করবেন না। টিভি, কনসার্ট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুদ্ধ ও নির্ভুল বাংলা ব্যবহার করুন। মিশ্র বাংলা পরিহার করুন। তা না হলে বিদেশীরা আমাদের বিকৃত কথা শুনে উপহাস করতেই থাকবে।
বৃটেনে দ্বিতীয় সর্বচ্চো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী এখন বাংলাভাষী। জাতিসংঘ বাংলাভাষাকে অনেক আগেই মর্যাদার আসনে বসিয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে বিশ্ব দরবারে বিশেষ আলোয় অলংকৃত করেছে। এখনও আমাদের দেশে বাংলায় অনুদিত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাঠ্যবই নেই। আমাদের শিক্ষা, গবেষণা, উন্নয়ন সবকিছুর বৈশ্বিক পরিচিতি ও স্বীকৃতি আদায়ে বিদেশী ভাষার বই-জার্নাল বাংলাভাষায় বেশী বেশী অনুবাদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়া জরুরী।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
সাম্প্রতিক মন্তব্য