logo
news image

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি-সম্বলহীনকে স্বাবলম্বী করুন

-প্রফেসর ড. মোঃ ফখরুল ইসলাম
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি কী এবং কার জন্য ?
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী (social safety net) হলো এমন একটি নিরাপদ বেড়াজাল যার মাধ্যমে সমাজের অসহায় ও পিছিয়ে পড়া মানুষকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়। এটা কোন দেশের সার্বিক সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা (social security system) বা কর্মসূচির একটা অংশমাত্র। দেশে দেশে নিজ জনগণের প্রয়োজন অনুসারে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়ে থকে।
সামাজিক নিরাপত্তা হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যা বিভিন্ন কর্মসূচী এবং আইনগত উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজের মানুষের মধ্যে পরস্পর সহবাস্থান এবং সম্পৃতির একটি সুষম পরিবেশ তৈরী করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক ও সামাজিক দুর্যোগের ফলে মানুষের মধ্যে সংঘটিত অনাকাঙ্খিত অবস্থা মোকাবেলা, বিভিন্ন আইনি সহায়তা এবং অসুস্থতা, বেকারত্ব, শিল্প দুর্ঘটনা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় সহায়তা করা।
সামাজিক নিরাপত্তা আধুনিক কল্যানরাষ্ট্রের সামাজিক নীতির অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ। যদিও এর প্রেক্ষাপট অতি পুরোনো। সামাজিক নিরাপত্তা আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অপরিহার্য কার্যক্রম হলেও প্রাচীন আমলে এর প্রচলন ছিল। বর্তমানের ন্যায় এ কর্মসূচি সুসংগঠিত না হলেও দানশীলতা, মানবতাবোধ ও ধর্মীয় অনুপ্রেরনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সরকারী ও বেসরকারীভাবে এ কর্মসূচি গ্রহণের উদ্যেগ দেখা যায়। প্রাচীন মিশর, গ্রীস, রোম, চীন, ভারতে এর দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়। বিশ্ব মানবতার মহান মুক্তিদূত হযরত মুহাম্মদ (সা:) ৬২২ সালে স্বাধীনতা, সাম্য ও ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে যে কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন খোলাফায়ে রাশেদীনের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তার সুপথ প্রদর্শিত হয়ে দীর্ঘদিন মানব কল্যাণে ভ’মিকা রেখে চলেছে। জননিরাপত্তার অধীনে রাজস্ব আয়ের উদ্বৃত্ত অর্থ পুনর্বন্টনের ব্যবস্থায় আদমশুমারী করে অসহায় মানুষ ছাড়াও কর্মচারী, মুজাহিদ এমনকি সদ্যজাত সন্তানও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে স্থান পেত। শিল্পবিপ্লবের পরে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার চহিদা বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায় এর বেষ্টনীও বেড়ে গেছে। ইংল্যান্ডে দরিদ্র জনগণের সহায়তার জন্য ১৫৩১ ও ১৬০১ সালে দরিদ্র আইন তৈরী হয়েছে। জার্মানীর চ্যান্সেলর অটো ভন বিসমার্ক ১৮৮৩ সালে সামাজিক নিরাপত্তা ভাবেন এবং ১৯১৭ সালে বলশেভিক তথা রুশ বিপ্লবের পর সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে নতুন ভাবনা দেখা যায়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রান্কলিন ডি. রুজভেল্ট ১৯৩৫  সালে সামাজিক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেন। এছাড়া ১৯৪২ সালে যুক্তরাজ্যে লর্ড উইলিয়াম বিভারেজ কর্তৃক প্রণীত রিপোর্টের ভিত্তিতে সামাজিক নিরাপত্তা আইন ও কর্মসূচি তৈরী হয়। তার বর্ণনায় সামাজিক নিরাপত্তা হচ্ছে-“ A job when you can earn and an income when you cannot.” বর্তমান বিশ্বে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বিভিন্ন বীমা ও সাহায্যভাতার প্রচলন দেখা যায়। অসুস্থতা, বেকারত্ব, দুর্ঘটনা, অক্ষমতা ইত্যাদির জন্য সামাজিক বীমা এবং মাতৃত্ব, সিনিয়র সিটিজেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির জন্য আপদকালীন সামাজিক সাহায্য দেয়া হয়ে থাকে।
বালাদেশের সংবিধানে সামাজিক নিরাপত্তা মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই সংবিধানে (পঞ্চদশ সংশোধন ২০১১ অনুচ্ছেদ ১৫ (ঘ) মৌলিক প্রয়োজন ব্যবস্থা) সামাজিক নিরাপত্তার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে- “সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্বাতীত কারণে অভাবগ্রস্থতার ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্যলাভের অধিকার।”
মৌল মানবিক চাহিদা যাদের অপূরিত থাকে, যারা বিপর্যয় রোধ করতে পারে না, অর্থাৎ দরিদ্র, বেকার, অসুস্থ, প্রতিবন্ধী, বিধবা, এতিম, পঙ্গু সৈনিক, ভিক্ষুক, ভবঘুরে, নির্ভৃরশীল বয়স্ক ও পরিত্যক্ত মহিলা ও শিশুরা এই নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় পড়বে। এদরকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী (categorically) ভাগ করে যারা কর্মক্ষম তাদেরকে সাধ্যানুযায়ী কাজ দেয়া এবং যারা কাজ করতে জানে না তাদেরকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেয়া ও যারা কাজ করতে অক্ষম তাদেরকে আর্থিক অথবা বিভিন্ন বস্তুুগত সাহায্য প্রদান করা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন দারিদ্র্য নিরসনে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি কোন স্থায়ী সমাধান নয়, স্বল্প সময়ের জন্য এ কর্মসূচি চালু থাকতে পারে। কিন্তুু বাংলাদেশের মত ক্ষুদ্র একটি দেশে যেখানে দু’কোটি মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে অর্ন্তভ’ক্ত সেখানে তাদের সমস্যার জন্য স্থায়ী সমাধানচিন্তা না করলে এই সাহায্যপ্রার্থীদের হাতের সংখ্যা দিন দিন আরও বৃদ্ধি পেতে থাকবে আর আমরা বর্তমান শতাব্দীভর দরিদ্রই থেকে যাব বৈকি।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির দু’টো মূল দিক থাকা উচিত
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির দু’টো মূল দিকের মধ্যে একটি হলো সামাজিক বীমা (social insurance) ও অন্যটি সামাজিক সাহায্য (social assistance) ব্যবস্থা। বাংলাদেশে অসহায় দরিদ্র মানুষের জন্য দ্বিতীয়টি চালু থাকলেও প্রথমটি শুধুমাত্র অবসরপ্রাপ্ত সরকারী চাকুরীজীবিরা পেয়ে থাকেন। কোন কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানেও বর্তমানে এর প্রচলন দেখা যায়। তবে তাতে একবারে দরিদ্র (absolute poverty stricken) অসহায় মানুষর জন্য কোন সুখবর নেই। সামাজিক বীমার (social insurance)  অধীনে নাগরিক অধিকার যেমন- বেকার ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, দুর্ঘটনা ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, বাসস্থান ভাতা, ইত্যাদি অন্তভর্’ক্ত হ’তে পারে। কারণ সামাজিক বীমার মধ্যে কোনকিছুর প্র্রাপ্তি সাংবিধানিক অধিকার বর্তায়। সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় রয়েছেন মোট দাবীদারের মাত্র ২৫ ভাগ মানুষ। ও.এম.এস., ভি.জি.ডি. ইত্যাদির মাধ্যমে যেটা প্রচলিত রয়েছে তা বিচ্ছিন্ন ও সাময়িক। এগুলো সামাজিক নিরাপত্তার সংজ্ঞার আওতায় পড়ে না। এছাড়া বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির মধ্যে বাস্তবায়িত নির্মাণ কাজগুলোতে মেয়াদ বীমার (warranty insurance) প্রচলন রাখতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- একটি সাইক্লোন শেল্টার বা কালভার্ট কোন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তৈরী করলো তা যদি ২০ বছর বা নির্দিষ্ট মেয়াদ না পেরুতেই ধ্বসে যায় তাহলে সেটার পুন:নির্মাণ বা ক্ষতিপূরণ সেই প্রতিষ্ঠানকেই বহন করতে হবে। দেশে এখন অনেক নতুন আইন প্রণীত হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির সুষ্ঠু জবাবদিহিতা নিশ্চিত তথা দেশের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য এ ধরনের আইন প্রণয়ন করা জরুরী।
এছাড়া সরকারী বা বেসরকারীভাবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিতে আরও একটি বিষয় আসে। তা হলো সমাজসেবা (social service)। সমাজসেবার উদ্দেশ্য হ’লো প্রাথমিক ও প্রত্যক্ষভাবে মানবসম্পদ সংরক্ষণ এবং অনাচার ও অযাচিত অবস্থা প্রতিরোধ করে সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো। সমাজের বিত্তশালী, দানশীল, হিতাকাংখী ব্যক্তি অথবা সরকারীভাবে এতদ্বসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠিত সমাজসেবা ইউনিট (social service unit) এসব কাজ করতে পারে।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি প্রকৃত গরীবের নিরাপদ বাজেট বরাদ্দ হওয়া উচিত
সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য রোধে সামাজিক নিরাপত্তা খাত অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রেখে থাকে। এখানে এ খাতগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অতীত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, “চলতি বাজেটের (২০১১-১২) অন্তত: সাতটি প্রকল্পে ২০১২-২০১৩ অর্থবছরের বাজেটে কোন বরাদ্দ রাখা হয়নি এবং ৪৩টি কর্মসূচিতে চলতি বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ কমানো হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পসমূহে ১৬ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা মোট বাজেটের ৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
এদেশে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে যোগ্য সুবিধাভোগীর সংখ্যা ২ কোটি। এর ৭৫ ভাগ মানুষ এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বলাই বাহুল্য, টাউট, বাটপার তো আছেই। বাংলাদেশে সরকারী ও বেসরকারী উন্নয়ন কর্মসূচির অতিমিশ্রণ (overlapping) সারা পৃথিবীতে দাতা গোষ্ঠী ও গবেষকদের কাছে একটি মুখরোচক ব্যাপার।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী: যে দেশে বেড়ায় ধান খায়
এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো মাঝপথে এসে থেমে যায়। বরাদ্দকৃত বাজেট সময়মত ছাড় পায় না, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বাজেটে ঘাটতি পড়ে যায়। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা কৃত্রিম বাধার সন্মুখীন হয়। এসকল বাধার পাহাড় ডিঙ্গাতে নিরাপত্তা বেষ্টনীর বেড়া, খুঁটিগুলো দুর্নীতির জাল পাতে। এমনকি সামান্য বয়স্কভাতা পেতে ৮০ বছরের বৃদ্ধাকে ইউ.পি. সদস্যের নিকট ঘুষের জন্য নাজেহাল হওয়ার কথা শোনা গেছে। একজন সৎ ইউ.পি. চেয়ারম্যানের বয়স কম কিন্তুু তার উচ্চ রক্তচাপ (hypertension)। এর কারণ জানতে চাইলে তার উত্তর হলো- অফিসের বড় স্যার যেদিন তার কাছে কমিশন চেয়েছেন সেদিন থেকে তার এ সমস্যা শুরু হয়েছে। কারণ তিনি তাঁকে দেবতার মত শ্রদ্ধা করতেন, এখন ঘৃণায় তার অফিসের পা মাড়ান না। এসকল নানামুখী কৃত্রিম বাধার কারণে বরাদ্দকৃত অর্থের সামান্যই যোগ্য সুবিধাভোগীর হাতে পৌঁছায়।
ও.এম.এস. দিয়ে দারিদ্র জিইয়ে রাখা যায়- নিরসন ধারণা বাতুলতা মাত্র
২০১২-২০১৩, ২০১৩-২০১৪ থেকে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ কমানোর পাশাপাশি উপকারভোগীর সংখ্যাও কমানো হয়েছে। দেশে ফিবছর বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা, নদীভাঙ্গন, নিপিড়ন, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক হানাহানি, প্রতিহিংসা ইত্যাদির কারণেও বহু মানুষ দৈহিক, সামাজিক অথবা মানসিকভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করে অসহায় ও ভিক্ষুকে পরিণত হয়। আগেই বলেছি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির দু’টো মূল দিক থাকা উচিত। একটা সামাজিক বীমা ও অন্যটি সামাজিক সাহায্য ব্যবস্থা। বাংলাদেশে প্রতিটি বাজেটেই সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বড় অংকের বরাদ্দ থাকে। নিরাপত্তা বেষ্টনীর নামে সামাজিক সাহায্য দেয়া হয। সামাজিক বীমা বিষয়টি উপেক্ষিত হওয়ায় দরিদ্র মানুষগুলো সামাজিক সাহায্য নিয়ে সবটুকু খেয়ে ফেলে। তাই সামাজিক সাহায্য থেকে নির্দিষ্ট অংশ সামাজিক বীমার আওতায় এনে একটি পরিপূর্ণ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কথা আগামী বাজেটে চিন্তায় আনতে হবে। এজন্য পেশাদারী সমাজকর্ম বিষয়ের জ্ঞান প্রয়োগ প্রয়োজন। কারণ আমরা চল্লিশ বছর ধরে এ বিষয়টিতে অপেশাদার পরিকল্পকগণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আরও দরিদ্র হচ্ছি। এতে করে সুবিধাভোগীরা স্বাবলম্বী হওয়ার পরিবর্তে সুবিধাপ্রদানকারীরা অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির-যথার্থ জবাবদিহিতা নেই
দেখা যায় নদী ভাঙ্গন বা বন্যা শুরু হলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। তখন তড়িঘড়ি করে দিনে রাতে বালির বস্তা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়। মন্ত্রী থেকে কর্মচারী সবার ঘুম হারাম হয়ে যায়। কিন্তু যে কাজটি শুষ্ক মৌসুমে সময় নিয়ে যথাযথভাবে সম্পন্ন করা যেত অদৃশ্য কারণে তখন সেটা করা হয় না। সরকারী জরুরী নির্মাণ কাজে অবহেলা করে ব্যয় বাড়ানোর প্রবণতা এখন মামুলী ব্যাপার। এ ধরনের অবহেলিত বাস্তবতা চলতে থাকলে বাংলাদেশের দরিদ্রাবস্থা  যুগ যুগ ধরে বিশ্ববাসী খোলা জায়গায় দেখতেই থাকবে জাদুঘরে রাখা হবে না।
তাঁরা একবার বাঁধ বেধেছে, ভাঙ্গেনি; আমরা ফিবছর বাধি, টেকেনা
প্রতিবছর নদী তীরবর্তী মানুষজন এক কূলে ভাঙ্গনের শিকার হয়ে অন্যকূলে জেগে ওঠা চরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কিন্তুু এটা চরম সত্যি যে, চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পূর্বে ফিলিপিনস, বালি, পাতোয়া, ওকিনাওয়া প্রভৃতি দ্বীপে সমুদ্রপাড় বিদেশী সাহায্য-সহযোগিতা ও নিজ প্রচেষ্টার সমন্বয়ে বাধা হয়েছিল। এখনও সেসকল বাঁধ সুউচ্চ সামুদ্রিক ঝড় প্রতিরোধ করছে। আমরাও বিদেশী সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে বহু অর্থ খরচ করে তিস্তা, ব্রক্ষ্মপুত্রপাড়ে এবং সমুদ্র উপকূলে মাটির বাঁধ নির্মাণ করেছিলাম। সেগুলো শুধুই ভেঙ্গে যায়, বন্যা-ঝড় প্রতিরোধ করে না। গলদটা কোথায়? আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বৈঠকে আমাদের কটুক্তি শুনতে হয়- তাঁরা একবার বাঁধ বেধেছে, ভাঙ্গেনি; বাংলাদেশ ফিবছর বাধে, টেকেনা! তখন মনে হয় আমরা অদক্ষ অথবা খারাপ মানুষ। এ বিষয়টি এতদ্বসংশ্লিষ্ট সবার মনোযোগ দিয়ে ভেবে দেখা উচিত।
নদী তীরবর্তী মানুষ, চরাঞ্চলের জনগোষ্ঠী এবং  এদের ভাগ্যউন্নয়নে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির অধীনে ২০১৯-২০২০ বাজেটে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার যথার্থ ব্যবহার হয়ে অসহায় মানুষগুলো ভালভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা খুঁজে পাক এটা এতদ্বসংশ্লিষ্ট সবাইকে কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করে দেখাতে হবে। এ মানুষগুলো যেন আমাদের কাছে বার বার হাত না পাতে আর আমরাও যেন বিদেশী প্রভুদের কাছে বার বার ধর্ণা না দিই।
যেসকল মানুষের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা নেই, তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। এদের সংখ্যা অনেক। তাই মানবিক করণে হলেও এ খাতে বরাদ্দ কমানো যাবে না, বরং বাড়াতে হবে। দারিদ্র বিমোচন কৌশলপত্রে (পি.আর.এস.পি.) ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের দারিদ্রের হার অর্ধেকে নামিয়ে আনা সহ জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছিল। এজন্য সমর্থনমূলক কৌশল হিসেবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী পি.আর.এস.পি.-এর অনেকাংশ জুড়ে ছিল। নিরাপত্তা বেষ্টনীতে নগদ অর্থপ্রদান, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বকর্মসংস্থানে ক্ষুদ্র ঋণ, বিধাবা ও স্বামী পরিত্যাক্তাদের ভাতা, অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী, প্রভৃতির উল্লেখ ছিল। পি.আর.এস.পি. বাস্তবায়ন হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এমডিজি, এসডিজি-র কাজ চললেও এখনও শহরমুখী নদীভাঙ্গা ও গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের ঢল কমেনি। এজন্য সামনে আর সামান্য সময় বাকী। এজন্য জরুরী বিষয় হলো বরাদ্দকৃত অর্থ যেন এই ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর (vulnerable group) সঠিকভাবে পায় তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ২০১২-২০১৩ বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে এই যুক্তিতে যে এখানে খুব বেশী দুর্নীতি হয়। ২০১৯-২০২০ সালে কিছুটা গুরুত্ব দেয়া হলেও রাজনৈতিক বা দলকানা নীতির মধ্যে এটাকে আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। ফলে টাউট-বাটপারেরা এক কব্জা করে নিয়ে স্বার্থ হাসিল করছে। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে এর জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দলীয় ও স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব থেকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে মুক্ত রাখতে হবে। কারণ অসহায় মানুষকে সরকারী সাহায্য দিয়ে নির্বাচনে ভোট প্রার্থনা করার মত হীন রাজনৈতিক চিন্তা বাংলাদেশের দারিদ্র্যকে দীর্ঘায়ূ দানের অন্যতম প্রধান কারণ। সেটা না করে বরং সম্বলহীন, অসহায় মানুষকে স্বাবলম্বী করুন।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top