logo
news image

গ্রামে শুধু শুধু স্কুল বন্ধ

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
সতের মাস পর হঠাৎ সেদিন গ্রামের বাড়িতে যাবার সুযোগ হলো। আপনজনদের সাথে সাক্ষাৎ করার সাথে গ্রামের অনেক শিশু-কিশোর, যুবক শিক্ষার্থীদের সাথেও দেখা হলো। সেই সুবাদে ওদের পড়াশুনা ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে নানা কথা জানতে পেলাম। কৌতুহলবশত: আমাদের গ্রামের বর্তমান শিক্ষা পরিস্থিতির সাথে দেশের বিভিন্ন এলাকার  গ্রামের অবস্থা কেমন তা সেলফোন ও এন্তারজাল পদ্ধতিতে কিছুটা জানার চেষ্টা করলাম।
গ্রামের শিশুরা কেউ গৃহবন্দী নয় শুধু শুধু ওদের স্কুল বন্ধ করে রাখা হয়েছে। করোনাকালে ওদের ওপর কোনরকম বিধিনিষেধও কার্যকরী নেই। সারাদিন ঘরের বাইরে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ মাছ ধরছে, কেউ কৃষিকাজ করছে। অতি দরিদ্র ঘরের কোন কোন শিশুরা ধানের শীষ কুড়াচ্ছে, ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে গোলার ধান সংগ্রহ করছে, শীতের দিনে আগুন তাপানোর জন্য পরিত্যক্ত আমন ধানের শুকনো নাড়া কেটে বাড়িতে পিল দিয়ে রাখছে। আমনের মাঠে ইঁদুরের গর্তে ধানের গোলা পেলে একসংগে অনেক ধান খুঁজে পাওয়া যায়। সেটা দিয়ে শীত নিবারণের গরম কাপড় কেনে অনেকে। কেউ আবার ফেরিওয়ালার নিকট থেকে তিলের খাজা, কটকটি ও হাওয়াই মিঠাই কিনে খায়। নিজেদের পরিবারের কাজ থেকে একটু ফুরসৎ পেলেই ওরা দলবেঁধে খেলছে ঠুস, দাঁড়িয়াবান্ধা অথবা গোল্লাছুট। কেউ বাইসাইকেলে, কেউ অভিভাবকের অটোরিকসায় উঠে হাটের দিনে সাহায্য করতে গভীর রাত পর্যন্ত জনসমুদ্রে থেকে বাড়িতে ফিরছে। করোনার আগে হাটবারের দুইদিন কেউ কেউ স্কুলে যেত না। এখন সারা সপ্তাহেই ছুটি, স্কুলে যেতে হয়না বলে বাবা বেজায় খুশী। গ্রামের সচ্ছল পরিবারের শিশুরাও তাদের জীবনের মূল্যবান সময়কে অবহেলায় অপচয় করে দিন কাটাচ্ছে। কেউ দলবেঁধে রাতভর মাইক বাজিয়ে বিলের মাঝে পিকনিক্ করছে, মাজারে গান করছে, কেউবা আত্মীয় বাড়ির নামে নিকটস্থ শহর-বন্দরে গিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক। অথচ আগে দিনের বেলা স্কুল থাকায় যেতে পারতো না।
কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর, চিলমারীর জোড়গাছ, লালমনিরহাট সদরের সিন্দুরমতি, কুর্শামারী, হাতিবান্ধার গড্ডিমারী, নীলফামারীর জলঢাকার বালাগ্রাম, ডিমলার খগা খড়িবাড়ী, সিলেটের জৈন্তাপুরের মানিকপাড়া, বরগুনার আমতলীর কুকুয়া- কোথাও শিশুরা ঘরে বসে নেই। করোনাকালে কখনই তারা ঘরবন্দী হয়ে থাকেনি। তাদের গ্রামে করোনা রোগ নেই। অনেকে এই রোগের নাম শুনেছে বহু আগে। তখন মনে মনে ভয় করতো। এখন কেউ সেটা নিয়ে ভয়-ডর করে না।
প্রায় এক বছর ধরে স্কুলগুলো বন্ধ। দেশে সরকারী প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা প্রায় ৬৪ হাজার। বেসরকারী স্কুল ১৭ হাজার। কলেজ প্রায় দু’হাজার পাঁচশত। এগুলোতে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক, প্রায় পাঁচকোটি শিক্ষার্থী এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করে। করোনার প্রভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় এদের অনেকে লেখাপড়া ভুলে যেতে বসেছে এবং জীবিকার তাগিদে ভিন্নকাজে জড়িয়ে পড়ায় ঝরে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
এদের সবার বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। পড়াশুনা ওদের জন্য খুব সহজ ব্যাপার নয়। অনেকে সূর্য ডুবলে ঘুমায়, উঠলে জেগে উঠে। অভিভাবকদের কর্মহীনতায় দৈনন্দিন আয় কমে যাওয়ায় বহু দিনমজুর পরিবারের শিশুরা করোনাকালীণ সময়ে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। অপুষ্টিতে ভুগে ওরা লড়াই করছে জীবনের সাথে। অনেকে আগে স্কুলে গেলে খাবার পেত এখন সেটাও বন্ধ। স্কুল যাবার তাগিদ না থাকায় এবং শীত শুরু হবার পর অনেক অবহেলিত পরিবারের শিশুরা নিয়মিত গোসলও করে না বলে জানা গেছে।
ওদের অনেকের মোবাইল ফোন আছে তবে স্মার্ট ফোনসেট নেই। ওদের শিশুরা অনলাইন ক্লাশের সাথে পরিচিত নয়। কলেজ, বিশ^বিদ্যালয় পড়ুয়া রয়েছে কিছু কিছু পরিবারে। তারা কিছুদিন পর পর অভিভাবকদের নিকট থেকে টাকা চায়- মেগা না কি যেন কিনবে বলে। অনেক অভিভাবক এ নিয়ে বিস্মিত। ওদের এত টাকা লাগে কেন? ফসল বেচে এতটাকা দিতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে না খেয়ে মরতে হবে বলে বলেছেন কোন কোন অভিভাবক।
এদিকে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাশ শুরুর দিকে নানা সাহায্য সহযোগিতার কথা বলা হলেও গ্রামের কোন শিক্ষার্থীই সেধরনের সাহায্য না পেয়ে তাদের হতাশার কথা ব্যক্ত করেছে। অনলাইন ক্লাশ শুরুর দিকে তাদের অনেক আগ্রহ থাকলেও এখন গ্রামাঞ্চলের শতকরা ১৫ জন শিক্ষার্থীকেও উপস্থিত রাখা যাচ্ছে না। তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত সুবিধা দুটোই হ্রাস পেয়েছে। ফলে তারা অনেকে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব হতাশ।
অনেকে আবার আধুনিক প্রযক্তি ব্যবহার করে ভিনদেশী অপসংস্কৃতি ও অনাচারে আসক্ত হয়ে বিপদজনক পরিণতির মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। এমন কিছু অভিযোগ করেছে তাদের বন্ধু ও আপনজনেরা।
করোনার প্রভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় বাড়ন্ত মেয়ে শিশুদের বেশী বিড়ম্বনা তৈরী হয়েছে। স্কুলগামী বাড়ন্ত মেয়েরা বাড়িতে অলস সময় পার করায় করোনার প্রভাবে সামাজিক কুসংস্কারের শিকার হয়ে গোপনে বাল্য বিবাহ বেড়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ থাকায় ওদের জীবনের নিয়ম শৃংখলা ভেঙ্গে গেছে। সহপাঠীদের অনেকের নানা পারিবারিক সমস্যার সাথে নিজেদেরও বিয়ে হয়ে যেতে পারে এ আশঙ্কায় অজানা চিন্তায় ভূগছে অনেকে।
দেশে সবকিছু খোলা। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ কেন? এমন প্রশ্নের উত্তর দেয়া খুব কঠিন মনে হলেও গ্রামের মানুষ বলছেন- করোনা আমাদের অসুখ নয়। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। আমাদের সারাদিন কাটে রোদে, জলে, ঘামে ভিজে। আমরা ঘুমাই ভাঙ্গা বেড়ার ঘরে। প্রতিদিন আমরা কাশি দিই, হুক্কা খাই। সকাল হলেই কাজে যাই। রাতে নাক ডেকে ঘুমাই। যারা পায়রার খুপড়ির মত বন্ধ দালান ঘরে ঘুমায়, জানালাবন্ধ গাড়িতে চড়ে আর গায়ের ঘাম বের করে না ওইগুলো সেইসব বড়লোকদের অসুখ! আমাদের গ্রামে কতজনের জ¦র-কাশি হলো। ওইসব অসুখে এখনও কেউ মরেছে বলে শুনিনি। সবাই সব জায়গায় যাচ্ছি, সবকিছু করছি শুধু শুধু স্কুল কলেজ বন্ধ। খালি খালি গ্রামের ছাওয়ালদের স্কুল বন্ধ করে ভবিষ্যৎ জীবনটা নষ্ট করে ফেলছে।
আসলেই আমরা আমাদের গ্রামগুলোর সাথে রাজধানী অথবা বড় বড় শহরের পার্থক্যকে অস্বীকার করে চলেছি। প্রতিদিন করোনার আপডেট তথ্য শুধু শহরের ১১৭টি করোনা চিহ্নিতকরণ কেন্দ্র কেন্দ্রিক। সেখানে গ্রাম থেকে আগত কতজন রোগী এলো-গেল তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। শহরের শিশুরা ঘরে বসে অনলাইনে পড়াশুনা করছে। গ্রামের শিশুরা অনলাইন কি তা শুনলেও তাতে তাদের একসেস্ নেই। তারা বাড়িতেও পড়ার সুযোগ পাচ্ছেনা – শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়াও বন্ধ। তাই শিক্ষা সুযোগ হারিয়ে অন্ধকারে দিন গুজরান করৃছে। সুস্থ-সুন্দর পরিবেশে সম্ভাবনাময় কোটি কোটি গ্রামীণ শিশু-কিশোরকে অজ্ঞানতার গহীন আধাঁরে ঠেলে দিয়েছি আমরা। গ্রামের করোনা সংক্রমণহীন পরিবেশে ঘরের বাইরে ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়ানো মাটির সন্তানেরা পড়ালেখা ভুলে শুধু কি অজ্ঞ, অশিক্ষিত হয়েই থাকবে?
রাজধানী তথা শহরে বসে মৃত্যুভয়কে সামনে রেখে নিজেদের শিশুদেরকে আধুনিক প্রযুক্তি সুবিধা দিয়ে পাঠদান করাচ্ছি, অথচ গ্রামে করোনার প্রকোপ না থাকা সত্ত্বেও শিশুদেরকে জুজুবুড়ির ভয় দেখিয়ে পড়ালেখার সুবিধাবঞ্চিত রেখে এ কোন অসম উন্নয়ন ঘটাচ্ছি আমরা? শিক্ষায় শহর ও গ্রামের মধ্যে এহেন আঞ্চলিক বৈষম্য ও বৈপরীত্য আমাদের ভবিষ্যৎ পিছিয়ে পড়া গ্রামীণ প্রজন্ম কি কখনও ক্ষমা করতে পারবে?
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top