logo
news image

পোড়া বস্তির নতুন মালিক ‘বস্তির ছেলে’ কি?

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
গল্পটা আবার আমার ধীমান বন্ধুবর বলেই ফেলেছেন। তা হলো- আজকাল বস্তির রাজনৈতিক কদর নেই। বস্তিবাসীদেরকে মিছিলের জন্য আর ভাড়া করে নেয়ার দরকার হয় না। বিনা ভাড়ায় বস্তিতে কাউকে থাকতে দেয়া হয় না। বস্তির ঘরভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল আদায়ের বিশেষ কমিটির লোকজন খুব তৎপর। একটু দেরী হলেই নেমে আসে নির্যাতন। অবৈধ অর্থ ও চাঁদা উত্তোলনের জন্য নেতাদের নিযুক্ত লোকেরা টহল দেয় নিয়মিত। আগে ভোটের রাজনীতি ছিল তাই বস্তিবাসীদেরকে বেশ সমীহ করা হতো। এখন ভোট দিতে কেন্দ্রে যেতে হয় না। তাই কেউ ওদেরকে সম্মান করে কথাও বলে না।
এদিকে ভোটে হেরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন- ভোট গণনার মেশিনটাই জনগণের শত্রু। গণনা করার মেশিন মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আসলে কি তাই? মেশিন নয়, কিছু চতুর মানুষ সভ্য মানুষের অধিকার সুকৌশলে কেড়ে নিয়ে মেশিনের ওপর দায়ভার চাপিয়ে দিয়েছে। দেশে দেশে মানুষের উপর মানুষের আস্থা ও বিশ^াস কমে যাওয়ায় নিরীহ মানুষের বসতঘর পুড়িয়ে দেয়ার মত নির্মম ঘটনা ঘটাতে কুন্ঠিত হচ্ছে না একশ্রেণির স্বার্থপর মানুষ।
পৃথিবীর সব পুঁজিবাদী দেশে বস্তি রয়েছে। প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মত বিশে^র অনেক নামকরা শহরে গগণচুম্বি অট্টালিকার পাশে কাগজ-পলিথিনে মোড়ানো ঘরে বাস করে হাজার হাজার হোমলেস মানুষ। আধুনিক সভ্যতার ধজ¦াধারীদের উপহাস করার মত দরিদ্র ভাসমান মানুষ ঢাকা চট্টগ্রামেই বাস করে এমন নয়। নয়াদিল্লী, ব্যাংকক কিংবা কাঠমান্ডু ও জাকার্তায়। এছাড়া শুধু শিকাগো শহরের স্লাম ও স্কোয়ার্টার বলে নয়- টোকিওতেও কিছু হোমলেস মানুষ হঠাৎ রাস্তার পাশের্^ অস্থায়ী তাঁবুর বস্তি বানিয়ে বাস করতে চায়! পুলিশ জানতে পারলে দ্রুত এসে ওদের তাঁবু টেনে গুঁটিয়ে তাড়িয়ে দিলে ওরাও মারমুখী হয়। তবে পুলিশ ওদেরকে মারধোর করে না। তাদের অনেককে ঘরপ্রতি বিনামূল্যে সরকারী সহায়তা দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এসব অসহায় মানুষের বস্তিঘরগুলো কিছুদিন পর পর রহস্যজনক অগ্নিকান্ডে ছাই হয়ে যায়। কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির লোভ ও কুনজরে পড়ে বস্তিগুলো আগুন জ¦ালিয়ে পুড়ে দেয়া হয় বলে সংবাদে জানা গেছে।
আমাদের দেশে স্বল্প সময়ে পর পর তিনটি বস্তিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা বেশ রহস্যের জন্ম দিয়েছে। রাজধানী ঢাকার পল্লবীতে বাউনিয়াবাঁধ বস্তি পুড়ে গেছে ২১ নভেম্বর,২০২০। এছাড়া কড়াইল, ভাষানটেক, মিরপুরের সাততলা বস্তি, রূপনগর, কালশী, ঝিলপাড়, চট্টগ্রামের আযমনগর জনতার বস্তিও ক’মাস আগে আগুনে পুড়ে গেছে।
রূপনগরের চলন্তিকা ঝিলপাড়সহ আটটি বস্তি হলো টাকার খনি। ঢাকার ১৬ আসনের সাংসদ আক্ষেপ করে বলেছেন-‘বস্তিতে গ্যাস, বিদ্যুৎ নিয়ে এত বাণিজ্য হয় আমার জানা ছিল না’ (আমাদের সময়.কম, ১৪.৩.২০২০)।
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অধিগ্রহণ করা চলন্তিকা ঝিলপাড়ের বস্তিতে প্রায় ২০ একর জমিতে ১৫ হাজার ঘর ভাড়া দেয়া হয়েছে। এখানে রমরমা বাণিজ্য চলে। অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে মাসোহারার ভিত্তিতে চুক্তি করে টাকা আদায় করা হয়। আদায়কৃত এসব টাকা স্থানীয় পেশীশক্তি, নেতা ও বখাটেরা ভাগাভাগি করে নেয়। এসব বস্তির ওপর নিয়মনীতি চালু না থাকায় সরকারী নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।
এসব বস্তিতে ভাড়ার টাকার ভাগাভাগি নিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ থেকে তুমুল দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন মাস্তান চক্রের মধ্যে মারামারি ও শত্রুতার জের ধরে প্রায়শ:ই মারামারি ও অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে অবৈধ মাদক ও ঘরভাড়ার টাকার বাগবাটোয়ারা বিঘ্নিত হলেই বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। মূলত: দখল ও পাল্টা দখলের ঘটনা থেকে আগুন নিয়ে খেলা শুরু হয়ে যায়। যারা একদিন বস্তি গড়তে সহায়তা করে তাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হলেই আগুনে পুড়ে দেয়া হয় সেই বস্তি।
এছাড়া সরকারী উন্নয়নের নামে সিটি এলাকা থেকে জঞ্জাল বা অবৈধ জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করার জন্য মাস্তান বাহিনী দিয়ে আগুন সন্ত্রাস চালিয়ে ভাসমান মানুষকে বস্তি থেকে তাড়ানো হয়ে থাকে। এজন্য প্রতিবাদ করার উপায় নেই। কারণ, ওদের কাছে বস্তির জমির কোন বৈধ কাগজপত্র নেই। ঢাকা ছাড়াও গত লকডাউনের মধ্যে দিল্লীর তুঘলকাবাদের বস্তিতে হঠাৎ ১৫০০ ঘর পুড়ে যায়। এগুলোকে রহস্য বলে চালিয়ে দেয়া হলেও এছাড়া বিভিন্ন সরকারী পলিসিতে নগর উন্নয়নের নামে বিভিন্ন উপায়ে বস্তিতে আগুন লাগিয়ে অবৈধ জনগোষ্ঠীকে অন্যত্র সরাতে হীন কৌশল চালানো হয়ে থাকে।
আগুন দিয়ে একগ্রুপ অন্যগ্রুপকে বিতাড়িত করার জন্য প্রচেষ্টা চালায় বলে সংবাদে জানা গেছে। গত তিন বছরে ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে ৯৫৩টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব অগ্নিকান্ডের ঘটনা পরিকল্পিত। সাধারণত: বড় কোন ছুটির সময় বস্তিতে বেশী আগুন লাগে। বর্ষাাকাল আগুন লাগার পিক্ সিজন না হলেও আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। বড় বড় প্রভাবশালী মহল এসব কাজে জড়িত থাকায় এসব অপরাধের কোন সুরাহা হয় না। সবচেয়ে ঘৃণিত দিক হলো- এসব অগ্নিকান্ডের পর অনেক কমিটি গঠিত হয়, রিপোর্ট তৈরী হয় না। এসব অগ্নিকান্ডের সবগুলোর তদন্ত হয়নি এবং এ পর্যন্ত একটিরও অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়নি বলে সংবাদে জানা গেছে ।
বস্তি হলো শহরের অপরাধের ব্রিডিং পয়েন্ট। গ্রামের দরিদ্র নদীভাঙ্গা মানুষ সবকিছু হারিয়ে শহরে এসে আশ্রয় নেয় বস্তিতে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে তারা নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। অবৈধ মাদক ব্যবসা, পতিতাবৃত্তি, চুরি, ডাকাতি, মাস্তানী, গ্যাংবাজি, ছিনতাই ইত্যাদি ছাড়াও তারা নির্বাচনের সময় ভোটব্যাংক হিসিবে ব্যবহৃত হয়। অধূনা একাজে তাদের কদর কমে যাওয়ায় তাদের বস্তিঘরের জায়গা –জমির উপর প্রভাবশালীদের নজর পড়েছে।
তবে জ¦ালিয়ে দিলেই শহরের বস্তি সমস্যা দূর হবে না। কারণ, বস্তিঘর পুড়ে যাবার পর তারা নিজ ভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে যায়। সেই বস্তিতে তারা আর ঠাঁই খুজে পায় না। কারণ সেটা দখল হয়ে যায় পেশীশক্তির হাতে। উচ্ছেদকৃতরা  এক জায়গা থেকে আরেক সরকারী জায়গা বা রাস্তা-ঘাটের পাশে গিয়ে বসতি গেড়ে আরো নতুন সমস্যা তৈরী করে। তাই ভাসমান অসহায় মানুষদের বস্তিপোড়া সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারীভাবে পরিকল্পিত কর্মসূচির মাধ্যমে পুনর্বাসন করার দ্রুত উদ্যোগ নেয়া উচিত।
বিলাসবহুল দালান-কোঠার উন্নয়নের সাথে সাথে দেশের বড় বড় শহরগুলোতে বস্তিবাসীর সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। চারদিকে এত অসহায় গৃহহীন মানুষের বস্তিঘর গজিয়ে উঠতে থাকলে এবং সেগুলো কুচক্রী নির্দয় মানুষের আগুনে ক্রমাগত রহস্যজনকভাবে পুড়তে থাকলে সেটা অনুন্নয়নের নামান্তর।
সবাই জানে আগুন পুড়ে। হ্যাঁ, আগুনে হাত দিলে হাত ঝলসে যায় অথবা পুড়ে। সবাই এটাও জানে পানি আগুনকে নিভাতে পারে। দেশের প্রভাবশালী মহল পোড়া বস্তির হতভাগ্য মানুষদেরকে দরদী হয়ে শুধু ত্রাণ দিতে গেলে চলবে না- একটি সুষম উন্নয়নধারায় সবার জন্য কল্যাণকর সমাজ বিনির্মাণে ওদের পেটের আগুন, মনের আগুন নেভানোর জন্য সার্বিক উন্নয়নের মূল্য তাদের জন্য ব্যয় করতে এগিয়ে আসতে হবে। এসব পোড়া বস্তির নতুন মালিক বানাতে হবে সেই বস্তির মানুষকেই-কোন অনৈতিক নেতা বা নব্য-সুবিধাবাদী স্বার্থপর ‘বস্তির ছেলে’ বা তেমন মানুষকে নয়।
একাজে দায়িত্ববানরা সহজে প্রতিরোধযোগ্য এসব পরি-সামাজিক সমস্যাগুলো অবহেলা করে মহীরূহ হবার অবারিত সুযোগ দিতে থাকলে রাজধানীর বস্তিগুলো ধড়িবাজ ভূমিদস্যুদের দখলে গিয়ে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে সারা শহরে ব্যাথা ছড়াতে থাকবে চিরকাল।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top