গপ্পো
ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম
সপ্তম শ্রেণির ক্লাস পরীক্ষা। নিজ নিজ ছেলেদের পরীক্ষা হলে বসিয়ে দিয়ে লতিফা ও হালিমা নামে দু'জন ভদ্রমহিলা স্কুল মাঠের আম গাছের তলায় চেয়ারে বসে গল্প করছেন। আজই তাদের মধ্যে প্রথম পরিচয়। আশেপাশে আরো অনেকে গল্পগুজব করে সময় কাটাচ্ছেন।
হালিমা : জানেন ভাবি , যা গরম পড়েছে এসি ছাড়া থাকাই যায়না।
লতিফা ; ঠিক বলেছেন ভাবি। আপনার ভাই সাহেবকে বলে বাসার প্রতিটি রুমে এসি লাগিয়ে নিয়েছি। ঘরের ভেতর থেকে বাহির হতে মন চায়না। তা আপনার বাসায় এসি নাই কেন?
হালিমা : আর বলবেন না ভাবি। আমরা শিগগিরই একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনতে যাচ্ছি। আপনার ভাই বলেছেন, নতুন ফ্ল্যাটে সব রুমে ডবল এসি লাগাবেন। খামাখা ভাড়ার বাসায় এসি লাগিয়ে অযথা টাকার অপচয় করে লাভ কী? তাছাড়া প্রতি রুমে সিলিং এবং টেবিল ফ্যান তো রয়েছেই।
লতিফা : ভাবি দেখেন, এই শাড়িটা সুন্দর না? আপনার ভাই ভারত থেকে আনিয়েছেন। বলেছেন সামনের ঈদে আমার জন্য এক ডজন শাড়ি আনাবেন।
হালিমা : আর বলবেন না ভাবি। আপনার ভাই প্রতি মাসে বেতন পাবার পর ২টি শাড়ি কিনে এনে আমাকে গিফট করেন। এতো শাড়ি পেয়ে শাড়ির প্রতি আমার অরুচি ধরে গেছে। দেখেন না এজন্য প্যান্ট সার্ট পরে এসেছি।
লতিফা : আমিও তাই ভাবি। আপনার ভাই বলেন, প্যান্ট সার্টে আমাকে নাকি খুব সুন্দর দেখায়। একদম সিনেমার হিরোইনদের মতো। আর এই প্যান্ট সার্ট পরে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আপনার ভাই আমাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। অতঃপর আর কী। বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে।
হালিমা : আরে ভাবি, এব্যাপারে আপনার সাথে তো আমার একদম মিল রয়েছে। আপনার ভাইও আামাকে প্যান্ট সার্ট পরা অবস্থায় দেখে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে। বিয়ের পর আমাকে বলে প্যান্ট সার্ট পরলে আমাকে দেখতে নাকি তার এক প্রিয় নায়িকার মতো লাগে। এই দেখুন না আজকে তার অনুরোধে প্যান্ট সার্ট পরে এসেছি। ভাবি, দেখেন রাস্তার ওই কারটি সুন্দর না? আমার কষ্ট দেখে আপনার ভাই বলেছেন, আমার যাতায়াতের জন্য শিগগির একটি লেটেস্ট মডেলের সাদা কার কিনে দেবেন। বলেন তো ভাবি, কতকাল আর রিক্সা, অটোতে চড়া যায়। প্রেষ্টিজ বলতে তো কিছুই থাকেনা।
হালিমা: ঠিক বলেছেন ভাবি। আপনার ভাই তো এমাসেই গাড়ি কিনতে চেয়েছিলেন। আমি নিষেধ করে বলেছি আগে ফ্ল্যাট তারপরে গাড়ি। নিজস্ব ফ্ল্যাট ছাড়া গাড়িতে চড়ে বেড়ানো শোভা পায়না।
লতিফা : আরে ভাবি,আপনি দেখি আমার মনের কথাটাই বলেছেন। আপনার ভাই আমার যাতায়াতের জন্য সরাসরি জাপান থেকে খুব দামী গাড়ি আনতে চেয়েছিলেন। আমি নিষেধ করে দিয়েছি। আপনার মতো আমারও ওই একই কথা। আগে বাড়ি, তারপরে গাড়ি। নিজস্ব বাড়ি ছাড়া গাড়ি কী মানায়? লোকজন হাসাহাসি করে বলবে, শখ কতো? বাড়ি নাই অথচ গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খামাখা হাসির পাত্র হতে চাইনা।
লতিফা: জানেন ভাবি, আমরা প্রতিদিন বিকালে রেষ্টুরেন্টে গিয়ে চাইনিজ খাবার খেয়ে আসি। আপনার ভাইয়ের আবার দেশি খাবার পছন্দ নয়। আর চাইনিজ খাবার না খেলে রাত্রিতে ওর ঘুমই হয়না।
হালিমা : ওহ্ ভাবি, মনের কথা বলেছেন। আমরা প্রতিদিন দু'বেলাতেই ভালো রেষ্টুরেন্টে খেয়ে থাকি। আপনার ভাই আবার কাজের মেয়ের হাতের রান্না খেতে পারেনা। আমাকে রান্না করতে বলে। কিন্তু আমার সময় কোথায়? টিভিতে মজার মজার অনুষ্ঠান দেখতেই আমার সময় কেটে যায়। রান্না করবো কখন?
লতিফা: জানেন ভাবি, গতবার ছুটি কাটাতে আমরা কক্সবাজারে গিয়েছিলাম। বিয়ের পর থেকেই তো কক্সবাজার যাচ্ছি। আর যেতে ইচ্ছে করেনা। তাই এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি সিঙ্গাপুরে যাবো। শুনেছি সিঙ্গাপুর নাকি খুব সুন্দর একটি দেশ। ফেরার সময় অবশ্য মার্কেটিং করার ইচ্ছে আছে।
হালিমা : আর বলবেন না ভাবি, আমরা গতবার ভারতে গিয়েছিলাম। এবার আপনার ভাইয়ের খুবই শখ পুরো পরিবারসহ আমেরিকায় বেড়াতে যাবে।
লতিফা: জানেন ভাবি , বাসায় দু'জন কাজের ছেলে ও মেয়ে। মেয়েটি রান্না আর ছেলেটি বাজার করে থাকে।
হালিমা : কাজের লোকের কথা বলছেন ভাবি। আপনার মতো আমারও দু'জন। তবে আপনার ভাই বলেছেন, আগামী মাসে আরও একজনকে গ্রাম থেকে আনবেন।
লতিফা : জানেন ভাবি, কয়েকদিন আগে আপনার ভাই পৈত্রিকসূত্রে অনেক জায়গা-জমি পেয়েছেন। আমি সেগুলি বিক্রি করে ঢাকায় একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি বানাবো। আমার আবার গ্রামে বসবাস করতে ইচ্ছে করেনা। গ্রামে কী কেউ বসবাস করে? আপনার ভাই গেলেও আমি ভুল করেও কখনো যাইনা।
হালিমা : ঠিক বলেছেন ভাবি। আপনার ভাই তো পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত জমি ইতোমধ্যে বিক্রি করে বসুন্ধরায় ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েছেন। ফ্ল্যাটের কাগজপত্র পেলেই আমরা মফঃস্বলকে গুডবাই জানাবো। আপনার কথাই ঠিক ভাবি, গ্রামে কী মানুষ বসবাস করে?
লতিফা : ভাবি, আমার ছেলেটাকে ভাবছি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেব। কারন এদেশে তো লেখাপড়ার ভালো পরিবেশ নেই। আর তাছাড়া আপনার ভাই তো ভবিষ্যতে ইংল্যান্ডে স্হায়ীভাবে বসবাস করার জন্য এখন থেকেই প্রস্ততি নিচ্ছেন।
হালিমা : ওহ্ ভাবি। আপনি আমার মনের কথা বলেছেন। আপনার ভাই তো আমেরিকায় স্হায়ীভাবে বসবাসের জন্য এখন থেকে কাজের মেয়েসহ আমাদের সবাইকে ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্হা করেছেন। সারাদিনে মোট তিনজন শিক্ষক এসে ইংরেজি পড়িয়ে যান। আমাদের বাসায় এখন বাংলায় কথা বলা নিষেধ। ইংরেজিতে কথা বলতে না পারায় এর মধ্যে ৪ জন কাজের ছেলে - মেয়ে পালিয়েছে। ইংরেজিতে কথা বলতে হবে জেনে নতুন কোনো কাজের ছেলে- মেয়ে আসতে চাচ্ছেনা।
এভাবে দু'জনাই বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে থাকেন। কেউ হারতে রাজি নন। কে নিজেকে কত ভাবে জাহির করতে পারেন এটাই তাদের মুখ্য বিষয় এবং প্রতিযোগিতা। অবশেষে পরীক্ষা শেষে ছেলেরা এলে দু'জনাই চুপিসারে একজন আরেকজনকে এড়িয়ে পায়ে হেটে বস্তিতে অবস্থিত বাসার উদ্দেশ্য রওয়ানা হন। লতিফা ভাবি বাসায় এসে বাজার করতে যান। তার স্বামী ছাপোষা কেরানি। অপরদিকে হালিমা ভাবি বাসায় পৌঁছে ব্যাগ নিয়ে বাজারে দৌড়ান। রান্না না করলে খাবে কী? তার স্বামী বাসের সুপারভাইজার। কাজের লোক রাখার সামর্থ্য তাদেরও নেই। বাজারে ব্যাগ হাতে দু'জনার মাঝে পুনরায় দেখা হয়। দু'জনাই অপ্রস্তত হয়ে ভীষন লজ্জা পেয়ে একজন আরেকজনের সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচতে চান। দু'জনের চাপাবাজী আর চালাকি উভয়ের কাছে ধরা পড়ে যায়। কিছুক্ষন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে কোনো কথা না বলে তারা দু' জনাই যার যার গন্তব্যে পা বাড়ান।
সত্যিই পৃথিবীতে মানুষকে চেনাই বড় দায়। যার যা সামর্থ্য আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা এবং প্রকাশ করা উচিত। অযথা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলে লাভ কী? এতে শুধু মনের কষ্টই বাড়েনা। সাথে সাথে ধরা পড়ে সবখানেই হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়। নির্বোধ আর অশিক্ষিতদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তারা প্রতিনিয়তই মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে যান যা সামাজিক সমস্যা। আর এ সমস্যা থেকে আমাদেরকে উত্তরন হতে হবে।
সাম্প্রতিক মন্তব্য