logo
news image

ল্যান্ড রোভারের ধাক্কায় বেরুলো কালো উপাখ্যান

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
পড়বি পড় মালির ঘাড়ে। একবারে আসল জায়গায়। ঢাউস জিপগাড়িটির গুঁতোয় কতবার কতকিছু ঘটে গেছে। কত মারপিট করা হয়েছে, কতজন জখম হয়েছে, হাসপাতালে গেছে, কে জানে? তখন ‘ভয়ে কেউ মুখফুটে কিচ্ছু বলে নাইক্কা’। জানালো আশিক টাওয়ারের একজন ব্যবসায়ী। আজও তিনি চারদিকে তাকিয়ে তারপর ভয়ে ভয়ে কথাগুলো বলছিলেন এক টিভি ক্যামেরার সামনে।
সাদা অক্ষরে ডিফেন্ডার লেখা কালো বার্ণিশ করা পুরনো ল্যান্ড রোভার গাড়িটিতে তারা ঢাকার রাস্তায় হরহামেশা দৌড়াদৌড়ি করে বেড়ায়। সেদিনও বেরিয়েছিল অনেকজন মিলে। নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফের মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দিয়েছিল গাড়িটি। এরপর ওই গাড়ি থেকে কয়েকজন নেমে ওয়াসিফকে মারধর করেন। তারমধ্যে ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের সদ্য বরখাস্ত কাউন্সিলর। পরবর্তীতে র‌্যাব পুরান ঢাকায় তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে সহযোগীদেরসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং ভ্রাম্যমান আদালত দেড় বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে।
বৃটিশ ব্র্যান্ড পুরনো ল্যান্ড রোভার গাড়িটির ইঞ্জিনক্ষমতা ২৪৯৫ সিসি। বহুদিন আগে ঢাকায় এটি প্রথমে ইউরোপের একটি দেশের দূতাবাসের জন্য আনা হয়েছিল। পত্রিকায় জানা গেছে, “২০০৪ সালে দূতাবাস গাড়িটি নিলামে তুললে অটোটেক লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান কিনে নেয়। কূটনৈতিক মিশন ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার জন্য আনা গাড়ি শুল্কমুক্ত। তবে বাংলাদেশে গাড়িটি বিক্রি করে দিলে ক্রেতাকে নিবন্ধনের সময় পুরো শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর ২০০৫ সালে গাড়িটির মালিকানা বদল করা হয়।”
সেই ফিটনেসবিহীন গাড়ির ধাক্কা লেগেছে নৌবাহিনীর অফিসারের মোটর বাইকের গায়ে। এ থেকে অপরাধের কালো উপাখ্যান বেরিয়ে আসছে কূল ভাঙ্গা নদীর স্রোতের মত। একটার পর একটা অবৈধ কর্মকান্ডের বিবরণ যেন মেয়াদোত্তীর্ণ ল্যান্ড রোভার রাগ করে গড় গড় করে বলে দিচ্ছে জাতির সামনে।
গল্পটা ক’দিন আগে আমার এক ধীমান বন্ধুবর বলেই ফেলেছেন। তা হলো- ধর্মের ঢোল আপনিই বাজে। শুধু সময় হলেই তা ঘটে। সবাই জানে আগুন পোড়ায়। হ্যাঁ, আগুনে হাত দিলে হাত ঝলসে যায় অথবা পুড়ে। সবাই এটাও জানে পানি আগুনকে নিভাতে পারে। পানি ছাড়া প্রাণির প্রাণ বাঁচে না। সাঁতার না জানলে পানিতে নামলে বিপদ ঘটতে পারে। গড়ে প্রতিদিন পানিতে ডুবে বত্রিশ শিশুর অকাল মৃত্যু তাদের পরিবারগুলোর মাঝে বয়ে আনে মহা দুর্ভোগ। সবাই আরো জানে, বায়ুতে অক্সিজেন আছে তাই নাক-মুখ দিয়ে সেটা গ্রহণ করতে হয়। আবার বায়ুতে করোনার জীবাণু আছে, তাই মাস্ক দিয়ে ছেঁকে না নিলে সংক্রমণে মৃত্যু হতে পারে। ঘরের বাইরে বের হলে তাই নাক-মুখ ঢেকে সাবধানে বের হতে হবে সেটা আগে জেনে ফেলেছি।
কারণ, কোভিড-১৯ এর কোন অদৃশ্য জীবাণু একবার ফুসফুসে ঠাঁই নিলে কারো জীবন ছারখার হয়ে যেতে পারে। সে তো গেল অদৃশ্য অণুজীব, এক ভয়ংকর আত্মার কাহিনী-যার প্রভাবে সারা পৃথিবী আজ টলায়মান হয়ে পড়েছে।
শরিরী কিন্তু যেসব মানব সদৃশ ভয়ংকর আত্মা চারদিকে সবকিছু দখল করে গ্রাস করে মানুষের অধিকার হরণ করে চলেছে তাদের কি কিছু হচ্ছে?
ধীমান বন্ধুবরের একটি লেখা থেকে আগেও এই উদ্বৃতিটি দিয়েছিলাম। তিনি বলেছেন, “ চুক্তির পর জানা যায় হাসপাতালে লাইসেন্স নাই। রোগীর মৃত্যুর পর জানা যায় ডাক্তার ভুয়া। আগুন লাগার পর জানা যায় ভবনের নকশায় ত্রুটি ছিল। দুর্ঘটনার পর জানা যায় গাড়ি বা লঞ্চের ফিটনেস নেই। শেয়ারবাজার বা ব্যাংক লুট হওয়ার পর জানা যায় কোম্পানি ভুয়া। খাল বিল ভরাট করে প্লট বিক্রির পর জানা যায় অনুমোদন ছিল না । ফ্লাইওভার-ব্রিজ তৈরির পর জানা যায় নকশায় ভুল ছিল । সাজা ভোগের পর জানা যায় আসামি আসল ছিল না। কোটি মানুষ খাওয়ার পর জানা যায় পণ্যে ভেজাল ছিল। লুটেপুটে বিদেশ পালানোর পর জানা যায় কোম্পানি হায় হায় ছিল......চলছে চলুক..”
সিলেটের এমসি কলেজে গৃহবধূকে গণধর্ষণ, পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান হত্যা, টেকনাফে সেনাবাহিনীর মেজর (অব:) সিনহা হত্যা, ফেণীতে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন, বরগুনায় রিফাত হত্যা, আরো কত কিছু যে প্রতিদিন ঘটে চলেছে তা লিখে শেষ করা যাবে না। এগুলো সংঘটনের জন্য কিছু স্মার্ট মানুষ অতি স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করে আইন শৃংখলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে ভয়ংকর অপরাধ ঘটিয়ে চলেছে তার জন্য এতদিন কি কিছু ব্যবস্থা নেয় হয়েছে? সেটা হলে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে আবাসিক ভবন ও সুপার মার্কেটের উপরে মারণাস্ত্র, ওয়াকিটকি, ড্রোন, টর্চার সেল ইত্যাদি নিয়ে একজন আইন প্রণেতার ঘরে কীভাবে বে-আইনী কাজের পাহাড় গড়ে উঠে?
রাজধানীতে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে ফিটনেসবিহীন কয়টি গাড়ি কখন কীভাবে কোথা থেকে কোথায় চলাচল করে তা বিআরটিএ-র অজানা থাকার কথা নয়। তাদের ইন্ধন ছাড়া অবৈধ গাড়ির চাকা ঘুরতে পারে না। বিআরটিএর তথ্য বলছে, “২০১০ সাল থেকে এই গাড়ির ফিটনেস সনদ হালনাগাদ নেই। ২০০৫ সাল থেকে রোড ট্যাক্সও দেওয়া হয়নি। বর্তমানে এই শ্রেণির গাড়ির রোড ট্যাক্স বছরে ৭৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া প্রতিবছর ফিটনেস সনদ হালনাগাদের ফিও আছে। ফিটনেস ও ট্যাক্স টোকেন হালনাগাদ না থাকলে নির্ধারিত হারে জরিমানার বিধান রয়েছে।” ক্ষমতাধররা জরিমানা দেন না, বরং অপরাধ লালন করেন।
মোদ্দাকথা হলো ক্ষমতার অপব্যবহারে দেশের মানুষ অতিষ্ট। বানরের গলায় মুক্তার হার পরিয়ে দিলে সে তো সেটা তীক্ষ্ন দাঁত দিয়ে কেটেকুটে চুরমার করবেই! বেহুঁশ হয়ে ফিটনেসবিহিীন গাড়ি মানুষের গায়ের উপর তুলে দিবে!
বিআরটিএ এতদিন কেন এই অবৈধ ফিটনেসবিহীন গাড়িটি আটকায়নি? ওদের কারখানায় দামী ব্রান্ডের ভূয়া লেবেল লাগিয়ে নকল পণ্য করে তৈরী করা হয়। একশ’ বাড়ি, ব্যাংকের জমি, নদীর তীর, মার্কেট ইত্যাদি ওদের দখলে থাকে। দুদক এতদিন এগুলো খোঁজেনি কেন? ওদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে বলে বেড়ায় “মামলা করে কিছু করতে পারেবে না, ওসব থানা-পুলিশ আমরা পকেটে রাখি।” আমাদের জাতির দুর্ভাগ্য সন্ত্রাসীদের এসব কথা ঘরে বসে গণমাধ্যমে হতাশাব্যঞ্জকভাবে শুনতে হয়।
শুধু মনে হয় এত ঘটনা, এত দুর্ঘটনা এর প্রতিকার আগেভাগেই করার ক্ষেত্রে আমরা গড়িমসি করছি কেন? আমাদের কার্যকরী পূর্বপরিকল্পনা নেই কেন? আমরা আগেভাগেই এসব কুকর্ম প্রতিরোধের জন্য ব্যবস্থা নিতে পারি না কেন? এসব বিষয় দেশের সেবাদানকারীগণ আগেভাগে জানেন না তা বলা যাবে না। জেনেও তারা চুপ করে সময় ক্ষেপণ করেন কোন কারণে, কার আশায়, কিসের নেশায়? তাই বলতে হয়, দায়িত্ববানরা সহজে প্রতিরোধযোগ্য আর্থ-পরি-সামাজিক সমস্যাগুলো অবহেলা করে মহীরূহ করে ফেলার সুযোগ দেন। তারপর সেগুলো জটিল আকার ধারণ করলে তাদের বোধোদয় ঘটে। তখন উপায়ান্তর না দেখে দিগ্বিদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন কেন? তাইতো ধীমান বন্ধুবর আক্ষেপ করে বলেছেন, এদের লাগাম টানার জন্য ওদের চেয়ে বেশী শক্তিধর ও সাহসী কেউ কি আছেন?
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top