logo
news image

লালপুর মধ্য ও উচ্চ বিদ্যালয়-কিছু স্মৃতি: কিছু কথা

আ ন ম সোলায়মান।।
(লালপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও কৃতী গ্রন্থের জন্য তথ্য খুঁজতে গিয়ে সাংবাদিকতার জীবনের প্রায় ৩১ বছরের ঝুলিতে ১৯৮৫ সালে লেখা সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু আ ন ম সোলায়মান স্যারের একটি লেখা পেয়ে গেলাম। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে স্যারের লেখার হুবহু কপি তুলে ধরা হলো-সম্পাদক।)
১৩০ সাল। সবেমাত্র একখানা ‘শিশুশিক্ষা’ হাতে নিয়ে আব্বার পিছনে পিছনে যাতায়াত শুরু
করেছি, এই অঞ্চলের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘লালপুর শরৎ সুন্দরী মধ্য ইংরেজি’ বিদ্যালয় (প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৬৭ ইং)।
সে সময় স্কুলটি বর্তমান লালপুর হাটের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত ছিল। কয়েকটি কক্ষ বিশিষ্ট একটি দালান ঘরে চলতো এর শিক্ষাদান কার্য। এ গৃহটির ২/১ টি কক্ষ সে সময়েই জীর্ণ দশাগ্রস্থ ছিল। এর জরাজীর্ণ ছাদের কোন কোনটিতে আকস্মিক পতন রোধের উদ্দেশ্যে লম্বা বাঁশের মোটা খুঁটি দিয়ে ঠেস দেওয়া থাকতো।
ইদানিং যে রাস্তাটি লালপুর বাজারের মাঝামাঝি দিয়ে দক্ষিণ দিকের ত্রিমোহিনীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে, তৎকালে এই পায়ে চলা রাস্তাটিরই পাশ ঘেঁষে পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থিত ছিল বিদ্যালয়টি। আর তারই উত্তর পূর্ব কোণে ছিল একটি আমবাগান। কিন্তু এগুলোর কোন চিহ্ন আজ আর নেই।.......
বর্তমান হাইস্কুলটির মাঠ সংলগ্ন পশ্চিম দিকে যে পুষ্করিনিটি রয়েছে, সেটার কিয়দংশ বিশেষ
করে দক্ষিণ ও পশ্চিম পাড় ঝোপ-ঝাড় আগাছায় আচ্ছন্ন থাকতো। এই পুষ্করিনীর পাড় দিয়ে
আমবাগানের ধার দিয়ে পায়ে চলা পথ বেয়ে যেতে হতো স্কুলে। আমার শ্রদ্ধেয় পিতা মরহুম ইয়াকুব আলী সাহেও ছিলেন এই স্কুলের অন্যতম শিক্ষক ।
তৎকালে লালপুর-গোপালপুর রোডটিতে ছিল না বিভিন্ন প্রকার যান-বাহনের আজ-কালকার মত এমন ভীড়। আর তাই তখন ছিল না এসবের কান ‘ঝালাপালা করা’ এমন উৎকট শব্দ! এই রোড দিয়ে কিছু ট্রেনের যাত্রী নিয়ে চলতো শুধু কয়েকটি টমটম। ছিল না এখানে সেখানে সকাল-সন্ধ্যা-দুপুরে আজকের মতো কোলাহল মুখর এমন জনসমাবেশ। ছিল না  রাস্তার ধারে ধারে, মোড়ে মােড়ে বিভিন্ন বিচিত্র বিপণী শ্রেণীর সমারহ। তাই অত্যন্ত শান্ত-নিঝুম নিস্তব্ধ পরিবেশে অবস্থিত ছিল বিদ্যালয়টি। এই বিদ্যালয়টিসহ একটি দাতব্য চিকিৎসালয়ও তৎকালে ‘পুঁঠিয়া পাচআনী রাজ এষ্টেটের’ অর্থানুকুল্যে পরিচালিত হত। কালক্রমে কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্যে ও অবহেলায় ১৯৩৪ সালে বিদ্যালয়টির দুর্দশা চরমে পৌঁছে। শিক্ষকদের বেতন হয় অনিয়মিত। শিক্ষাউপকরণ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি এক সময় জরাজীর্ণ স্কুল গৃহের এক অংশ ভস্মিভূত হয়ে যায়। তখন অনন্যোপায় হয়ে শিক্ষকগণ কখনও কোন দোকান ঘরে, কখনো গাছের তলায় শিক্ষার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু দীর্ঘ ৫ বছর শিক্ষক বেতনাদি না পেয়ে অবশেষে স্ব-স্ব পদত্যাগ করতে উদ্যক্ত হন।
সেই সময় স্থানীয় জমিদার প্রয়াত বাবু যতীন্দ্র নাথ কুন্ডু ও বাবু দেবেন্দ্র নাথ কুন্ডু ভ্রাতৃদ্বয় কর্তৃক ১৯৩৫ সালে স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের অনুরোধে তদীয় পিতা প্রয়াত বাবু চন্দ্রনাথ কুন্ডু মহাশয়ের নামে ‘চন্দ্রনাথ মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়’ টি স্থাপিত হয়। ওই সময় শরৎ সুন্দরী বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ পূর্বোক্ত পদে ইস্তফা দিয়ে নবপ্রতিষ্ঠিত চন্দ্রনাথ মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
সে সময় শরৎ সুন্দরী মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, ১। বাবু দ্বিজেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী (প্রধান শিক্ষক), ২। বাবু কৃষ্ণ গোবিন্দ কুন্ডু (সহকারী শিক্ষক), ৩। মৌ. মো. আবুল হোসেন (সহকারী শিক্ষক), ৪। মৌ. মো. ইয়াকুব আলী (সহকারী শিক্ষক), ৫। বাবু নলিনী কান্ত সরকার (প্রধান পন্ডিত), ৬। বাবু রজনী কান্ত হালদার (সহকারী শিক্ষক), ৭। বাবু ভবেশ চন্দ্র সাহা (সহকারী শিক্ষক)।
সে সময় দয়ারামপুরের ‘রসিক মাস্টার’ মাহশয়ও কিছুদিনের জন্য শিক্ষকতা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কথা আজ আর মনে পড়ে না। শেষের দিকে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য মৌ. মো. জামালুদ্দিন সাহেব ও বাবু সতীশ চন্দ্র সরকার মহাশয়কেও শিক্ষকতা করতে দেখেছি। সে সময় বিদ্যালয়ে লালবিহারী দত্ত নামে জনৈক শান্তশিষ্ট পলিত কেশ বৃদ্ধ দপ্তরিকে দেখেছি। তিনি তৎকালে পিতা, পুত্র, ছাত্র, শিক্ষক নির্বিশেষে সবার ‘লালু দা’ ছিলেন।
আত:পর চন্দ্র নাথ এম ই স্কুলটি চালু হলে আমরা ছাত্ররাও এই বিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত হই। বিদ্যালয়টি চালু হয় ১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখে। যদিও বৃটিশ-ভারত-সম্রাট পঞ্চম জর্জের ‘রজত জুবিলী’ দিবস উপলক্ষে ১৯৩৫ সালের ৬ মে তারিখে এর ভিত্তি স্থাপিত হয়। সেদিন বিদ্যালয়ের ছাত্ররা সমবেত কন্ঠে ভারত সাম্রাট পঞ্চম জর্জের প্রশস্তি সূচক একটি সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। গানটির কয়েকটি পংক্তি এইরূপ ছিল-
‘তুমি মঙ্গল কর, মঙ্গল করে মঙ্গলময় হে!
সম্রাটে কর দীর্ঘজীবী প্রজা রঞ্জক হে!
কর বিদূরিত সব হাহাকার
পুঞ্জিত যত মনের বিকার
হাস্যপূর্ণ রাজ্য তাহার বিঘ্ন নাশন হে!
অযুত কন্ঠে হোক ধ্বনি-
জয় ভারতেশ জয় নরমণি
জয় সম্রাট অমিত প্রতাপ
ন্যায়বান ভূপ হে!’
যতদূর মনে পড়ে, গানটির রচয়িতা ছিলেন, উক্ত বিদ্যালয়ের অন্যতম শিক্ষক, নিরলস কর্মী প্রয়াত বাবু রজনীকান্ত হালদার মহাশয়। ছাত্রদের পুরোভাগে সেদিন ছিলেন হারমোনিয়াম গলায় চকজোতদৈবকী গ্রামের শ্রী যতীন্দ্র নাথ হালদার। সর্বঙ্গীন নির্দেশনায় ছিলেন ‘রজনী বাবু’। সে উৎসব মুখর দিনটিতে সকল মহলে বেশ উৎসাহ উদ্দীপনার সঞ্চার হয়েছিল।
পুর্ব কথিত শরৎ সুন্দরী মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ের পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত যে দাতব্য চিকিৎসালয়টি ছিল, সেটাও কর্তপক্ষের ঔদাসীন্যে ও অবহেলায় ভগ্নদশাপ্রাপ্ত হয়। সে সময় চিকিৎসালয়টির ধ্বংসপ্রাপ্ত জরাজীর্ণ দেওয়ালগুলি ঝোপ-ঝাড়, লতা-গুল্মে আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছিল। উক্ত দাতব্য চিকিৎসালয়টির ডাক্তার বাবুর নাম ছিল ‘ত্রৈলোক্য নাথ আচার্য’। তাঁর বাসাটি ছিল বর্তমান হাইস্কুলের মাঠ সংলগ্ন পুষ্করিনীর উত্তর পাড়ে। বোধ করি তার বাসাটিই তৎকালে ডিস্পেনসারী রূপে ব্যবহৃত হত। মনে পড়ে, তিনি ছিলেন সুদর্শন শুভ্র-শ্বশ্রু মন্ডিত, পলিত কেশ অশীতিপর বৃদ্ধ। কিন্তু বৃদ্ধ হলেও তিনি সুস্থ-সবল দেহের অধিকারী ছিলেন। তিনি নাকি প্রতিদিন তিন সের দুগ্ধ পান করতেন।
যা হোক, নব কলেবরে প্রতিষ্ঠি চন্দ্রনাথ মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়টি বর্তমান হাইস্কুল প্রাঙ্গনের
ঠিক মাঝখানে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা দক্ষিণ দুয়ারী একটি টিনের ঘরে পরিচালিত হতে থাকে। সে সময় উক্ত স্কুলের শিক্ষক ছিলেন- ১) বাবু কৃষ্ণ গোবিন্দ কুন্ডু (প্রধান শিক্ষক), ২) বাবু রজনী কান্ত হালদার (সহকারী শিক্ষক), ৩) বাবু নলিনী কান্ত সরকার (প্রধান পন্ডিত), ৪) মো. ইয়াকুব আলী (সহকারী শিক্ষক), ৫) বাবু যতীন্দ্র নাথ কুন্ডু (সহকারী শিক্ষক), ৬) মো. নইমুদ্দিন (সহকারী শিক্ষক), ৭) আহমদ আলী (সহকারী শিক্ষক)।
এই এম ই স্কুল থেকে আমি ১৯৩৭ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে উত্তীর্ণ হয়ে কুষ্টিয়া হাইস্কুলে ভর্তি
হই এবং সেখান থেকেই ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিকুলেশান (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। যেদিন পরীক্ষা দিয়ে কুষ্টিয়া থেকে বাড়ি আসি, তারই দুই দিন পর আমাদের শ্রদ্ধেয় পিতা ফজরের নামাজ অন্তে অকস্মাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার এই অকাল প্রয়ানে আমার ভাবি জীবনের আশা আকাঙ্খারও পরিসমাপ্তি ঘটে। পরবর্তীতে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এবং আব্বার স্নেহভাজন ছাত্র বাবু রজনীকান্ত হালদার মহাশয় বাড়িতে এসে আমাকে বললেন, ‘আমরা মাষ্টার মহাশয়ের মৃত্যু উপলক্ষে স্কুলে একটি শোকসভার আয়োজন করেছি, তুমি সেখানে চল’-তাঁর কথামত আমিও সেখানে উপস্থিত হলাম। সেখানে লালপুরের অনেক গণ্যমান্য হিন্দু-মুসলমান ভদ্র মহোদয়গণ উপস্থিত হয়েছেন দেখলাম । সভা শেষে রজনীকান্ত বাবু আমায় বললেন, ‘বাড়িতে শুধু শুধু বসে থেকে কি হবে, তার চেয়ে আপাতত স্কুলে মাস্টার মহাশয়ের পদে কাজ কর’। তখনও আমার রেজাল্ট বের হয়নি। তাঁর কথামতো-যাঁরা আমার শিক্ষক ছিলেন তাঁদেরই সহকর্মী হিসেবে মাসিক ১৫ টাকা বেতনে ১৯৪২ সালে শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত হলাম।
 সে সময় এ অঞ্চলের অন্যতম সমাজকর্মী মরহুম মৌ. মোশারফ হোসেন সাহেব ‘জুট রেগুলেশন’ ডিপার্টমেন্টে চাকুরীরত ছিলেন। তিনি একদিন আমায় তাঁর ডিপার্টমেন্টে চাকুরী করার পরামর্শ দিলেন এবং নিজেই চেষ্টা করে চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিলেন। কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে যোগ দিলাম চাকুরীতে চারঘাট উপজেলার মিরগঞ্জ অফিসে পিএলএ হিসেবে। সে সময় কর্মক্ষেত্র হিসেবে বাঘা, আড়ানী, বাউশা, শরেরহাট, ছাতারী প্রভৃতি এলকায় যাতায়াত করতে হতো। কিন্তু পরবর্তীতে সাংসারিক অসুবিধা, বিশেষ করে মনের সাথে চাকুরীটা খাপ না খাওয়ায় চাকুরী থেকে ইস্তফা দিয়ে পূণরায় ফিরে এলাম এই স্কুলেই।
ওই সময় লালপুর ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার বাবু নগেন্দ্র নাথ কুন্ডু মহাশয় পদত্যাগ করায় পিতৃবন্ধু অবসরপ্রাপ্ত পোস্ট মাস্টার মরহুম মনসুর আলী সাহেবের অনুরোধে ‘বোঝার ওপর শাকের আটি’র মত পোস্ট মাস্টারীর দায়িত্বও আমাকে গ্রহণ করতে হলো। সে জন্য আমাকে সকাল সকাল পোস্ট অফিসের কাজ শেষ করে স্কুলে যেতে হতো।
ইতোমধ্যে স্থানীয় উৎসাহী শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গের প্রচেষ্টায় বুধপাড়ায় একটি হাইস্কুল চালু করা হয়। পরবর্তীতে এই হাইস্কুলটি সেখান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে চন্দ্রনাথ মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ের সাথে সংযুক্ত হয় এবং বুধপাড়ার জমিদার বাবু দেবেন্দ্র নাথ কুন্ডু মহাশয়ের পত্নীর নাম অনুসারে ‘শ্রী সুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় নাটোর মহকুমার জনহিতৈষী মাননীয় মহকুমা প্রশাসক জনাব পি আহমদ সাহেব বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার কাজে যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা লগ্নে শিক্ষক হিসেবে ছিলেন-১. বাবু কুলদা নাথ চক্রবর্তী, ২. বাবু কালী কৃষ্ণ সান্যাল, ৩. বাবু শরৎ চন্দ্র ভৌমিক, ৪. মৌ. কফিলুদ্দিন আহমদ, ৫. বাবু পুরন্দর মৈত্র, ৬. বাবু বৈদ্যনাথ হালদার ও ৭. বাবু দেবেন্দ্র নাথ কুন্ডু।
প্রাথমিক পর্যায়ে শান্ত রাধা কান্ত সাহা, বাবু মন্দ্রিনাথ কুন্ডু প্রমুখ স্থানীয় ব্যক্তিবর্গও শিক্ষাদান
কার্যক্রম চালু রাখতে সহায়তা করতেন। কর্মীদের মধ্যে বাবু রজনী কান্ত হালদার মহাশয় ছিলেন সকলের মধ্যমনি। স্থানীয় সমাজ হিতৈষী, শিক্ষানুরাগী কতিপয় হিন্দু ও মুসলমান কর্মীগন তাঁর সহযোগী ছিলেন। এক সময় এ অঞ্চলের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. শামসুদ্দিন মিয়াও প্রধান শিক্ষক হিসেবে উন্নতি-অগ্রগতির জন্য উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন।
পরবর্তীকালে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গের নাম স্মরণীয়-
১) জনাব মো. ইব্রাহিম চৌধুরী। (বিএ), ২) জনাব মো. এমদাদ আলী (বিএ), ৩) জনাব মো. হাশমত আলী (বিএ, বিটি), ৪) জনাব মো. রায়হান আলী (বিএ), ৫) জনাব মো. মোশাররফ হোসেন (বিএ) এবং ৬) জনাব মো. ইয়াহইয়া (বিএ, বিটি)।
প্রাথমিক অবস্থায় বিদ্যালয়টিকে বহুবিধ সমস্যার মধ্য দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হয়। কখনো এমন অবস্থার উদ্ভব হতো, যেন এটাকে আর টিকিয়ে রাখা হয়ত সম্ভব হবে না। মনে পড়ে, একবার বিদ্যালয়টির সমস্যা সমাধান কল্পে স্কুলে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়। বাজশাহীর তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব ডি এন হক সাহেব উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন। সেদিন বিদ্যালয়ের বিবিধ অভাব অভিযোগ ও সমস্যার কথা শুনে বিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার পরিবর্তে তিনি অবিলম্বে বিদ্যালয়টিকে ভেঙ্গে দেবার পরামর্শ দিয়ে যান। কিন্তু স্থানীয় কর্মী ও শিক্ষকদের ত্যাগ ও অধ্যবসায়ের ফলে ক্রমশঃ তা ক্রমোন্নতির পথে এগিয়ে চলে।
এই সময়ে ‘মধ্য ইংরেজী বিদ্যালয়’ বিভাগে আমার প্রায় ১০ বছর সহকারী শিক্ষকরূপে চাকুরীর পর বিদ্যালয়ের ব্যয় সঙ্কোচের উদ্দেশ্যে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তক্রমে ২ জন শিক্ষককে ছাঁটাই করা হয়। ছাঁটাইকৃত শিক্ষকদের মধ্যে আমিও ছিলাম। এমনি অবস্থায় বেশ একটু বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হলো আমাকে। কারণ একটি সরকারী চাকুরী ছেড়ে দিয়ে, দেশে থাকবো বলে, পূণরায় যোগ দিয়েছিলাম এই স্কুলে। আর আব্বা তো পূর্বেই লোকান্তরিত হয়েছেন। এক বছর পর শেষ অবলম্বন আম্মাকেও হারালাম এক রমজান মাসে। সংসারে আমারই উপর নির্ভরশীল কয়েকটি পোষ্য-আমারই কনিষ্ঠ সহোদরগণ। অনন্যোপায় হয়ে এই অবস্থাতে ‘শিক্ষক প্রাইভেট পরীক্ষার্থী’ হিসেবে ১৯৫২ সালে (ঢাকা বোর্ড) আই, এ পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলাম।
সেই সময় হাইস্কুলে গ্র্যাজুয়েট শিক্ষক হিসাবে জনৈক শিবাজী মোহনকে (বিএ) নিয়োগপত্র
দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি কার্যে যোগদান না করায়, উক্ত পদে আমাকে নিযুক্ত করা হয়।
উল্লেখ করতে ভুলে গেছি যে, ইতোমধ্যে আমার এমন সাংসারিক অচলাবস্থা দেখে আমার কতিপয় শুভানুধ্যায়ী আত্মীয়-পরিজন মিলে উক্ত পদে যোগদানের ব্যাপারে সহযোগিতা করতে ত্রুটি করেন নি।
যা হোক কিছুদিন ওই পদে শিক্ষকতা করার পর পূণরায় আমার কতিপয় হিতৈষীর পরামর্শে রাজশাহী সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে বিবিধ অসুবিধা ও আর্থিক অনটনের মধ্যে ১৯৫৪ সালে (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম ব্যাচ) বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই।
সে সময় উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মো. ইয়হইয়া (বিএ, বিটি) সাহেব। ইচ্ছা ছিল পূণরায় এই বিদ্যালয়ে যোগদান করার। কিন্তু প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য অনুসারে বিদ্যালয়ে কোন শুন্য পদ না থাকায় অন্যত্র যাবার চেষ্টা করতে হয়। এমনি সময় চারঘাট উপজেলার কালিদাসখালি হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে একটি নিয়োগপত্র পেয়ে সেখানে যোগদান করি।
ইতোমধ্যে স্থানীয় কতিপয় উৎসাহী নবীন-প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ আমার অনত্র চলে যাওয়াতে ক্ষুব্ধ হন। তাঁরা বিদ্যালয়ে স্থানীয় শিক্ষক হিসেবে আমাকে নিয়োগের জন্য ম্যানেজিং কমিটিকে চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। ফলে কমিটির সভাপতি তৎকালীন নাটোর মহকুমার প্রশাসক জনাব এ রাজ্জাক সাহেবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ২২/১১/১৯৫৫ তারিখের সভায় আমাকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়।
কিছুদিন পর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব ইয়হইয়া সাহেব আকস্মিক অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁর এক আত্মীয় রাজশাহী কলেজের অধ্যাপক কাজি আব্দুল মান্নান সাহেব ছুটির আবেদন করে তাঁকে চিকিৎসার জন্য রাজশাহী নিয়ে যান। তিনি সুস্থ হবার পর পূণ: যোগদানের আবেদন করেন। কিন্তু কমিটির সভাপতি তা গ্রহণ না করায় তিনি ইস্তফা দিয়ে অন্যত্র চলে যান। তখন সহকারী প্রধান শিক্ষক প্রয়াত রাধাকান্ত সাহা ‘ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এই সময় বিদ্যালয় কমিটি আমাকে রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ডেপুটেশনে পাঠানো হয়। সেই বছরেই রাজশাহীতে প্রথম টিচার্স ট্রেনিং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এক বছর ট্রেনিং সমাপ্তির পর পূণরায় স্কুলে যোগদান করি। রেজাল্ট বের হলে কমিটির সদস্য ও শিক্ষকগণের মধ্য থেকে আমাকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। আমি সম্মত না হওয়ায় দীর্ঘদিন এভাবেই চলতে থাকে। কিন্তু ক্রমাগত অনুরোধ ও বিভিন্ন মহল থেকে চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হই ।
সে সময় নাটোরের কাজী আবুল মাসউদ সাহেব কমিটির সভাপতি ছিলেন। তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিদ্যালয়ের ২৪/০৭/১৯৫৭ তারিখের সভায় মসিক ১৪০ টাকা বেতনে আমাকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। নিয়োগকালে কমিটির সভাপতি সাহেব আমাকে বলেন, ‘আপনি স্থানীয় লোক। বিদ্যালয়ের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় আপনাকে বেতন কম নিয়েই কাজ করতে হবে। এটা আপনার নিকট সবার দাবি।’ সে সময় প্রকৃতই বিদ্যালয়ের আর্থিক দুর্দিন চলছিল। বিভিন্ন সমস্যা ছিল অত্যন্ত প্রকট। তাই আমি তাঁদের দাবি উপেক্ষা করতে পারিনি।
বিদ্যালয়টি ১৯৬০-১৯৬১ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী’ পরিকল্পনাধীন উন্নয়নের জন্য গৃহীত হয়। এভাবে বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ চড়াই-উৎরাই পার হয়ে কিছুটা স্বনির্ভরতা অর্জন করে। গড়ে ওঠে বিজ্ঞান ভবন, শ্রেণী কক্ষ ইত্যাদি। পরবর্তীতে সরকারি অনুদানে নতুন শ্রেণী কক্ষ ও কমিউনিটি স্কুল প্রভৃতি।
এইভাবে এমই স্কুলে ১০ বছর আর হাইস্কুলে ২৭ বছর মোট ৩৭ বছর চাকুরী জীবন শেষ করে অবসর গ্রহণের সময় এসে যায়। ম্যানেজিং কমিটি অবসর না নিয়ে আরো কিছু দিন দায়িত্ব পালনের অনুরোধ জানায়। কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণে সে আবদার রক্ষা করতে পারিনি। তাই আমার স্থলাভিষিক্ত প্রধান শিক্ষক মো. আমিনুল ইসলাম সাহেবকে বিদ্যালয়ের দায়িত্বভার অর্পন করে বিদায় গ্রহণ করি।
যদিও আমার জীবনের উৎকৃষ্ট সময়টি এই বিদ্যালয়েই ব্যয়িত হয়েছে, কিন্তু বেসরকারী বিদ্যালয় হওয়ায় অবসর ভাতার ব্যবস্থা না থাকায় শুন্য হাতেই কর্মস্থল থেকে বিদায় গ্রহণ করতে হয়েছিল। বিদ্যালয়ের পরম স্নেহভাজন শিক্ষার্থী ও সহকর্মীগণ ২৯/০৫/১৯৮৪ সালে আমায় তাদের অনাবিল হৃদ্যতা-রসে বেদনাঘন বিদায় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন।
আজ মনে পড়ে অতীতের ফেলে আসা দিনগুলির কথা। মনে পড়ে আমার শৈশব ও কৈশরের স্মৃতি বিজড়িত এই শিক্ষা নিকুঞ্জ তথা বাল্যের এই লীলা-নিকেতনের মধুর দিনগুলির কথা। যা আমার মনের মণিকোঠায় রয়েছে চির ভাস্বর হয়ে, রয়েছে আমার নিরালা নি:সঙ্গ-নিভৃত মুহুর্তের সম্পদ হয়ে। আরো মনে পড়ে আমার যৌবনের কর্মজীবনের কথা, সাফল্য-ব্যর্থতা, খ্যাতি-অখ্যাতির কথা! অবশ্য এ বিচিত্র কাননে ফুল ফোটাতে যেয়ে হুলের আঘাতও সইতে হয়নি এমন নয়। কারণ এ মোহময়ী-ধরনীর কুসুমেও যে রয়েছে কন্টক জ্বালা। ফুলে ফুলে হেথা ভুলের বেদন। কিন্তু বৃথা এ স্মৃতিচারণ। কারণ কোন অনাদিকাল থেকে এ ধরিত্রীর মহাসড়কে বিরাট বিশাল মানব-কাফেলার যে মহাযাত্রা শুরু হয়েছে, সে তো শুধু সম্মুখ পানে যাত্রার জনই। এতে পেছনে ফেরার অবকাশ কোথায়? এ যে যাত্রারই পথ-ফেরার পথ নয়। তাই অহরহ মনের মাঝেও গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে-
‘তীরের সঞ্চয় তোর পড়ে থাক তীরে,
তাকাস নে ফিরে।
সমুখের বাণী
নিক তোরে টানি
পশ্চাতের কোলাহল হতে
অকূল আলোতে!’
যাক সে কথা। বিদ্যালয়ের অনেক সহকর্মীই বিভিন্ন সময় স্থানান্তর করে স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁরা আজ কে কোথায় আছেন, আমার জানা নেই। আর বিদ্যালয়ের স্নেহভাজন প্রাক্তন ছাত্রদেরও আনেকেই যারা উচ্চতর শিক্ষা লাভ করে দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে-তারও হিসেব নেই আমার। বর্তমান শিক্ষকবৃন্দ-বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরকারী বেসরকারী সহায়তায় উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যহত রেখেছেন। কামনা করি যোগ্য পরিচালনাধীনে বিদ্যালয়ের কমোন্নতি ঘটুক। লাগুক এর সর্ব অবয়বে রূপান্তরের ছোঁয়া।
 
* আ ন ম সোলায়মান: মরহুম প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, লালপুর শ্রী সুন্দরী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, ০২/০৬/১৯৮৫ খ্রি.।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top