ফাঁসি
ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম।।
মর্জিনা কারো সাথে কথা না বলে ঘরের ভেতরে বসে কেঁদেই চলেছে। জেলখানায় বাবাকে শেষবারের মতো দেখে আসার পর সেই যে কাঁদছে আর থামার নাম নেই। বাড়িওয়ালি কয়েকবার চেষ্টা করেও থামাতে পারেনি। মাকে খুন করার অপরাধে আদালত তার বাবাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডের রায় দিয়েছে। আজ রাতেই ফাঁসি কার্যকর হবে। জেল কর্তৃপক্ষের ডাকে বিকেলে সে বাবাকে শেষ বারের মতো দেখে এসেছে। বিকেল ৪টা থেকে আধাঘন্টা সে জেলখানায় বাবার কনডেম সেলে কাটায়। প্রায় একবছর পর বাবার সাথে দেখা। এর আগে বিচারের জন্য আসামির প্রিজনার ভ্যানে আদালতে নেওয়ার সময় সে কয়েকবার দূর থেকে বাবাকে দেখেছে। কিন্তু বাবা তাকে দেখতে পায়নি। বাবার সাথে কথা বলার জন্য প্রিজনার ভ্যানের পেছনে দৌঁড়িয়েও কথা বলার সুযোগ হয়নি। তাই জেলখানায় বাবাকে দেখে সে চিনতেই পারেনা। একি চেহারা তার বাবার। মুখভর্তি দাড়ি। মাথার চুল উসকোখুসকো। শরীরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। গায়ে কয়েদীর পোশাক। অথচ তার বাবা ছিল তরতাজা এক যুবক, পোশাকপরিচ্ছদে অত্যন্ত স্মার্ট।
জেলখানায় দেখামাত্রই বাবা মর্জিনাকে জড়িয়ে ধরে প্রায় ১০ মিনিট হাউমাউ করে কাঁদে। বাবার কান্না দেখে মর্জিনাও নিজেকে সামাল দিতে না পেরে নীরবে চোখের পানি ফেলে। কাঁদলে বাবা আরও বেশি কষ্ট পাবে বলে মর্জিনা না কেঁদে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলে, একি তোর জামা-কাপড়ের অবস্হা। ছেড়া আর তালি দেওয়া কেন? মর্জিনা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধু চোখের পানি ফেলতে থাকে।
কান্নার এক পর্যায়ে বাবা চোখ মুছে মর্জিনাকে পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক আদর করে। মর্জিনা বাবার কেলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আদর নিতে থাকে। জন্মের পর সে কিছুদিন বাবার আদর পায়। দীর্ঘ পাঁচবছর পর আজ সে বাবার কাছ থেকে শেষবারের মতো আদর নিচ্ছে। বাবার আদর খুবই ভালো লাগে। মা থাকলে তার আদরও পেত। কিন্তু আজকের পর থেকে তাকে আদর করার মতো আর কেউ থাকবেনা। একথা ভেবে মর্জিনার দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে বাবার হাতে পড়ে। কী রে এখনও কাঁদছিস? বাবার একথায় মর্জিনা জোরে কেঁদে বলে, কী করে কান্না থামাই বাবা? আগে মাকে হারিয়েছি আর আজ তোমাকে হারাবো। কাকে নিয়ে বাঁচবো বলো? একথা শুনে বাবা জোরে জোরে কাঁদে।
এসময় মর্জিনার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বাবা বলে, মাগো আজ রাতে আমার ফাঁসি হবে। এ দেখাই তোর সাথে আমার শেষ দেখা।মৃত্যুর আগে আমি মিথ্যা বলবোনা। তোর মাকে আমি খুন করিনি। ঘটনার দিন পারিবারিক কলহের এক পর্যায়ে রাগের মাথায় আমি তোর মাকে ধাক্কা মেরেছিলাম। তোর মা তখন বটি দিয়ে তরকারি কাটছিল। আমার ধাক্কায় বটির ওপর পড়ে গলা কেটে গুরুতর জখম হয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যায়। অবশ্য তোর মাকে ধাক্কা মারাটা উচিত হয়নি। ধাক্কা না মারলে এধরনের ঘটনা ঘটতো না। ঘটনার সময় তোর দু'মামা বাসায় ছিল। স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা আদালতে মিথ্যা স্বাক্ষী দিয়ে বলে, আমি নাকি যৌতুকের জন্য তোর মাকে বটি দিয়ে জবাই করে মেরে ফেলেছি। তাদের মিথ্যা স্বাক্ষীতে আমি অপরাধী প্রমাণিত হই। তোর বয়স তখন তিনবছর। কিছু বোঝার মতো ক্ষমতা তোর ছিলনা।
পাঁচবছর ধরে জেলে আমি অনুতপ্ত আর অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর আগেই মরে গেছি। এখন আমি যেন এক জীবন্ত লাশ। কথাগুলো বলার সময় বাবার দু-চোখ দিয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। মর্জিনা বাবার মুখে হাত দিয়ে এসব কথা বলতে নিষেধ করে। কিন্তু বাবা শুনে না। দুঃখের কথা বলতেই থাকে। মর্জিনা বুঝতে পারে বাবা কথা বলে মনের ব্যথা কিছুটা হলেও হালকা করতে চাইছে। বাবা আরও বলেন, জানিস মা আর কয়েকঘন্টা পর তো আমার মুখটা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। তাই আমাকে প্রান খুলে কথা বলতে দে। কথা বলার সুযোগ তো আর পাবো না।
বাবা দুঃখ করে বলে, ঘটনার পর তোর মামারা পুলিশ ডেকে এনে আমাকে ধরিয়ে দেয়। টাকার অভাবে উকিল নিয়োগ করে জামিন এবং মামলা চালাতে পারিনি। তোর বড় মামার কাছে আমার রোজগারের তিন লক্ষ টাকা ছিল। সেই টাকা এবং আমার ভিটে বাড়ি ও পাঁচ বিঘা জমি দখল করে নিয়েছে। অনেকবার চেষ্টা করেও তোর দেখা পাইনি। বুঝতে পারি তোর মামারা তোকে আমার কাছে আসতে দেয়নি।
মর্জিনা বলে, থাক বাবা এসব কথা বলে আর কী হবে?শুধু তোমার কষ্টটাই বাড়বে। এতদিন তুমি জেলে থাকলেও আমি এতিম হইনি। আজ তোমাকে হারিয়ে চিরদিনের জন্য এতিম হয়ে যাবো। একথা বলে মর্জিনা বাবাকে জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। মর্জিনার মর্মস্পর্শী কথা শুনে বাবাও নিজেকে সামাল দিতে না পেরে হু হু করে কেঁদে ওঠে। বাবা- মেয়ের এই শেষ এবং করুন মিলন দেখে উপস্থিত কারারক্ষীদের অনেকেরই চোখ ভিজে যায়।
মর্জিনা কাঁদতে কাঁদতে আরও বলে, জানো বাবা। নানী মারা যাবার একবছর পর মামিদের প্ররোচনায় মামারা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। তারা বলেছে, খুনির মেয়ে খুনিই হবে। তাই তার জায়গা তাদের বাড়িতে নেই। বাবা বুঝতে পারে তার অবর্তমানে মেয়ে বাড়ি, জায়গা-জমি এবং টাকার ওয়ারিশ হবে বিধায় তাদের এই ষড়যন্ত্র। মর্জিনা তার বাবাকে কেঁদে কেঁদে আরও জানায়, পেটের তাগিদে এই বয়সেই সে গ্রাম থেকে শহরে এসে একজনের বাসায় কাজ করে। তারা ঠিকমতো খেতে দেয় না। সামান্য অজুহাতে মারপিট করে। পরনের কাপড় ছিড়ে গেছে বলায় বাড়িওয়ালির সে কী রাগ। বলে, তুই কোন জমিদারের মেয়ে। মাসে মাসে তোকে জামা দিতে হবে। অথচ এই ছেড়া জামাটি তিনি একবছর আগে আমাকে দিয়েছিলেন। তাই ছিড়ে যাওয়া জামায় তালি মেরেছি। বাবা বলো তো ছিড়া জামা পরে কী থাকা যায়?
মেয়ের কথা শুনে বাবা অসহায় হয়ে আবার কাঁদতে থাকে। একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যত চিন্তা করে শংকিত হয়ে পড়ে। ভাবে, বাবা-মা হারা মেয়েটি বাঁচবে কীভাবে? মর্জিনা জন্মের পর স্বামী -স্ত্রী দু'জনার শখ ছিল মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক বড় ঘরে বিয়ে দেবে। মাঝে মাঝে তারা মেয়ের সংসারে যেয়ে তার মুখের হাসি দেখে আসবে। কিন্তু হঠাৎ দমকা হাওয়ায় তাদের জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। এখন তাদের মেয়ে দুমুঠো ভাতের জন্য মানুষের বাসায় কাজ করে। আগামীকাল থেকে সে একেবারেই এতিম হয়ে যাবে। তাকে দেখার জন্য আর কেউ রইলো না। বাবার বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।
কারারক্ষী এসে জানায়, সাক্ষাতের সময় শেষ হতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। বাবা মর্জিনাকে পুনরায় জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে তার কপালে বারবার চুমু খেতে খেতে বলে, মাগো আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি তোর কোনো কাজে আসতে পারিনি । জীবন চলার পথে সবসময় নিজেকে রক্ষা করে চলবি। কখনও রাগ করবি না। রাগ করলে পরিণতি যে কী ভয়াবহ হয় তার জলন্ত উদাহরণ আমি। একারণে তোর মাকে হারিয়েছি। আমি নিজেও পরপারে পাড়ি দিচ্ছি। মায়ের এবং সাথে সাথে আমার জন্য দোওয়া করিস। ফাঁসির পর আমার লাশ তোর মায়ের কবরের পাশে দাফন করবি। এব্যাপারে জেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন।
বাবা আরও বলে, আগামীকাল তোর মায়ের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিবো। তার কত স্বপ্ন ছিল আমাকে নিয়ে সুখের সংসার গড়বে। কিন্তু কীভাবে যে কী হয়ে গেল। একথা বলে পুনরায় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে মর্জিনাসহ মাটিতে বসে পড়ে। মর্জিনা বাবার মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, বাবা তুমি কাঁদলে আমি কী করে থাকি বলো? এসময় বাবা হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে যায়। মর্জিনা বাবাকে বলে, বাবা আমি মানুষের বাসায় কাজ করে মাসিক বেতন হিসেবে কিছু টাকা জমিয়েছি। সে টাকায় তোমার কাফনের কাপড় কিনে সেটা দিয়ে তোমার দাফন করার জন্য জেল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছি। তারা আমাকে কথা দিয়েছেন। আমার এটুকুই শান্তনা যে, আমার পরিশ্রমের টাকায় কেনা কাফনের কাপড় পরিয়ে তোমাকে দাফন করা হবে। একথা শুনে বাবা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে বলে, ওরে আমার মা জননী, কতই বা তোর বয়স। খুব বেশি হলে নয় বছর। অথচ এবয়সেই তুই তোর উপার্জনের টাকায় আমার কাফনের কাপড় কিনেছিস। এ ঋৃন আমি কীভাবে শোধ করবো বল?
সময় শেয হওয়ায় কারারক্ষী এসে মর্জিনাকে নিয়ে যায়। যাবার সময় বাবা দু'হাতে হাজতের শিক ধরে দাঁড়িয়ে মর্জিনার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কী যেন বলতে থাকে। মনে হয় মর্জিনার জন্য দোওয়া করছিল। এসময় তার দু'চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। বাবার অসহায় করুন চেহারা দেখে দুঃখে মর্জিনার বুক ফেটে যাচ্ছিল। যাবার সময় সে বারবার পেছন ফিরে বাবার স্নেহমাখা মুখখানি শেষবারের মতো দেখতে থাকে। আাহারে বাবাকে সে আর কোনোদিন দেখতে পাবেনা। বাবাকে ছেড়ে মর্জিনা যেতে চাইছিল না।
বাসায় ফিরে মর্জিনা না খেয়ে সারারাত নামাজ পড়ে বাবার জন্য দোওয়া করতে থাকে। পরেরদিন সকালে জেল কর্তৃপক্ষের সহায়তায় শেষ ইচ্ছানুসারে স্ত্রীর কবরের পাশে মর্জিনার বাবাকে দাফন করা হয়। বাবার গায়ে মর্জিনার দেওয়া কাফনের কাপড় জড়ানো ছিল। তার বাবা- মায়ের কবর পাশাপাশি। আর এটাই মর্জিনার একমাত্র পাওয়া যে, মৃত্যুর পর সে পুনরায় তার বাবা- মাকে পাশাপাশি করতে পেরেছে। কিন্তু মর্জিনার কান্না কখনও কী থামবে?
* ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম: লেখক, কবি, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা।
সাম্প্রতিক মন্তব্য