logo
news image

হৃদয়ে কত আকুলতা

ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম ।।
সকাল থেকেই আবিরের মন খারাপ। আজ বাবা দিবস। তার বন্ধুরা বাবাদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গেছে। অথচ সে চুপচাপ ঘরে বসে বাবার কথা ভেবেই চলেছে। তার ভাবনার যেন কোনো শেষ নেই। তাছাড়া বাবাকে নিয়ে ভাবতে তার খুব ভালো লাগে। আজ কেন জানি বাবার কথা তার খুবই মনে পড়ছে। তার জন্মের আগেই বাবা মারা যান। একারনে সবাই তাকে অপয়া বলে থাকে। আবির ভেবে পায়না এতে তার দোষ কোথায়? বাবাকে হারিয়ে সে তার মায়ের কাছ থেকেও পেয়েছে অবহেলা আর অনাদর। বড় হয়ে জেনেছে তার জন্মের সময় মাকে হাসপাতালে ভর্তি করে বাবা ঔষধ কেনার টাকা আনার জন্য বাড়িতে যান। ইতোমধ্যে মায়ের প্রসব বেদনার কথা জানতে পেরে বাবা দ্রুত হাসপাতালে আসার জন্য  মোটরসাইকেল যোগে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিন্তু দুঃখের বিষয় মা আর আমাকে দেখার সূযোগ হয়না। রাস্তায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তিনি ঘটনাস্থলেই প্রান হারান। মাকে বাবার মৃত্যুর খবর অনেক পরে জানানো হয়। বাবার জানাজার সময় আমার জন্ম। জন্মের পর থেকেই দুঃখ, ব্যথা, বেদনা তার নিত্যসঙ্গি।
মা বেশিদিন কাছে রাখেনি। একবছরের মাথায় আরেক জনকে বিয়ে করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। মায়ের অবর্তমানে নানি তাকে লালনপালন করেন। এবারেও আবিরের কপালে সুখ সয়না। তিনবছরের মাথায় নানিও তাকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমান। এতটুকু বয়সে আবিরের জীবনে বইতে থাকে অজস্র বেদনার ঝড়। মাসখানেক থাকার পর মামীর প্ররোচনায় মামা তাকে দাদির বাড়িতে রেখে আসে। একটু আদর পাবার জন্য আবিরের হৃদয়ে কত আকুলতা। কিন্তু দাদি তাকে দেখে বলে ওঠেন, এই হতভাগাকে এনেছিস কেন? এ আমার ছেলেকে খেয়েছে। তবুও দাদি কাছে টেনে নিলেও ছেলের অকাল মৃত্যুর জন্য সবসময় তাকে দোষারোপ করে অপরাধী ভাবেন। বাসায় চাচা কিছু না বললেও চাচী সুযোগ পেলেই তাকে গালমন্দ এবং কটু কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেনা।
জন্মের পর থেকে মা সহ সবার বিরূপ আচরণ আবিরের হৃদয়ে বেদনা জাগায়। এই ক'বছরে মা একদিনের জন্যেও তাকে দেখতে আসেনি। সে শুনেছে ইচ্ছে থাকা সত্বেও তার স্বামীর কারনে মা আসতে পারেনা। আবিরের জীবনে আবার নেমে আসে কালো মেঘ। দু'দিনের জ্বরে দাদি হঠাৎ মারা যান। দাদি মারা যাবার একমাসের মধ্যে চাচীর কুমন্ত্রণায় চাচা আবিরকে এতিম খানায় রেখে আসে। আর তখন থেকেই আবির এতিম হিসেবে বড় হতে থাকে।
আবিরের বয়স এখন বারো বছর।  সপ্তম শ্রেণির ছাত্র।দেখতে খুব সুন্দর। গায়ের রং ধবধবে সাদা,দুধে আলতায় মেশানো। মাথাভর্তি ঘনকালো লম্বাচুল। লম্বাচওড়া, হালকাপাতলা  গড়ন। স্বল্পভাষী কিন্তু কথাবার্তায় নম্র, ভদ্র এবং খুবই মার্জিত।  চলাফেরায় ধীরস্থির এবং শান্তস্বভাবের। লেখাপড়ায় অত্যন্ত মেধাবী। প্রতিটি পরীক্ষায় সে প্রথম স্হান অধিকার করে। অভিনয়, বক্তৃতা, আবৃত্তি, গান, খেলাধুলা ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই প্রথম পুরস্কারটি তার জন্য নির্ধারিত। একারনে এতিমখানার সবাই তাকে খুবই স্নেহ ও সমীহ করে। এবয়সে আবির জীবনকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখেছে।
নিঝুম রাতে চারিদিকে যখন শুধুই নিস্তব্ধতা তখন না ঘুমিয়ে আবির বাবাকে নিয়ে চিন্তা করে। বাবাকে সে দেখেনি এবং দেখার সুযোগও নেই। দাদির কাছ থেকে জেনেছে তার জন্মের আগে তাকে নিয়ে  বাবার  আনন্দের সীমা ছিল না। মাকে  প্রায়ই বলতেন,
সারাক্ষণ ছেলেকে কাছে রাখবেন, তাকে নিয়ে ঘুরবেন, কখনও ছেলের অযত্ন হতে দেবেন না। ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় ডাক্তার বানাবেন। আহারে তাকে নিয়ে বাবার কত আশা আর স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বাবার ইচ্ছেগুলো অপূরনীয় এবং আশা নিরাশাই থেকে যায়। বাবার কথা চিন্তা করতেই আবিরের দু'চোখ পানিতে ভরে অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।
আবির ভাবতে থাকে, বাবা বেঁচে থাকলে সে কতই না আদরযত্ন পেত। মাও তাকে ছেড়ে যেতনা। বাবার অবর্তমানে কী অবহেলা আর অনাদরই না সে পেয়েছে।  বাবার আদর পাবার জন্য তার মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে।  তার বাবা ছোট ছেলে- মেয়েদেরকে দেখলেই নাকি কাছে টেনে নিয়ে  আদর করতেন। আসলে নিজের ছেলেকে আদর করার সুযোগ পাবেন না বলে বিধাতা বাবাকে দিয়ে এমনটি করিয়েছেন। এক্ষেত্রে বাবা নয় তারই দুর্ভাগ্য। বাবার কথা ভাবতেই আবেগাপ্লুত হয়ে পুনরায় আবিরের দু'চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে।
মা'র সম্পর্কে আবির একেবারেই নীরব। জন্মের পর তাকে ফেলে চলে যাওয়াটা কী মায়ের উচিত হয়েছে?  আর কেনই বা তাকে দেখতে আসেনি বা তার খোঁজ রাখেনি? আবির পরে জেনেছে মায়ের নতুন ঘরে নাকি অনেক সন্তান। একারনে হয়তো বা মা তার অভাব অনুভব করেনি। এতকিছুর পরও আবির তার মা সম্পর্কে বিরূপ কিছু ভাবেনা বরং মায়ের জন্য সবসময় দোওয়া করে। তার মা যেখানেই থাক সেখানে যেন সুখেই থাকে।
 আবির বাবার কবরে যায়। কবর দেখার পর সে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। আবেগে কবর জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। অশ্রুভরা চোখে বলে,  বাবা তোমার অবর্তমানে আমি এখন এতিমখানায়।  কারো বোঝা হয়নি। আমার জন্মের আগেই তুমি চলে গেছ না ফেরার দেশে। একারনে তোমাকে দেখার সুযোগ হয়নি। শুনেছি আমার আগমন উপলক্ষে তুমি নাকি আমার ভালমন্দ নিয়ে সবসময়ই চিন্তা করতে। অথচ আমার আসার আগেই তুমি আমাকে ফাঁকি দিয়ে স্বার্থপরের মতো চলে গেছ না ফেরার দেশে। বাবা,  আমি কী তোমাকে খুবই জ্বালাতন করতাম? তোমার কী ইচ্ছে হয়না আমার আদর নিতে?  তবে কেন এমন হলো?
আবির বড় হয়ে জেনেছে, যেদিন বাবা ডাক্তারের কাছ থেকে শুনেন তার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা, সেদিন আনন্দে আত্মহারা হয়ে অফিস থেকে আসার সময় অনেক  মিষ্টি এনে পাড়ার মধ্যে বিলি করেন। উত্তেজনায় বাবা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে সন্তানের নাম কী রাখবেন তা নিয়ে মায়ের সাথে আলোচনা করেন। পরে সে শুনেছে,বাবা নাকি ওইরাতে ৫টি ছেলের এবং ৫টি মেয়ের নাম পছন্দ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় বাবার ওই নাম বাদ দিয়ে মা তার ইচ্ছেনুযায়ী নাম রাখেন যা আবিরের পছন্দ নয়।
আবির তার দাদির কাছে আরও শুনেছে, আরেকদিন বাবা তার মঙ্গলের জন্য অফিস শেষে ৫ কি.মি. দূরে এক হুজুরের কাছে যান। সময়মতো হুজুরকে না পাওয়ায় তাবিজ নিয়ে ফিরতে অনেক রাত হয়। ঝড়বৃষ্টির কারনে রিকশা না পাওয়ায় বাবা ওই রাতে বৃষ্টিতে ভিজে হেঁটেই বাড়িতে ফেরেন। তাবিজ মায়ের হাতে দিয়ে বলেন জন্মের পর যেন তাবিজটি আমার মাথার বালিশের নীচে রাখা হয়। বৃষ্টিতে ভিজার কারণে বাবাকে একসপ্তাহ জ্বরে ভুগতে হয়। ছুটি পাওনা না থাকায় বাবা জ্বর নিয়েই অফিস করেন। তার জন্য এতো কষ্টের কথা শুনে বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধায় আবিরের মাথা নত হয়ে আসে। বাবাকে তার খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। দু'চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে অজস্র অশ্রু। ইস্ তার জন্য বাবা কী কষ্টটাই না করেছে?
আবির পেটে থাকতে বাবা মাকে প্রচুর খাওয়াতেন। মা খেতে না চাইলে বাবা বলতেন, আরে তোমার সাথে সাথে আমি আমার সন্তানকেও খাওয়াচ্ছি। আর যদি খাওয়ানোর সূযোগ না হয়। বাবার কথাই সত্যি হয়েছে।তার জন্মের আগেই বাবা চিরদিনের জন্য চলে যাওয়ায় তাকে খাওয়ানোর সুযোগ হয়নি। একথা ভেবে আবিরের দু'চোখ পুনরায় পানিতে ভরে ওঠে।
আবির আরও জেনেছে, মায়ের পেটে যখন নয় মাস তখন একদিন বাবা বাজার থেকে তার জন্য অনেক জামাকাপড়, খেলনা, দোলনা, বিভিন্ন ধরনের বেবি ফুড ইত্যাদি কিনে আনেন।এই কান্ড দেখে মা বাবার ওপর খুব রাগ করে। যার দরুন অভিমানে বাবা ওই রাতে না খেয়েই কাটিয়ে দেন। আহারে বাবা তার জন্য কী কষ্টই না পেয়েছে। নিজেকে আবিরের অপরাধী মনে হয়। বেঁচে থাকলে সে বাবাকে অনেক আদরযত্ন করে সেই কষ্টের শোধ দিত। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। বাবা তো ধরাছোঁয়ার অনেক উর্ধ্বে। তাই  কবর জড়িয়ে ধরে বাবাকে অনেক আদর করে। এ আদরের যেন কোনো শেষ নেই।
আবির  কবর ধরে  অনেক দোওয়া করে যেন তার বাবা কবরে চিরশান্তিতে থাকেন। বাবার সাথে তার সম্পর্ক অদৃশ্য সুতার বন্ধনে চিরকাল বাঁধা। অনেকক্ষন থাকার পর আবির বাবার কবর থেকে ক্লান্ত পাখির মতো ফিরে আসে। আসার সময় পেছন ফিরে বাবার কবর দেখে জানায় হৃদয় নিংড়ানো বিনম্র শ্রদ্ধা।
* ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম: লেখক, কবি ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top