logo
news image

সব খোলা শুধু উচ্চশিক্ষায় অপরিহার্য ফটক বন্ধ

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
এইচএসসি হলো উচ্চশিক্ষার ‘গেটওয়ে’ বা প্রবেশ দ্বার। এজন্য এই পরীক্ষাকে অপরিহার্য পাবলিক পরীক্ষা নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর জীবনের লক্ষ্য কী তা এইচএসসির-র পর নির্ধারণ করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য লড়াইটাও এ সময় করতে হয়।
তবে করোনার আপদকালে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিস্থিতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে পৃথিবীর সকল দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। উন্নত দেশগুলো সুকৌশলে এই বিপদ মোকাবেলা করতে পারলেও আমাদের যথার্থ প্রস্তুতি নেই। আমরা হঠাৎ করে জেএসসি ও এসএসসি-র ফলাফলের ভিত্তিতে এবারের এইচএসসি-র ফলাফল তৈরী করার ঘোষণা দিয়েছি। সাতমাস গত হতে চললেও আমরা সিদ্ধান্ত নিতে নিতে শেষ পর্যন্ত সাধারণভাবে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের মূল ফটক বন্ধ করে দিয়ে ফেলেছি।
অবশ্য যারা শহুরে বিত্তশালী এবং দেশের মধ্যে থেকেও বিদেশী সিলেবাস বা কারিকুলামে সন্তানদেরকে শিক্ষাদান করান তাদের কথা ভিন্ন। এ লেভেল বা ও লেভেলের পরীক্ষা ঠিকই সম্পন্ন করা হয়েছে। তারা বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে যেতে হয়তো কোন বাধা থাকবে না। কিন্তু সমস্যা হলো যারা আমাদের দেশের সাধারণ শিক্ষার্থী তারা বিদেশী বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কিভাবে মূল্যায়িত হবে অথবা আদৌ হবে কি না- তা এখনও আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। এছাড়া এইচএসসি-তে মানোন্নয়ন করতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের জন্য এই সমীকরণ বেশ জটিল ও বেদনাদায়ক।
এদিকে বলা হচ্ছে- আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি কার্যক্রম চালানোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইউজিসি গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিতে আগ্রহী। বড় বড় পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলো সেটাতে আগ্রহী নয়। তাই তাদেরকে বাদ দিয়ে বাকী বিশ^বিদ্যালয়গুলোকে বিভিন্ন ক্যাটাগরী করে গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেয়ার চিন্তাভাবনা হচ্ছে। আভাষ দেয়া হয়েছে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হতে পারে আগামী জানুয়ারী মসে। সেটা নির্ভর করবে আসন্ন শীতকালে আমাদের দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হালচাল পর্যবেক্ষণ করার পর। সবমিলিয়ে বলা যায়, উচ্চশিক্ষায় ভর্তির বিষয়টি এখনও অনেকটা সার্বিক পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল।
এখন এই অস্থির সময়ে একটা অসাধারণ ও পরীক্ষামূলক ভর্তি পদ্ধতি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। তাছাড়া ভর্তিপরীক্ষার প্রন্তুতি নিতে শিক্ষার্থীরা কোচিং-এর দ্বারস্থ হতে থাকলে এবং স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘিত হতে থাকলে উভয়মুখী বিপর্যয় ও নতুন সংকট সৃষ্টি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে অনলাইন ক্লাশের মত ঘরে বসে বিশেষ কুইজের মাধ্যমে ‘ডিজিটাল গবেষণা প্রশ্নপত্র’ পূরণ করার মত অথবা স্বল্পসময়ে অনেকগুলো প্রশ্ন পাঠিয়ে দিয়ে পরীক্ষা নেয়ার মাধ্যমে ভর্তি করানো যেতে পারে। তাহলে পরীক্ষার্থীকে আর ঘরের বাইরে এসে ভর্তি পরীক্ষার জন্য ছোটাছুটি করতে হবে না। এভাবে কোভিড বেড়ে গেলেও ভর্তি পরীক্ষা নিতে সমস্যা হবার কথা নয়।
স্ক্রিপ্ট মূল্যায়ণে অটো সফটওয়্যার ব্যবহৃত হলে পরীক্ষার্থী প্রশ্নপত্র পূরণের পর জমাদানের সঙ্গে সঙ্গে তার মোট প্রাপ্ত স্কোর পাওয়া যেতে পারে।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশ এডুটেক যুগে পুরোপুরি প্রবেশ করলেও আমরা এখনও দ্বিধায় রয়েছি। আমাদের পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে ভার্চুয়াল ক্লাসে উপস্থিতির হার এখনও শতকরা ত্রিশের ঘরে। এর কারণগুলো জানা গেলেও এখনও সেগুলোর উপযুক্ত সমাধান করার জন্য উদ্যোগের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এদিকে দেশের সরকারী বেসরকারী সব ধরণের অফিস, ব্যাংক, আদালত, পরিবহন প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়নি। রাস্তাঘাট, বাজার, বিপণী সবজায়গায় মানুষ গিজ গিজ করছে। পোশাকশিল্প, কল-কারখানায় মানুষ কাজ করছে। মানুষ মসজিদ, মন্দির, হোটেল-রেঁস্তোরায়, সিনেমায় যাচ্ছে। মাদ্রাসায় পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা হয়েছে। এখন সব সচল, মনে হচ্ছে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশের বিষে নীল হয়ে আছে। সবকিছু খুলে দিলেও স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয় কেন বন্ধ রাখা হয়েছে তা বোধগম্য নয়।
অনেকে বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা ইত্যাদি ঘটনা দেশে একটি খারাপ নজির তৈরী করেছে। এছাড়া প্রতি শতাব্দীর বিশসাল এলে একটি বিপর্যয় ঘটে- এরূপ কুসংস্কার থেকে ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণের প্রভাবের ওপর শতাব্দীর নানা গুজবের প্রেক্ষিতে যে উত্তেজনা ছড়িয়েছে তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে আরো বেশী ভস্মে ঘি ঢেলে দিতে পারে। যেটা অতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এসব চিন্তা-ভাবনা কুসংস্কার না বাস্তবতা নাকি এর পিছনে অন্য কোন কিছু জড়িত আছে তা অনেকেই একটু চিন্তা করলে ভালভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন বলে মনে হয়।
তবে যেটাই ভাবা হোক না কেন, গেল সেপ্টেম্বরে সারা পৃথিবীতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার মানুষ করোনায় মৃত্যুবরণ করছেন। এখনও প্রতিদিন সংক্রমিত হচ্ছেন অগণিত মানুষ। অক্টোবর ১০, ২০২০ পর্যন্ত মারা গেছেন দশ লাখ সাতষট্টি হাজার এবং আক্রান্ত হয়েছেন তিন কোটি আটষট্টি হাজার মানুষ। তবে বিশ^ স্বাস্থ্যসংস্থার অনুমান, এপর্যন্ত পৃথিবীর আশি কোটি মানুষ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন। বহু মানুষ আক্রান্ত হয়ে নানা কুসংস্কারের ভয়ে নিজেদেরকে গোপন রেখেছেন। অনেকে অজান্তে আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে আরোগ্য লাভ করলেও নানা জটিলতায় ভুগছেন।
অনেক দেশে দ্বিতীয় ঢেউ এখনও শুরু হয়নি। তাই নতুন বিপর্যয়ের বড় একটা আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এত কিছুর মাঝেও জীবন-জীবিকা নিয়ে বাঁচার জন্য করোনাকে সাথে নিয়েই আমাদের প্রতিদিনের ঘরকন্না চালাতে হবে। সেজন্য সবকিছু খুলে দিয়ে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে বিকল্প কোন ভাল সমাধান আশা করা সমীচিন হবে না। বরং শিশু-কিশোররা তাদের প্রতিষ্ঠানে আসুক, পড়ুক, খেলুক, দেীড়াদৌড়ি করুক, বুক ভরে খোলা বাতাস নিক, প্রাণ খুলে গল্পকরুক এবং ভাল থাকুক। কোটি কোটি কোমলমতি শিশু-কিশোর ও শিক্ষার্থীদের সার্বিক সুস্থতার জন্য ঘরের ভেতর-বাহির সবজায়গায় ইতিবাচক কাজে ব্যস্ত রাখাই যুক্তিযুক্ত। কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা সামনের দিনগুলোতে কমুক বা বাড়ুক উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের অপরিহার্য ফটক বন্ধ না করে একটি গ্রহণযোগ্য ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেবার প্রস্তুতির জন্য আজকেই কাজ শুরু করে দেয়া দরকার।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top