logo
news image

নারী ঘরে-বাইরে সর্বত্র কেন নিরাপদ নয়?

ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম।।
আমাদের দেশে প্রতিদিন কত নারী যে ধর্ষনসহ বিভিন্ন  ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তার সঠিক হিসেব না থাকলেও এটা নিশ্চিত যে নারীর প্রতি নির্যাতন প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে। যার উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি সিলেট ও নোয়াখালীর ঘটনাসমূহের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
জাতিসংঘ ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর নারীর প্রতি সবধরনের সহিংসতা বন্ধ করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৮১ সালে লাতিন আমেরিকায় নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ বিষয়ক এক সম্মেলনে ২৫ নভেম্বরকে আন্তর্জাতিক নারী প্রতিরোধ দিবস পালনের ঘোষনা দেওয়া হয়। দিবসটি স্বীকৃতি পায় ১৯৯৩ সালে বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলনে। ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘ দিবসটি পালনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়।
১৯৯৪-৯৫ সালে কায়রো এবং বেইজিংয়ে নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল নারীর  প্রতি সহিংসতা কমানো। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বাংলাদেশে যে সমস্ত আইন রয়েছে তা হলো - এসিড সন্ত্রাস আইন -২০১২,  বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন- ১৯২৯, যৌতুক প্রতিরোধ আইন - ১৯৮০,  নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন -২০০০ ( সংশোধনী ২০০৩),  পারিবারিক সহিংসতা আইন -২০১০, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ  আইন ২০১২, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি - ২০১১, ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ- ১৯৭৬,  বাংলাদেশ দন্ডবিধির ২৯৪, ৪৯৩ এবং ৫০৬ ধারা।
কিন্তু এত আইন থাকা সত্বেও নারী ঘরে-বাইরে  সর্বত্র কী নিরাপদ হতে পেরেছেন? নির্মম হলেও সত্য যে তারা নিরাপদ হতে পারেননি। বন্ধ হয়নি নারী নির্যাতন। এসিড সন্ত্রাস, যৌন নির্যাতন, ইভটিজিং, যৌতুক, ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা, পারিবারিক সহিংসতা, অপহরণ, পর্নোগ্রাফী ইত্যাদির মাধ্যমে তারা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। জাতিসংঘের তথ্য মতে বিশ্বের ৩৫ শতাংশ নারী তার জীবদ্দশায় মানসিক বা শারিরীক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশের ৮৭ শতাংশ  বিবাহিত নারীই আপন গৃহে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হন।
ধর্ষন একটি সামাজিক ব্যাধি। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে এই ব্যাধি ক্রমশ: বেড়েই চলেছে। ধর্ষনের ঘটনা সমাজে অহরহই ঘটে যাচ্ছে যার অনেক খবর জানা যায়।আবার অনেক ঘটনা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়। ধর্ষন মামলায় অগ্রসর হলে নিরাপত্তার ঝুঁকির সাথে সাথে ধর্ষিতাদের সামাজিক মর্যাদা এবং ব্যক্তিগত ক্ষতিও জড়িত থাকে। অবিবাহিত নারী হলে তার বিবাহ অনিশ্চিত হয়, বিবাহিতা হলে তার বিবাহিত জীবনে নেমে আসে অশান্তির কালোছায়া। আর্থিক অসঙ্গতি, চক্ষুলজ্জা, সমাজের অগ্রহনযোগ্যতা, আইনের প্রতি অনাস্থা, ক্ষমতার অভাব ইত্যাদি কারনে অধিকাংশ ধর্ষন অপ্রকাশিত থাকে। আবার অনেকেই লোকচক্ষুর ভয় এবং লজ্জায় মামলা করার জন্য থানায় যেতে অনীহা প্রকাশ করেন। ফলে ধর্ষন মামলার প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব হয়না। মুল্যবোধের ও সামাজিক অবক্ষয়, বিকারগ্রস্হ রুচি, পরমতসহিষ্ণুতার অভাব, মাদকাসক্ত, ধৈর্য লোপ পাওয়া ইত্যাদি কারনে মানুষ সহিংস হয়ে উঠছে।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায়ই অর্ধেক নারী এবং সমাজ উন্নয়নে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু তারপরও সাধারণভাবে তারা শান্তি, নিরাপত্তা ও অধিকারের দিক দিয়ে এখনও পুরুষদের সমকক্ষ নয়। অথচ এই নারীর কারনেই একটি সন্তান পৃথিবীর আলো দেখতে পায়, একটি সুন্দর জীবনের সূচনা হয়। নারীদের জীবন আমাদের এই সমাজে শুধুই একজন নারী হিসেবে চিন্হিত। একজন নারীকে শুধু নারী হিসেবে নয় বরং মানুষ হিসেবে তার মান-মর্যাদা এবং সত্বার দিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যানুযায়ী, প্রতিবছর ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলাগুলোর মধ্যে  নিষ্পত্তি হয় চারভাগেরও কম মামলার। আর সাজা পায় হাজারে মাত্র চারজন। আইনের ত্রুটি, ত্রুটিপূর্ন তদন্ত, ফরেনসিক টেষ্টের সীমাবদ্ধতা, প্রভাবশালীদের চাপ এবং সামাজিক কারনে এরকম হচ্ছে বলে মনে করে ধর্ষণের শিকার নারী ও তার পরিবারকে আইনী সহায়তা দেওয়া মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি, দীর্ঘবিচারসূত্রিতা ইত্যাদি কারনে বাদীপক্ষ অনেক সময় ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত হন। অনেক সময় ধর্ষণ মামলায় সমাজের উচ্চবিত্ত প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় অভিযুক্তদের সাজা নিশ্চিত করা কঠিন হয়। ধর্ষণের বিচারহীনতার কারণ হিসেবে বাদীপক্ষ এবং আদালত পুলিশের তদন্তে গাফিলতি এবং ত্রুটির প্রসঙ্গটি বরাবরই সামনে আনেন। থানায় মামলা করা থেকে শুরু করে ভিকটিমের সঙ্গে আচরণ, তদন্ত এবং অপরাধীকে গ্রেফতার ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। এটা ঠিক কখনও কখনও কিছু অসৎ পুলিশ কর্মকর্তা তদন্তে গাফিলতি প্রদর্শন কিংবা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। তাই বলে ঢালাওভাবে পুলিশকে দাযী করা ঠিক হবেনা।
অনেক সময় বাদি এবং সাক্ষিগন আসামিদের দ্বারা প্রভাবিত হন। সেক্ষেত্রে বাদি মামলা চালাতে অপরাগ হন কিংবা আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য হাজির হননা। আবার হাজির হলে ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করেন। তাদের এধরনের ভূমিকায় আসামিরা পার পেয়ে যায়। তাছাড়া ধর্ষকরা প্রভাবশালী হলে তারা বাদীকে নানাভাবে প্রভাবিত করে মামলায় সমঝোতার চেষ্টা করে। কখনও ধর্ষণের শিকার নারী ও তার পরিবার সামাজিক মান-মর্যাদার ভয়ে ঘটনাটি চাপা দেয়। ফলে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না। তার এই সুযোগে আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের থেকে শুরু করে প্রতিটি জায়গায় একজন নারীকেই প্রমান করতে হয় যে তিনি ধর্ষিত হয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে ধর্ষিতা নারী বেশিদিন তার মনোবল ধরে রাখতে পারেন না। উপনিবেশিক অনেক আইনের হাত থেকে আমাদের নিষ্কৃতি মিললেও ধর্ষনের প্রমান দিতে হবে নারীকে। অথচ বিভিন্ন দেশে যার কিংবা যাদের বিরুদ্ধে এমন ঘৃন্য অপরাধের অভিযোগ আসে, তাকেই প্রমান করতে হয় সে নির্দোষ। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মামলার ত্রুটি বিচ্যুতি,  আইনের ফাঁক - ফোকর ইত্যাদির কারনে ধর্ষিতা নারী সঠিক বিচার পান না। মামলার তদন্তে ত্রুটি এবং গাফিলতি ও অবহেলা ছাড়াও এর পেছনে কাজ করে নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙী ও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা।
বিচারহীনতার কারণে ধর্ষণের সংখ্যা আরও বেড়ে চলেছে। বিশেষ কারন দেখিয়ে বাড়তি সময় নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় মামলা শেষ হতে বহুবছর লেগে যায়। এক্ষেত্রে ভিকটিম বারবার ধর্ষণের বিবরন ও প্রমান উপস্থাপন করতে গিয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান, দ্বিতীয়বার ধর্ষিত হন। থানায় মামালা নেওয়ার সময় বা আসামিপক্ষের আইনজীবী যেভাবে প্রশ্ন করেন তখন ওই নারী আবারও ধর্ষণের বীভৎস অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। অনেকে একঘরে হয়ে পড়েন। একটা সময় তার মধ্যে বিচার পাওয়া নিয়ে হতাশা শুরু হয়। আদালতে যাওয়া বন্ধ করে দেন ভিকটিম। এসব কারনেই মুলতঃ আসামিরা পার পেয়ে যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে মামলা থাকা অবস্থায় মাঝপথে বাদিপক্ষ আদালতের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। এমতাবস্থায় পুলিশের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করে জানা যায়, বাদিপক্ষ আসামিপক্ষের  সঙ্গে বিয়ে বা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সমঝোতা করে ফেলেছেন।
ঘরে-বাইরে  পথে- ঘাটে সবজায়গায় নারী নিগৃহীত হয়। এ অবস্হাকে চলতে দিলে নারী কখনোই নিরাপদ থাকবেনা। অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে জনসম্মুখে আনা দরকার। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি করে অপরাধীর কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করতে হলে আমাদের দৃষ্টিভঙীর পরিবর্তন করে সামাজিক সচেতনতা ও নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। আমাদের সামাজিক অবকাঠামোও নারী নির্যাতনের অন্যতম কারন। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারনে অপরাধীরা সাজা পায়না বলেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একে সহজ ও স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই ধরে নিয়েছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বা বিচার হলে সামাজিক এই দৃষ্টিভঙিও ধিরে ধিরে পাল্টাবে। নারী নির্যাতন রোধে চাই কঠোর প্রতিবাদ ও সামাজিক আন্দোলন। নারী নির্যাতনকারীদের সনাক্ত,প্রতিরোধ ও বিচারের দাবীতে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনসাধারণকে সোচ্চার হতে হবে। প্রতিটি ঘটনার জন্য দায়ী অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কেবল তখনই  নারীদের বিষয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙি পাল্টাবে।
ধর্ষন অত্যন্ত অমানবিক এবং ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। ধর্ষন একটি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। ধর্ষিতা নারীর প্রতি গ্রহণ করতে হবে মানবিক দৃষ্টিভঙি। খেয়াল রাখতে হবে যে নারী অন্যায়- অপমানের শিকার হয় তাকে কেউ যেন নতুন করে আঘাত না করে। তার মানবাধিকার নতুন করে যেন লঙ্ঘিত না হয়। আইনের মাধ্যমে ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত হলে এধরণের অপরাধ কমে যাবে। আইনের শাসন এমন হতে হবে যেখানে ধর্ষক যেন কোনো আশ্রয়- প্রশ্রয় না পায়। পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এ অপরাধকে প্রতি রোধ করতে হবে।
অপরাধীর দ্রুত ও দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি না হওয়াতে দুর্বৃত্তদের সাহস ক্রমেই বেড়ে চলে। নারী নির্যাতন রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনির কঠোর ভূমিকা প্রয়োজন। নারী নির্যাতন রোধে প্রশাসন ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্হা দায়িত্বশীল,  আন্তরিক , আইনানুগ ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবেন, এমনটাই প্রত্যাশা ভুক্তভোগীদের। আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি নির্যাতন রোধে পরিবার,  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে  ঐক্যবদ্ধ সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। তবেই নারী ঘরে-বাইরে  সর্বত্রই হবে নিরাপদ।
* ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম: কবি, লেখক, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top