logo
news image

চোরের থাপইত

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
কথায় বলে- চোর শ্বশুরবাড়ি গেলেও নাকি চুরি করে। কারণ, চোরের অন্তরে বিষের হাঁড়ি বিরাজমান। সে আপন-পর মানতে জানে না। তবে, চোর কিন্তু হুট করে কোথাও চুরি করতে যায় না। এজন্য তার প্রস্তুতি নিতে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন হয়। গৃহস্থের সব তথ্য গোপনে সরবরাহ করে যে ব্যক্তি চোরকে চুরি করতে সাহায্য করেন তিনি চোরের সোর্স বা ‘থাপইত’ নামে অভিহিত। থাপইত সাহেব গৃহস্থের বাড়ি রেকি করেন, বাড়িতে মানুষের সংখ্যা ও বয়স কত, কে কোন ঘরে থাকে, কখন ঘুমায়, রাতে ক’বার জাগে- উঠে ইত্যাদি জেনে ফেলে। এছাড়া গৃহস্থ তার টাকা-পয়সা, সোনা-দানা কোথায় রাখে, বাড়িতে কুকুর আছে কি-না, থাকলে কয়টা সে তথ্যটাও চোরকে সরবরাহ করে।
আশেপাশের সব গ্রামে, মহল্লায় চুরি হয় তার বাড়িতে হয় না। কিছুদিন পর পর পাড়ার মানুষ চুরি হয়ে গেল- সব ধুয়ে নিয়ে গেল বলে হা-হুতাশ করেন। কিন্তু তাকে কখনও সেসব করতে দেখা যায় না। কারণ, তার বাড়িতে কখনও চোর ঢুকেনি, ঢোকার কথাও না। তিনি মাঝে মাঝে চোরদেরকে নিয়ে সাফাই গান।
এতে বুঝা যায় তিনি চোরের থাপইত। এটা নিশ্চিত- তিনি চোরের হয়ে কাজ করেন। তিনি চোরের সোর্স বা ইন্ধনদাতা, যেটাকে অনেক জেলায় আঞ্চলিক ভাষায় ‘থাপাত’ বা ‘থাপইত’ বলা হয়। চোরের থাপইতরা ঘরে বসেই চোরের কাছ থেকে নিয়মিতভাবে চুরি করা দ্রব্যের ভাগ পান।
চোরের থাপইত হবার কারণে চোরোর তাকে খুব সমীহ করে। তার গুনগান করে। তাকে চুরি করা মালামাল, টাকা-পয়সা, সোনা-দানা বিক্রির ব্যবস্থা করে, অর্থের ভাগ দেয়। তিনি চোরদের মহান আশ্রয়দাতা। চোরদের সুখে দু:খে সাহায্য করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। চোরের থাপইত হলো বড় চোর, অভিজাত চোর।  এরা বড়ই ধূর্ত প্রকৃতির। সবসময় ইস্তিরি করা ফক্ফকে জামাকাপড় পরিধান করে স্মার্টভাবে চলাফেরা করেন। মুখে মুচকি হাসি, ঠোটে দামী সিগারেট লাগিয়ে মানুষের সাথে কিছুটা ভেংচি কেটে কথা বলার চেষ্টা করেন এবং কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে না বোঝার ভান করে এড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যান।
গ্রামাঞ্চলে চোরের এসব ইন্ধনদাতা ও প্রশ্রয়দাতাকে যুগ যুগ ধরে মানুষ চেনে থাপইত নামে। তবে চোর ও চুরির নেপথ্যে থাকা এসব নায়কদেরকে বিশেষ সাঙ্কেতিক চিহ্ন দিয়ে সম্বোধন করা হয। দেশের একেক এলাকায় তাদের একক আঞ্চলিক নাম ও উপাধি রয়েছে। শহরাঞ্চলে তাদেরকে আধুনিক ইংরেজি নামে ডাকা হয়ে থাকে। বিগ বস, সামুরাই, রত্নাই, লিনাক্স, গোয়েন্দা, সোর্স, গ্যাংলিডার ইত্যাদি ছাড়াও বড়ভাই নামটি এখন জায়গা করে নিয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে তারা বিভিন্ন দেশের কোড সম্বলিত মাফিয়া লিডার নামে পরিচিত।
থাপইতে ভরপুর পৃথিবী। এদের সাহায্য নেয়া ব্যতিরেকে কোন সংস্থাই চলতে পারে না। এদের নিকট থেকে বুদ্ধি ও পরামর্শ ধার নেয়া হয়। এসব বুদ্ধি অর্থ ও স্বার্থ সিদ্ধির বিনিময়ে বেচা-কেনা চলে।
পেশাদারী থাপইত ও অপেশাদারী থাপইত উভয় নামে এদের বিচরণ দেখা যায়। পেশাদার থাপইতরা দক্ষ ও সৎ হলে সমাজের কিছুটা কল্যাণ হয়। অপেশাদার থাপইতরা দায়বদ্ধতা না থাকায় অনৈতিক কাজে জড়িয়ে গিয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। এরা নিজের কল্যাণ করতে গিয়ে সমাজের অকল্যাণ করে এবং মানুষের কষ্ট ও দুর্ভোগ বাড়ায়। তবে পেশাদার ও অপেশাদার উভয় ধরণের অশিক্ষিত, অদক্ষ, অনৈতিক কাজের জন্য নিয়োজিত থাপইতে ভরে গেছে চারদিক। ফলে তারা দুর্নীতিবাজদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে সব জায়গায় জটিল সমস্যা সৃষ্টিতে সহায়তা করছে।
এরা অন্যায়ের সহযোগী হয়ে চরম বেপরোয়া হয়ে পড়ে। প্রচলিত ক্ষমতা কাঠমোকে পঙ্গু করে দিয়ে নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে দুর্বল ক্ষমতা কাঠামো একসময় ওদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে এবং অসহনীয় জনদুর্ভোগ জনআন্দোলনের মত খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এরূপ অবস্থা তৈরী হলে থাপইতরা গা ঢাকা দেয় অথবা পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। এভাবে জালিয়াতি করে ক্ষমতা ও দায়িত্বের পালাবদলের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। এসব চোরের থাপইতদের নানা প্রকৃতি ও ধরন চোখে পড়ে।
ঠিকাদারী কাজে থাপইত- একজনের ট্রেড লাইসেন্স অন্যজনকে টাকার বিনিময়ে ব্যবহার করার সুয়োগ করে দেয়। কখনও কখনও ঘুষ দিয়ে কাজ পেতে সহায়তা করে এরা। বিনিময়ে নিজে কাজ না করে ঘরে বসে বখরা আদায় করে থাকে।
নিয়োগে থাপইত-  ক্লাইন্ট খুঁজে এনে অবৈথভাবে অর্থ আদায় করে দেয়ার ব্যবস্থা করে এরা। এজন্য ক্লাইন্টের সাথে চুক্তি করে থাকে তারা। তবে কোন কারণে বনিবনা না হলে লোকমুখে অথবা গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয় এদের অবৈধ কর্মকান্ড। এদের বিভিন্ন পর্যায়ে ধাপে ধাপে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক থাকে। আজকাল অনলাইনে এসব কর্মকান্ডের ঘটনা দ্রুত বেশী বেশী জানা যায়।
ছ্যাচ্চোর থাপইত- এরা বার হাত বাঙ্গি, কিন্তু এদের বিচি তেরহাত। এরা ভয়-ভীতি দেখিয়ে মানুষের কাছে অর্থ আদায় করে নিজেরা প্রতারণা করে নিজেদের নিয়োগকর্তাকে প্রতারিত করে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ায়। এরা নিজেদের মান-সম্মান নিয়ে চিন্তা করে না।
হোয়াইট কলার থাপইত- এরা শিক্ষিত, কিন্তু ধূর্ত ও শয়তানের তল্পিবাহক। তারা বিশেষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে ক্ষমতাধর হয়। রাতকে দিন ও দিনকে রাত করতে সিদ্ধহস্ত। মিথ্যা, প্রতারণা ও জালিয়াতি করে। অনেক ক্ষেত্রে তারা সঠিক জন-মানুষের হক বা প্রাপ্য নষ্ট করে। প্রশাসনে ও রাজনীতিতে পৃথিবীর বহু দেশে যুগে যুগে আসল মানুষের ন্যায্য অধিকার খর্বিত হয়ে থাকে এদের দ্বারা। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রশ্রয়দানকৃত থাপইতরা অনেক সময় বেপরোয়া হয়ে অন্যায় কাজে শামিল হয়ে পড়ে। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্র হয়ে পড়ে দুর্বল ও অস্থিতিশীল।
থাপইতের খনি কোথায় নেই? মাদক সম্রাট এক ধরণের থাপইত। অপরাধ জগতের থাপইতরা সবধরনের অপরাধমূলক কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবে মাদক থেকে মারামারি, হত্যা, গুম, খুন ইত্যাদির সূচনা করে। পৃথিবীর সব জায়গায় এদের অবাধ বিচরণ রয়েছে।
অনলাইন কাজের যুগ শুরু হওয়ায় সাইবার জগতে এদের পাখার ঝাপটা এত বেশী তা সহ্য করার মত দক্ষতা ও জনবল সনাতনী প্রশাসনের নেই। আমাদের সনাতনী আমলাতন্ত্র চলে ডালে ডালে আর ডিজিটাল থাপইতদের বিচরণ পাতায় পাতায। কারণ, তারা এই জগতে অত্যন্ত মেধাবী, দক্ষ ও  তরুণদেরকে উচ্চবেতনে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে দ্রুত কাজে লাগায় যেটা সনাতনী আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, ফলে ফাঁরাক হয়ে গেছে দুস্তর।
তাইতো গৃহস্থের বাড়ি চুরি থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রের বড় বড় ব্যাঙ্কের ভল্ট থেকে সোনা চুরির ক্ষেত্রেও আধুনিক চৌকষ থাপইতরা অতিদ্রুত কৌশলে হস্তক্ষেপ করে সবকিছু শুন্য করে দিতে পারঙ্গম হচ্ছে।
সাইবার থাপইতদের মাধ্যমে গোপন তথ্য বিনিময়ের এই ভয়ংকর অবস্থা সারা পৃথিবীর গোপন কাজের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বড় ধরণের হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
আজকাল সারা বিশ্বে থাপইতদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন তাদেরকে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কাজে আরো উৎসাহিত করেছে। আমাদের দেশও এটার ব্যতিক্রম হয়নি। অচিরেই এরা ভয়ংকর দিনের সূচনা করতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। করোনকলীণ দুর্বল সময়ে এরা নিজেদের ক্ষমতাকে আরো বেশী অনৈতিক পথে কাজে লাগানোর জন্য তৎপর হয়ে উঠায় বেশী বিপদের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আমাদের ঘুন ধরা সমাজে এরা দিন দিন সংখ্যায় বেড়ে যাওয়ায় চারদিকে উদ্বেগ বেড়ে গেছে। এদেরকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
অতি প্রাচীনকাল থেকে অভিবাসী মানুষকে নতুন এলাকায় নিজ ভিটার পাশে বসতি গড়ে থাকত দেয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। অনেকে ধর্মদায় দিয়ে ধর্মবাপ-মা ডেকে সহানুভূতি অর্জন লাভের মাধ্যমে একসময় নতুন পরিবারের মধ্যে একান্ত আপনজনের মর্যাদা লাভ করতো। তখনকার দিনে অব্যবহৃত জমিজমা বেশী থাকায় সেগুলো দান করার মাধ্যমে মানুষকে সহায়তা করে সমাজে ভারসাম্য আনয়ন করা হতো।
বর্তমানে সেই সুযোগ নেই। তাই তাদেরকে অনাহুত ভাবা হয়। কখনো অনুপ্রবেশকারী বলা হয়। কখনোবা কাউয়া বলে ডাকা হয়। তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। দেশের সীমান্ত ডিঙ্গিয়ে ভিনদেশে ঢুকে গেলে তাদের ঠিকানা হয় জেলখানায়, নয়তো কবরে। এই অবস্থায় চারদিকে সন্দেহ ও গোয়েন্দাগিরির নজরদারী চলে। ফলে গোপন তথ্যের উপর অনধিকার চর্চা বেড়ে যায়। এভাবে পরম মিত্র অতি দ্রুত চরম শত্রুতে পরিণত হয়ে যায়। আঞ্চলিক চোরের থাপইত থেকে আন্তর্জাতিক চোরের ইন্ধনদাতা সবাই অসম অনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু করে দেয়। এভাবে শান্ত পৃথিবীটা আদিম উন্মত্ততায় শান্তির পরিবেশ খুইয়ে অশান্ত হয়ে মানবতার অশান্তি ডেকে আনে। তাই স্থান, কাল পাত্র ভেদে সব জায়গা থেকে এসব মানবতা বিনাশী তস্কর বা চোরের থাপইতদের অবৈধ তৎপরতা বন্ধ অথবা বিনাশ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top